নবী করীম (সা:) এর অনুপম আদর্শের আকর্ষণ

        সুদূর অতীতকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষী মহল, 'ইসলাম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে এবং সন্ত্রাসই এর মূল লক্ষ্য'। এই আপ্তবাক্য প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে মুসলিম দেশ থেকে লুণ্ঠিত অগণিত অর্থ তারা ব্যয় করেছে এবং করছে। বিশেষ করে পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে তারা উল্লেখিত অবাঞ্ছিত কথাটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো, তাদের ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ওপরে একদিন ইসলামের বিজয় কেতন যে উড়বেই, এ সত্য তারা জানে। সুতরাং যতদিন ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে রাখা যাবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের যৌনতানির্ভর ঘৃণ্য সভ্যতা জীবীত থাকবে।

        ইসলাম কিভাবে আপন মহিমায় মানুষের হৃদয়ে নিজের আসন করে নিয়েছে, কতকগুলো ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই বিদ্বেষীদের মুখোশ উন্মোচন হয়ে যায়। নবী করীম (সা:) যখন মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানালেন, তখন তাঁর ডাকে সাড়া দেয়ার এবং তাঁকে সহযোগিতা করতে কেউই প্রস্তুত ছিল না। সমগ্র আরব তাঁর আহ্বানের বিরুদ্ধে শানিত অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে গেল। বিরোধিতার যতগুলো পন্থা ছিল, সবগুলোই তাঁর ওপরে প্রয়োগ করা হলো। কিন্তু বিশ্বনবী (সা:) ওহীভিত্তিক কৌশল দ্বারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মহাসত্যের আহ্বান জানাতে থাকলেন।

        তাদের কৃতকর্মের অসারতা এবং ক্ষতিকর দিকসমূহ তাদের সামনে বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরতে থাকলেন। তারা যে পথে চলছে, এ পথ যে তাদেরকে চরম এক ক্ষতিকর পরিণতির দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, তা তাদেরকে বুঝাতে লাগলেন। তিনি সে সমাজের যাবতীয় অনাচার চিরতরে উৎখাত করতে আগ্রহী হলেন। কিন্তু এই কাজ সম্পাদন করার জন্য যে শক্তি সামর্থ প্রয়োজন, তা তাঁর হাতে তখন পর্যন্ত ছিলো না। তিনি এটাও জানতেন, তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দেয়ার অর্থ হলো চরম নির্যাতন সহ্য করা। এই দাওয়াত যারা কবুল করবে, তাদেরকে যে কোনো ধরনের অত্যাচার সহ্য করা ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা থাকবে না। জুলুম যখন অনুষ্ঠিত হবে তখন তা প্রতিহত করার মতো জাগতিক শক্তিও তাঁর নেই। সুতরাং সকল মুসিবত সহ্য করতে হবে।

        নবী করীম (সা:) যেমন জানতেন এবং যারা তাঁর আহ্বান শুনছেন, তাঁরাও জানতেন ইসলাম গ্রহণ করার অর্থই হলো নিজের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, দেশবাসীকে নিজের শত্রুতে পরিণত করা। নিজের যাবতীয় অধিকার হতে নিজেকে বঞ্চিত করা। যে কোনো ধরনের কঠিন শাস্তিকে বরণ করে নেয়া। এমনকি নিজের প্রাণও চলে যেতে পারে। এ কথা জেনে বুঝেই এক শ্রেণীর মানুষ সে সমাজে নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে সত্যের সন্ধানকারী এক শ্রেণীর মানুষ এসে নবীর দাওয়াত গ্রহণ করতেন এবং নিজের এলাকায় গিয়ে সে দাওয়াত প্রচার করতেন। বিরোধিতার প্রচণ্ড সয়লাব তাদেরকে খড়কুটোর মতই উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইতো। নিজের কষ্টার্জিত সহায় সম্পদ থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করতো। লোমহর্ষক নির্যাতন করা হতো। দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হতো। তবুও তারা ইসলাম ত্যাগ করতেন না এবং এই কঠিন অবস্থা দেখেও যে কোনো নির্যাতন হাসি মুখে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েই মানুষ এই সত্য গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে আসতেন। এসব ইতিহাস রূপকথার গল্প নয়, ইসলামের ইতিহাসের বাস্তব ঘটনা। এই ইতিহাস জীবন্ত থাকার পরেও এক শ্রেণীর ইয়াহুদী আর খ্রিষ্টান তথা অমুসলিমরা কি করে বলেন, ইসলাম শক্তি প্রয়োগ করে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেছে?

        পৃথিবীর কোনো স্বার্থ সামনে উপস্থিত নেই, অথচ চরম কঠিন অবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ স্রোতের মতই এসে রাসূলের পাশে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেছেন। তাঁরা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এই ত্যাগ স্বীকারে তাদেরকে কি নবী শক্তি প্রয়োগ করে বাধ্য করেছিলেন? তাঁরা তো কেবলমাত্র অন্তরের চাহিদা অনুযায়ী পঙ্গপালের মতই নবীর কাছে ছুটে আসতেন এবং ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতেন। তাদের এই বিশ্বাসের ভেতরে সামান্যতম খাদ ছিল না, কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দু বা সংশয় সংকোচ ছিল না। স্বতস্ফুর্তভাবে তাঁরা দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে নির্যাতনের লোমহর্ষক তাণ্ডব সহ্য করেছেন অথবা প্রাণদান করেছেন।

        কিন্তু কেনো তাঁরা এভাবে তাদের বিশ্বাসের কারণে সীমাহীন নির্যাতন সহ্য করলেন বা কিসের মোহে তাঁরা নবীর ওপরে বিশ্বাসে অটল ছিলেন? অগণিত মানুষ কেনো এভাবে সকল কিছুই বিলিয়ে দিয়ে একটি বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছেন? এ সম্পর্কে চিন্তা করলে দেখা যায়, তাদের সবার বিশ্বাসের কারণ এক ও অভিন্ন ছিল না। শুধুমাত্র নবী করীম (সা:) এর অলৌকিক কর্মকাণ্ডের কারণেই মানুষ এভাবে তাঁর প্রতি আকর্ষিত হয়ে তাঁর আদর্শ গ্রহণ করেনি। বরং যাদের মন-মানসিকতা ছিল পরিচ্ছন্ন, চরিত্র ছিল উন্নত, পংকিলতার ভেতরে ডুবে থেকেও মন ও চিত্ত ছিল বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন, তাদের ইসলাম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নবুয়‍্যাতের সততার সপক্ষে নানা ধরনের যুক্তি প্রমাণ ও বাস্তবতা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে এবং তাদেরকে মহাসত্যের প্রতি আকর্ষিত করেছে। তরবারী তাদেরকে সত্য গ্রহণে সামান্যতম আকর্ষিত করেনি।

        তাঁদের সত্য গ্রহণ করার পেছনে ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন কারণ ক্রিয়াশীল ছিল। হযরত আবু বকর (রা:) মহাসত্যের আহ্বান শ্রবণ করা মাত্র সত্য গ্রহণ করেছিলেন। সত্য তাঁকে আহ্বান করছে, এ প্রমাণই তাঁর মতো পূত-পবিত্র ব্যক্তির কাছে যথেষ্ট ছিল। কোনো ধরনের প্রমাণের আবশ্যক তাঁর ছিল না। সে. সমাজে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যারা হযরত আবু বকরের অনুসরণ করেছিলেন মাত্র। হযরত আবু বকর (রা:) এর পবিত্র চরিত্র তাদের সামনে স্পষ্ট ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, আবু বকর (রা:)-এর মতো মানুষ যখন একটি বিষয়ের ওপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছে তখন তা অবশ্যই সত্য।

        এদের মাঝে ছিলেন হযরত ওসমান (রা:), হযরত আব্দুর রহমান (রা:) ও হযরত ওবায়দাহ ইবনে জাররাহ (রা:)। নবীর কাছে এসে তাঁরা তাদের আকাংখা অনুযায়ী এমন কিছু দেখলেন যে, তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। বিশ্বনবী (সা:) এর বিশাল হৃদয়, গরীবের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ, তাঁর চরিত্রের অনুপম সৌন্দর্য, তাঁর ক্ষমা, দুঃখী মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা এসব দেখে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হলো, এই ধরনের অনুপম চরিত্রের একজন মানুষের ভেতরে কোনো অশুভ শক্তি কাজ করতে পারে না।

        নবী করীম (সা:) এমন এক চরিত্র অনুসরণ করতে মানুষকে উৎসাহিত করেন, যে চরিত্র অনুসরণ করলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব হওয়া যায়, এটা দেখে হযরত আমর ইবনে আস্বামা (রা:) ও হযরত উনাইস গিফারী (রা:) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। পবিত্র কুরআন শ্রবণ করেই হযরত উমার (রা:), হাবশার বাদশাহ, হযরত তুফায়েল ইবনে আমর দাওসী (রা:) ও হযরত যুবায়ের ইবনে মুতয়িম (রা:) ইসলাম গ্রহণ করলেন। হযরত দ্বাম্মাত ইবনে সালাবা তাবাজুদী (রা:) শুধুমাত্র কালিমায়ে তাইয়েবা শ্রবণ করেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

        হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) ছিলেন মদীনার ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের মধ্যে সবথেকে জ্ঞানী ব্যক্তি, তিনি নবী করীম (সা:) এর পবিত্র চেহারা মুবারক দেখেই উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, 'মহান আল্লাহর কসম! এমন সুন্দর জান্নাতি চেহারা কোনো মিথ্যাবাদীর হতে পারে না'। শুধুমাত্র নবীর চেহারা দেখেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত দ্বাম্মাত ইবনে সালাবা (রা:) ছিলেন তাঁর গোত্র বনী সায়াদের নেতা। তিনি একদিন আনমনে নবী করীম (সা:) এর কাছে উপস্থিত হয়ে শপথ দিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'আপনি কি প্রকৃত পক্ষেই আল্লাহর রাসূল?'

        নবী করীম (সা:) জবাব দিলেন, 'আল্লাহর শপথ! আমি সত্যই আল্লাহ তা'য়ালার রাসূল'।

        তিনি দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করেই ইসলাম গ্রহণ করলেন। মদীনার বিখ্যাত দুই গোত্র আউস এবং খাজরাজ, তাঁরা তাদের প্রতিবেশী ইয়াহুদীদের কাছে শুনেছিলেন, শেষ নবী বর্তমান সময়েই আগমন করবেন। এই কথা তাঁরা বিশ্বাস করে মক্কায় নবী করীম (সা:) এর মুখের কথা শুনেই বুঝলেন এই ব্যক্তিই শেষ নবী। তাঁরা কালবিলম্ব না করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তারপর মক্কা বিজয়ের পরে মক্কার বিভিন্ন গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত বিশ্বাসের কারণেই। তাদের বিশ্বাস ছিল, কা'বাঘর কোনো মিথ্যাবাদী কক্ষণোই নিয়ন্ত্রণ করবে না। দীর্ঘ দিন ধরে বিরোধিতা করেও যখন তারা সফল হতে পারলো না, নবী করীম (সা:) কা'বার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, তখন তাদের বিশ্বাস হলো এই ব্যক্তি সত্যই আল্লাহ তা'য়ালার নবী।

        আরবের অনেক গোত্রই নবী করীম (সা:) এর বদান্যতা দেখেই ইসলাম কবুল করেছিল। আরবের জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী এবং কবি সাহিত্যিকগণ পবিত্র কুরআনের বিন্যাস দেখেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। যারা ছিল বিখ্যাত যোদ্ধা, বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের অলৌকিক বিজয় দেখেও যাদের অন্তরে সামান্য রেখাপাত হয়নি, তারা মুসলমানদের শিষ্টাচার ও চারিত্রিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মুসলমানদের সাথে ইসলাম বিরোধিরা যখন একত্রে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেছিল, তখন তারা ইসলামের বৈশিষ্ট দেখেই ইসলাম কবুল করেছিলেন।

        মক্কায় নবী করীম (সা:) এর অসংখ্য মু'জিযা প্রকাশ পেয়েছে। আবু জাহিল অসংখ্য মু'জিযা দেখেছে। কিন্তু তার হৃদয় সত্য গ্রহনের জন্য মুক্ত ছিল না। সত্য সে গ্রহণ করতে পারেনি। আবু সুফিয়ান চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত ও বিভিন্ন ধরণের মু'জিযা দেখলো, কয়েকটি যুদ্ধে মুসলমানদের অলৌকিক বিজয় দেখলো, তার মেয়ে উম্মে হাবিবা (রা:) ছিলেন নবী করীম (সা:) এর পবিত্রা স্ত্রী, মেয়ের ভেতরে বিরাট পরিবর্তন দেখলো, কিন্তু তাঁর অন্তরে কিছুই রেখাপাত করলো না। কিন্তু সে যখন নিজের চোখে দেখলো এবং নিজের কানে শুনলো, রোম সম্রাট নবীর পা ধুয়ে দিতে আগ্রহী, তখন তার চিন্তার জগতে বিপ্লব সাধিত হলো।

        খ্রিষ্টানদের নেতা আদী ইবনে হাতেম (রা:) নবীর দরবারে জাঁকজমকের সাথে আগমন করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর দেখা রাজা বাদশাহর মতই তিনি আচরণ করেন। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকজন এলেও তার সাথে তিনি পরম আপনজনের মতই ব্যবহার করেন। তখন তাঁর অন্তর বলে উঠলো, এই ব্যক্তি অবশ্যই আল্লাহর নবী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। অনেক ইয়াহুদী, যারা আসমানী কিতাব অধ্যয়ন করে জেনেছিলেন শেষ নবী কেমন হবেন। তারা নবীর কাছে এসে তাঁকে দেখেই চিনেছেন। কথা বলেছেন। প্রশ্নের পরে প্রশ্ন করে সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।

        কেউ নবীর কাছে এসে দাবী করেছেন, 'ঐ খেজুরগুলো যদি এসে আপনার নবী হওয়া সম্পর্কে সাক্ষী দেয় তাহলে আমি মুসলমান হবো'।

        নবী করীম (সা:) মহান আল্লাহ তা'য়ালার নামে ইশারা করেছেন, খেজুর কাছে এসে সাক্ষী দিয়েছে, এই মু'জিযা দেখেই সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। কেউ দাবী করেছে, ঐ গাছটি যদি কালেমা পাঠ করে তাহলে আমিও কালেমা পাঠ করে ইসলাম কবুল করবো। নবী করীম (সা:) এর কথায় গাছ কালেমা পাঠ করেছে, সে এই অলৌকিক ঘটনা দেখে ইসলাম কবুল করেছে। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। পক্ষান্তরে শক্তি প্রয়োগের কোনো একটি দৃষ্টান্তও নেই।

Post a Comment

0 Comments