দ্বীনের কাঠামোয় নামাযের গুরুত্ব

        ঈমান আনার অর্থ শুধু মৌখিকভাবে এ কথার স্বীকৃতি দেয়া নয় যে, আমি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং তাঁর যাবতীয় বিধি-বিধান অনুসরণ করে চলবো। বরং ঈমান আনার অর্থ হলো, মৌখিকভাবে স্বীকৃতির দেয়ার সাথে সাথে বাস্তবে মহান আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসরণ করা বা বাস্তব আনুগত্যের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা একান্তই অপরিহার্য। পক্ষান্তরে বাস্তব আনুগত্যের সর্বপ্রথম নিদর্শন হলো নামায।

        ঈমান আনার পরে সর্বপ্রথম যখন নামাযের ওয়াক্ত হবে, সেই ওয়াক্তের নামায যথারীতিভাবে আদায় করার অর্থ হলো, যে ব্যক্তি মুহূর্তকাল পূর্বে ঈমান আনলো, সে এ কথারই স্বীকৃতি দিলো যে সে শুধু মৌখিকভাবে স্বীকৃতিই দিলো না, বরং বাস্তবে এ কথা প্রমাণ করে দিলো যে, সে ব্যক্তি পৃথিবীর জীবনে মহান আল্লাহর আনুগত্য করে চলবে।

        কোনো ব্যক্তি যদি সকাল দশটার সময় ঈমান আনে আর মাত্র দুই তিন ঘন্টা পরে যখন তার কানে মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি প্রবেশ করে, তখনই তার ঈমান আনার দাবির স্বপক্ষে বাস্তব প্রমাণ পেশ করার সময় এসে উপস্থিত হয়। মুয়াজ্জিনের আহ্বান শোনার সাথে সাথে যদি ঈমানের দাবিদার উক্ত ব্যক্তি নামায আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে জামাআতে শামিল হয়, তাহলে সে তার ঈমানের দাবির স্বপক্ষে বাস্তবে এ কথার প্রমাণ পেশ করলো যে, উক্ত ব্যক্তি পৃথিবীতে মহান আল্লাহর দাসত্বের মধ্য দিয়ে জীবন পরিচালিত করবে।

        আর যদি সে নামায আদায় না করে, তাহলে এ কথারই প্রমাণ দিলো যে, মুখে যে ঈমানের দাবি সে করেছে- তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং পৃথিবীতে সে আল্লাহ তা'য়ালার দাসত্ব করতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। সুতরাং নামায আদায় না করার মূল অর্থ হলো আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করা। আর আল্লাহ তা'য়ালার আনুগত্য ত্যাগ করে কোনো ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবি করার কোনো ইখতিয়ার রাখে না। বেনামাযী কোনো ব্যক্তি মুসলিম সমাজ-সংগঠনের কোনো সুযোগ-সুবিধাও লাভ করতে পারে না।

        ঐ ব্যক্তির জন্যই আল্লাহর বিধান অবতীর্ণ হয়েছে, যে ব্যক্তি তা মানতে ইচ্ছুক এবং এই বিধানের আনুগত্য করে পৃথিবীতে জীবন-যাপন করতে আগ্রহী। যে ব্যক্তি নামাযই আদায় করেন না, সেই ব্যক্তি তো এ কথারই স্বীকৃতি দিচ্ছে যে- সে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করতে রাজী নয়। আল্লাহর বিধান ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি নামায আদায়ের মাধ্যমে এ কথার স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, সে আপন মনিব আল্লাহর বিধান অনুসারে চলবে। এদিকেই ইংগিত করে আল্লাহ তা'য়ালা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন-

إِنَّمَا تُنْذِرُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ وَأَقَامُوا الصَّلوةَ وَمَنْ تَزَكَّى فَإِنَّمَا يَتَزَكَّى لِنَفْسِهِ

        তুমি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারো যারা না দেখে তাদের রবকে ভয় করে এবং নামায কায়েম করে। আর যে ব্যক্তিই পবিত্রতা অবলম্বন করে সে নিজেরই ভালোর জন্য করে। 

(সূরা ফাতির-১৮)

        সুতরাং যাদের হৃদয়ে মহান আল্লাহর ভয় রয়েছে এবং তয় যে রয়েছে, এ কথার বাস্তব প্রমাণ যারা দেয় নামায আদায়ের মাধ্যমে, আল্লাহর বিধান শুধু তাদেরই জন্য। আল্লাহর বিধান অনুসরণ করার অর্থই হলো দেহ-মনের পবিত্রতা অর্জন করা। আর আল্লাহর বিধান অনুসরণের মাধ্যমে যে ব্যক্তি দেহ-মনের পবিত্রতা অর্জন করবে, সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই করবে। পরকালের নে'মাত তথা জান্নাত ঐসব লোকদের জন্যই প্রস্তুত করা হয়েছে, যারা পৃথিবীতে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা অনুসারে জীবন-যাপন করতে চায়। এসব লোকদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-

وَالَّذِينَ هُمْ عَلى صَلاتِهِمْ يُحَافِظُونَ أُولَئِكَ فِي جَنَّتِ مُكْرَمُوْنَ

        আর যারা নিজেদের নামাযের সংরক্ষণ করে। এই লোকেরা সম্মান ও মর্যাদা সহকারে জান্নাতের বাগানসমূহে অবস্থান করবে। (সূরা মা'আরিজ-৩৪-৩৫)

        যারা জান্নাতে যাবে নামায আদায়কারী হওয়াটা তাদের প্রথম গুণ। যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা তাদের দ্বিতীয় গুণ। আর নামাযের সংরক্ষণ করা তাদের শেষ ও চূড়ান্ত পর্যায়ের গুণ। নামাযের 'সংরক্ষণ' বলতে নামায সম্পর্কিত যাবতীয় তত্বসমূহ বোঝায়। যেমন যথাসময়ে নামায আদায় করা। নামায আদায়ের প্রস্তুতি হিসাবে দেহ ও পোশাকের পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। অজু সহীহভাবে করা এবং অজুতে নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ সর্বোত্তমভাবে ধৌত করা, যে স্থানে নামায আদায় করা হবে, সে স্থানের পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। কিবলা নির্ধারণ করা, নামাযের মধ্যে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাবসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা, নামাযের নিয়মাদি ও মূলভাবধারা অনুসরণ করা, নামায যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তার বিপরীত কর্মসমূহ পরিত্যাগ করা, নামাযের উদ্দেশ্যের বিপরীত কাজ করে নামাযকে ব্যর্থ করে দেয়া। এ ধরনের অনেক কিছুই নামাযের 'সংরক্ষণ' কথাটির মধ্যে রয়েছে।

        নামাযে খুশু-খুযু অবলম্বন করতে হবে। খুশু-খুযূর বিষয়টি একান্তভাবে মনের সাথে জড়িত আর মনে যখন খুশু-খুযূর সৃষ্টি হবে, তখন তার প্রভাব বাহ্যিকভাবে ক্রিয়াশীল থাকবে। কারো বশীভূত হয়ে, কারো সামনে একান্তভাবে নিজের দীনতা-হীনতা, বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করা। মনের খুশূ হলো, যখন কোনো ব্যক্তি মহান আল্লাহকে সিজদা দেয়ার উদ্দেশ্যে নামাযে দন্ডায়মান হলো অর্থাৎ আল্লাহর সামনে দাঁড়ালো, তখন তার গোটা সত্তা জুড়ে এ কথার প্রকাশ ঘটবে যে, সে কার সামনে দাঁড়ালো। মানুষ সাধারণত কোনো প্রতাপশালী ক্ষমতাধর লোকের সামনে গেলে তার সার্বিক আচরণে বিনয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাধারণভাবে মানুষের ক্ষেত্রে যদি এই অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে এই বিশাল আকাশ ও যমিনের মালিক, যিনি অসীম ক্ষমতাধর তাঁর সামনে দন্ডায়মান হলে কতটা বিনয় প্রকাশ করা উচিত।

        মুফাস্স্সিরগণ বলেন, মনের খুশৃ হলো, মানুষ আল্লাহর ভয়ে, তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ভয়ে, তাঁর অসীম প্রতাপ-প্রভাব, ক্ষমতা ও পরাক্রমের কারণে ভয়ে সন্ত্রস্ত ও আড়ষ্ট হয়ে থাকবে। বিনয় ও একাগ্রতার সাথে নামায আদায় করবে। আর শারীরিক খুশূ হলো, মানুষ যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোমল ভঙ্গিতে অবনত হয়ে যাবে। দৃষ্টি থাকবে অবনমিত এবং যা আবৃত্তি করবে, তা পরম ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে আবৃত্তি করবে। সমস্ত কিছুর ওপরে যিনি অসীম ক্ষমতাবান, সেই আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর কারণে তার মধ্যে স্বাভাবিক ভীতি সঞ্চার হবে এবং ভয়ের চিহ্ন তার গোটা অবয়বে ফুটে উঠবে।

        নামাযের প্রাণই হলো খুশূ- এই খুশ্ না থাকলে সে নামায হবে প্রাণহীন দেহের মতো মূল্যহীন। হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন লোককে নামায আদায়রত অবস্থায় দেখলেন, লোকটি তার মুখের দাড়ি বার বার নাড়াচাড়া করছে। তার এই অবস্থা দেখে তিনি বললেন, যদি তার মনে খুশৃ থাকতো, তাহলে তার দেহেও খুশুর সঞ্চার হতো।

        খুশুর বিষয়টি যদিও একান্তভাবে মনের সাথে সম্পর্কিত এবং মনে খুশ্ সৃষ্টি হলে তার প্রভাব বাহ্যিকভাবে শরীরেও প্রতিভাত হয়। এরপরেও ইসলামী শরীয়াত নামায আদায়ের এমন কিছু নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, শরীয়াত কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করলে নামাযে খুশ্ সৃষ্টিতে সাহায্য করে এবং খুশ্ বৃদ্ধি পেলে বা কমে গেলে নামাযের পদ্ধতিগত দিকসমূহকে একটি বিশেষ মানদন্ডে প্রতিষ্ঠিত রাখে। যেমন নামাযে তাড়াহুড়া না করা। যেখানে যা তিলাওয়াত করতে হবে তা যথারীতি ধীরে সুস্থে তিলাওয়াত করা। ওপরের দিকে বা ডানে বামে না তাকানো। দৃষ্টি সিজদার স্থানে স্থির রাখা। অকারণে কণ্ঠ দিয়ে কোনো রূপ শব্দ করা। পরিধানের কাপড় বার বার নাড়াচাড়া করা। গর্বিত ভঙ্গিতে না দাঁড়ানো।

         মোটকথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতিতে নামায আদায় করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে যেভাবে নামায আদায় করতে বলেছেন, অনুরূপভাবে নামায আদায় করা। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, তুমি যখন নামাযের জন্য দাঁড়াবে তখন কেবলামুখী হয়ে তাকবীর বলবে। (বোখারী ও মুসলিম)

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের দিকে মুখ করে নামায আদায় করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, নামাযের চাবি হলো পবিত্রতা অর্জন। তাকবীরের মাধ্যমে নামাযের বাইরের হালাল কাজগুলো নামাযের মধ্যে হারাম করা হয় এবং সালাম ফিরানোর মাধ্যমে নামাযের বাইরের হালাল কাজগুলোকে হালাল করা হয়। (আবু দাউদ-তিরমিযী)

        আল্লাহর রাসূল নামায আদায়কালে মাথা নীচু করতেন এবং তাঁর পবিত্র দৃষ্টি সিজদার স্থানে নিবদ্ধ রাখতেন। নামায আদায়রত অবস্থায় তিনি আকাশ বা ওপরের দিকে দৃষ্টি দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'তোমরা যখন নামায আদায় করবে তখন এদিক ওদিক দৃষ্টি দেবে না। কারণ আল্লাহ তা'য়ালা নিজের চেহারা বান্দার চেহারার দিকে নিবদ্ধ রাখেন। বান্দাহ্ যখনই সিজদার স্থান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, তখন আল্লাহ তা'য়ালাও সে বান্দার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন।' (আবু দাউদ)

        নামাযের মধ্যে এদিক ওদিক তাকানো সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে, 'এটা হচ্ছে বান্দার নামাযে শয়তানের ছোবল।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের মধ্যে তিনটি কাজ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। প্রথমটি হলো, দুই সিজদার মাঝে সোজা হয়ে না বসে মোরগের মতো ঠোকর দেয়া অর্থাৎ তাড়াহুড়া করে সিজদা দেয়া। দ্বিতীয়টি হলো, কুকুর যে ভঙ্গিতে বসে সেই ভঙ্গিতে না বসা এবং তৃতীয়টি হলো, এদিক ওদিক না তাকানো। নামাযের মধ্যে এদিক ওদিক তাকানোকে শিয়ালের তাকানোর সাথে তুলনা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'এমনভাবে তুমি নামায আদায় করো, যেনো তুমি আল্লাহ তা'য়ালাকে দেখছো। আর যদি তুমি তাকে না-ও দেখো তাহলে তিনি অবশ্যই তোমাকে দেখেন।' এই অনুভূতি মনের মধ্যে জাগ্রত রেখে নামায আদায় করলে সেই নামাযে অবশ্যই খুশৃ সৃষ্টি হবে।

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'কোনো ব্যক্তি যদি উত্তমরূপে অজু করে বিনয়ের সাথে নামায আদায় করে, ভালোভাবে রুকু করে তাহলে এই নামায তার ছগীরা গোনাহসমূহের ক্ষতিপূরণ হবে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কবীরা গোনাহ্ থেকে নিজেকে হেফাজত করবে। (মুসলিম)

        আল্লাহর রাসূল নামাযে কিরাআত শেষ করে দ্রুত রুকুতে যেতেন না। কিরাআত শেষ হবার পরে তিনি ধীর স্থিরভাবে রুকুতে যেতেন। তিনি রুকুতে এমনভাবে পিঠ বাঁকাতেন যে, তাঁর পিঠে পানি ঢেলে দিলেও তা যেনো স্থির থাকে। অর্থাৎ তিনি ধনুকের মতো বাঁকানো ভঙ্গিতে রুকু করতেন না। ধীরে পৃথক পৃথকভাবে স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি রুকুর তাস্বীহ পাঠ করতেন- তাড়াহুড়া করে রুকুর তাস্বীহ পাঠ করা যাবে না।

        তিনি বলেছেন, 'তোমরা রুকু-সিঙ্গাহ্ পরিপূর্ণ করো। তুমি যখন তোমায় দুই হাত দুই হাঁটুর ওপর রাখবে তখন আঙ্গুলগুলো ফাঁক রাখবে। তারপর একটু থামবে যে পর্যন্ত না প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার নিজ স্থানে স্থির হয়। তোমার পিঠ সমানভাবে বাঁকাবে।' হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি পিঠ-মাথা উঁচু-নীচু করতেন না। বরং মাথা পিঠের সাথে সমানভাবে রাখতেন। একদিন তিনি একজন লোককে দেখলেন যে, লোকটি নামাযে রুকু পরিপূর্ণ করছে না এবং সঠিকভাবে সিজদাও দিচ্ছে না। বরং পাখির মতো ঠোকর দিচ্ছে। লোকটিকে এভাবে নামায আদায় করতে দেখে তিনি বললেন, 'ঐ লোকটি এই অবস্থায় ইন্তেকাল করলে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল হবে না। সে নামাযে কাকের অনুরূপ ঠোকর দিচ্ছে। যে লোক রুকু পরিপূর্ণ করে না এবং সিজদায় ঠোকর দেয়, তার দৃষ্টান্ত হলো সেই ক্ষুধার্ত লোকের মতো, যে একটি অথবা দুটো খেজুর আহার করে কিন্তু এতে তার কোনো লাভ হয় না। অর্থাৎ লোকটির ক্ষুধা মিটে না।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'নামায চোর হচ্ছে সবথেকে নিকৃষ্ট চোর।' উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে নামায চুরি করা হয়?' তিনি বললেন, 'রুকু-সিজদা পরিপূর্ণ না করা।' তিনি আরো বলেন, 'সে ব্যক্তির নামায হয় না, যে রুকু-সিজদায় পিঠ সোজা করে না।' আল্লাহর রাসূল ধীর স্থিরভাবে রুকু করতেন এবং রুকু থেকে সোজা হয়ে তিনি বেশ সময় ব্যয় করে তারপর সিজদায় যেতেন। তিনি রুকু থেকে সোজা হয়ে এতটা সময় ব্যয় করতেন যে, লোকজন ধারণা করতো তিনি বোধহয় সিজদায় যাবার কথা ভুলে গিয়েছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশান্তির সাথে রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আদেশ দিয়ে বলেছেন, 'যখন তুমি রুকু থেকে মাথা তুলবে তখন সোজা হয়ে দাঁড়াবে যেনো হাড়সমূহ তার গ্রন্থিসমূহের সাথে স্থির হয়ে যায়। এমন না করলে তোমাদের নামায পরিপূর্ণ হবে না।' (বোখারী)

         তিনি আরো বলেন, 'আল্লাহ তা'য়ালা সেই লোকের নামাযের দিকে দৃষ্টি দেন না, যে লোক রুকু সিজদায় পিঠ সোজা করেনা।' (আহমদ)

        তিনি এমনভাবে সিজদা করতে আদেশ দিয়েছেন, যেন দেহের হাড়ের প্রত্যেকটি গ্রন্থি শান্ত অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ তাড়াহুড়া করে বা দৃষ্টিকটু ভঙ্গিতে সিজদা করতে নিষেধ করেছেন। সিজদায় প্রশান্তির সাথে সিজদার তাস্বীহ তিলাওয়াত করতে হবে, তাড়াহুড়া করা যাবে না। স্পষ্ট উচ্চারণে পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ আমাকে দেখছেন এবং সিজদা করা হচ্ছে অর্থাৎ মাথা রাখা হচ্ছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কুদরতী পায়ের ওপরে।

         হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, মানুষ যখন আল্লাহ তা'য়ালাকে সিজদা দেয়, তখন সে আল্লাহ তা'য়ালার নিকটবর্তী হয়ে যায়। সুতরাং ধীর স্থিরভাবে প্রশান্তির সাথে আপন মালিক মহান আল্লাহকে সিজদা দিতে হবে। কোনো ধরনের ব্যস্ততা বা তাড়াহুড়া করা যাবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আমার উম্মতের মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যাকে আমি কিয়ামতের দিন চিনতে পারবো না।' সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! অসংখ্য মানুষের মধ্যে আপনি কি করে চিনতে পারবেন?' তিনি বললেন, 'ঐ ব্যাপারে তোমাদের মতামত কি, তুমি যদি ঘোড়ার কোনো আস্তাবলে প্রবেশ করো আর সেখানে যদি কালো ঘোড়ার মধ্যে এমন একটি ঘোড়া থাকে যার পায়ের নীচে ও মুখ সাদা থাকে তাহলে তুমি সেটিকে পৃথকভাবে চিনতে সক্ষম হবে না?' সাহাবায়ে কেরাম জবাব দিলেন, 'অবশ্যই চিনতে সক্ষম হবো।'

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'কিয়ামতের দিন আমার উম্মত সিজদার কারণে তাদের অবয়ব হবে শুভ্র এবং অজুর কারণেও তাদের হাত-পা শুভ্র দেখাবে।' (তিরমিযী)

        বোখারী হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, আখিরাতের দিন আল্লাহ তা'য়ালা যখন কোনো জাহান্নামীর প্রতি করুণা করতে চাইবেন, তখন তিনি ফেরেস্তাদেরকে আদেশ দিয়ে বলবেন, 'যারা আমার ইবাদাত করতো (অর্থাৎ যারা আল্লাহর ইবাদাত করতো বটে কিন্তু গোনাহগার ছিলো) তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে এসো।' ফেরেস্তাগণ আল্লাহর আদেশ পালন করবেন, তাঁরা সিজদার স্থান দেখে ঐসব লোকদেরকে চিনতে পারবেন, যারা আল্লাহকে সিজদা দিতো। কারণ, আল্লাহ তা'য়ালা সিজদার স্থান জাহান্নামের আগুনে পোড়া হারাম করে দিয়েছেন। জাহান্নামের আগুন আদম সন্তানের সমস্ত দেহ জ্বালিয়ে দিলেও সিজদার স্থান জ্বালাতে পারবে না।

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পৃথিবীর গোটা জমীন আমার উম্মতের জন্য মসজিদ এবং পবিত্র করা হয়েছে। যখন ও যেখানে যে মুহূর্তে নামাযের ওয়াক্ত হবে সেখানেই তার মসজিদ এবং সেখানেই পবিত্রতা। আমার পূর্বের নবী-রাসূলের উম্মতদের জন্য কঠিন নিয়ম ছিলো। তারা শুধুমাত্র গীর্জায় নামায আদায় করতো।..

        প্রথম সিজদা দেয়ার সাথে সাথে তাড়াহুড়া করে দ্বিতীয় সিজদা দেয়া যাবে না। প্রথম সিজদা যেমন প্রশান্তির সাথে ধীর স্থিরভাবে দিতে হবে, অনুরূপভাবে প্রথম সিজদা দিয়ে এমনভাবে সোজা হয়ে বসতে হবে যেনো দেহের অস্থিসমূহ যথাস্থানে লেগে যায়। হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল দুই সিজদার মাঝখানে আরেক সিজদার সমপরিমাণ সময় ব্যয় করতেন। প্রথম সিজদা দিয়ে তিনি কখনো কখনো এতটা সময় ব্যয় করতেন যে, লোকজন মনে করতো, তিনি বোধহয় দ্বিতীয় সিজদা দেয়ার কথা ভুলে গিয়েছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের কেউ এমন না করলে (অর্থাৎ প্রথম সিজদা দিয়ে প্রশান্তির সাথে সোজা হয়ে না বসলে) তার নামায পরিপূর্ণ হবে না।
  (আবু দাউদ)

         নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় যেমন বিভিন্ন ধরনের দোয়া করতেন অনুরূপভাবে প্রথম সিজদা দিয়ে সোজা হয়ে বসেও দোয়া করতেন। কারণ সিজদার সময় যে দোয়া করা হয়, তা আল্লাহ তা'য়ালা কবুল করেন। আল্লাহর রাসূল যেভাবে নামায আদায় করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামদেরকে যেভাবে নামাযের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, অনুরূপভাবে নামায আদায় করতে হবে, তাহলে অবশ্যই নামাযে একাগ্রতা, বিনয় তথা খুশু-খুযু সৃষ্টি হবে। নামাযের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়- এমন কোনো কাজ নামাযের মধ্যে করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নামায আদায়ের সময় যে নিয়ম-নীতি ও আদব-কায়দা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে। নামায আদায়ের সময় জেনে বুঝে নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন চিন্তা-চেতনা ও কল্পনা থেকে মনকে মুক্ত রাখতে হবে।

         অনিচ্ছাকৃতভাবে নানা ধরনের চিন্তা ও কল্পনা মনের জগতে প্রবেশ করা মানুষ মাত্রেরই একটি স্বভাবগত দুর্বলতা। মানুষের মন এমন এক জিনিস যা কখনো নীরব থাকে না। কিন্তু নামায আদায়ের সময় পূর্ণপ্রচেষ্টা থাকতে হবে নামাযের সময় মন যেনো আল্লাহ তা'য়ালার প্রতি আকৃষ্ট থাকে এবং মুখে সে যা কিছু উচ্চারণ করে মনও যেনো তারই আর্জি পেশ করে। অর্থাৎ 'আমি আল্লাহকে দেখছি না কিন্তু তিনি আমাকে দেখছেন এবং আমার প্রত্যেকটি স্পন্দনের প্রতি তিনি লক্ষ্য রাখছেন' এই অনুভূতি নামায আদায়ের সময় হৃদয়ে জাগ্রত রাখলে মন অন্য চিন্তা-কল্পনা থেকে মুক্ত থাকবে আশা করা যায়। নামাযের মধ্যে নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন চিন্তা ও কল্পনা যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে এসে যায় তাহলে যখনই অনুভূতি সজাগ হবে যে, 'আমি নামায আদায় করছি এবং আমার মনে কি কল্পনা হচ্ছে, সেটাও আল্লাহ তা'য়ালা জানতে পারছেন' তখনই অবান্তর চিন্তা-কল্পনা থেকে মনকে মুক্ত করে নামাযের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে, কোনো বিষয় প্রকাশ করা হোক বা গোপন করা হোক এবং মনের জগতে যা কিছু চিন্তা ও কল্পনা করা হয়, সে সম্পর্কেও আল্লাহ তা'য়ালা হিসাব গ্রহণ করবেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

إِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ

        তোমরা তোমাদের মনের কথা প্রকাশ করো আর না-ই করো আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের কাছ থেকে সে সম্পর্কে হিসাব গ্রহণ করবেন। (সূরা বাকারা-২৮৪)

Post a Comment

0 Comments