নবীদের সমসাময়িক যুগের অবস্থা সম্পর্কিত ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায় যে, সেসব যুগে মানুষ যে বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ও পারদর্শিতা অর্জন করেছিল, মহান আল্লাহ তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলকে সে বিষয়ে যুগের সমস্ত মানুষের ওপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে প্রেরণ করেছিলেন। হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামকে যখন প্রেরণ করা হয়েছিল, তখন মানুষ যাদুবিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। তারা যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে অস্বাভাবিক একটা কিছু প্রদর্শন করতে সক্ষম হতো। মহান আল্লাহ তাঁর নবী হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামকে এমন ধরনের ক্ষমতা দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন যে, তদানীন্তন যুগের শ্রেষ্ট যাদুকরদের যাবতীয় ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামকে প্রদত্ত ক্ষমতা ও শক্তির সামনে পানির বুদ্বুদের মতই মিলিয়ে গেল।
সাধারণ মানুষ অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করলো, যাদুকরবৃন্দ দীর্ঘ সাধনার ফলে যে শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন করেছিল, তা মুহূর্তের ভেতরে হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামের শক্তি ও ক্ষমতার সামনে ম্লান হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, তারা এটাও স্পষ্ট অনুভব করলো যে, যাদুকরদের প্রদর্শনীমূলক ক্রিয়াকর্ম স্পষ্টতই যাদু-যা যে কোন ব্যক্তি সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম যা প্রদর্শন করছেন, তা যাদু নয় এবং এ ক্ষমতা সাধনা করে অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং এ ক্ষমতা তিনিই দান করেছেন, যিনি এ আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা এবং পালনকর্তা।
হযরত ঈসা রুহুল্লাহকে যখন পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল, তখন মানুষ চিকিৎসা শাস্ত্রে এতটা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছিল যে, তারা দুরারোগ্য ব্যাধি চিকিৎসার মাধ্যমে উপশম করতে সক্ষম হতো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামকে সে যুগের সমস্ত মানুষের ওপরে যোগ্যতা, ক্ষমতা ও জ্ঞানের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। তিনি জন্মান্ধের চোখে হাত স্পর্শ করতেন আর জন্যাদ্ধ দৃষ্টিশক্তি লাভ করতো। সমকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগণ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামের ক্ষমতা অবলোকন করতে বাধ্য হতো। সাধারণ জনগণ চিকিৎসকদের ক্ষমতা আর হযরত ঈসার ক্ষমতার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য অনুধাবন করতে সক্ষম হতো যে, চিকিৎসকগণ যে ক্ষমতা প্রয়োগ কর, তা তাদের সাধনা লব্ধ ক্ষমতা। আর হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম যে ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন, তা সাধনালব্ধ কোন ক্ষমতা নয়-এ ক্ষমতা তিনিই দান করেছেন, যিনি সমস্ত সৃষ্টির প্রতিপালক।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহ সারা পৃথিবীবাসীর জন্য শেষনবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী-রাসূল আসবে না। তাঁকে যে যুগে এবং যেখানে প্রেরণ করা হয়েছিল, ইতিহাস সাক্ষী-সেখানের মানুষ ভাষা ও সাহিত্যে এতটা পারদর্শিতা অর্জন করেছিল যে তারা পরস্পরে সাধারণভাবে যেসব কথা বলতো, সে কথাগুলোও কাব্যাকারে বলতো। তাদের কথা ও রচিত পংক্তিমালার ভেতরে উচ্চমানের সাহিত্য বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।
বর্তমান বিজ্ঞানের হিরন্ময় কিরণে উদ্ভাসিত পৃথিবীর সভ্যতাগর্বী মানুষ সে যুগের মানুষ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই তাদের প্রতি 'বর্বর, মূর্খ' ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করে থাকে। অথচ তাদের রচিত কাব্যসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বর্তমানের ভাষাবিদগণ স্তব্ধ হয়ে পড়েন। সে যুগে রচিত কবিতাসমূহ বর্তমানেও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে পঠিত হচ্ছে। বিশ্বনবীর মহিলা সাহাবী হযরত খান্না রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁর রচিত কবিতা মাত্র কিছুদিন পূর্বে বৈরুত থেকে ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ হয়ে গোটা পাশ্চাত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নবীর সাহাবী হযরত হাছান রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বিখ্যাত একজন কবি ছিলেন।
বর্তমানে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ইসলাম বিদ্বেষীগণ যেমন খোদাহীন কবি সাহিত্যিকদেরকে ব্যবহার করে থাকে, সে যুগেও ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী সে যুগের কবি ও সাহিত্যিকদেরকে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতো। এসব কবি আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রূপাত্মক ও বিদ্বেষমূলক কবিতা রচনা করে সারা আরব সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে দিত যেন সাধারণ মানুষের মনে আল্লাহর নবী ও তাঁর সাহাবাদের সম্পর্কে ঘৃণার উদ্রেক হয়।
সাহাবাগণ এসব কটুক্তিপূর্ণ কবিতা শুনে ব্যথিত হতেন। তাঁরা হযরত আলীকে অনুরোধ জানালেন তিনি যেন কবিতা রচনা করে ইসলাম বিদ্বেষী কবিদের জবাব দেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাঁকে অনুমতি দান করেন তাহলে তিনি জবাব দেবেন। রাসূলের কাছে অনুমতি কামনা করা হলে তিনি বললেন, 'আলী এ কাজের উপযুক্ত নয়।' তারপর তিনি মদীনার আনসারদের লক্ষ্য করে বললেন, 'যাঁরা তলোয়ার দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে তাঁরা কি ভাষা দিয়ে এ বিদ্রূপের বাধা দিতে পারেন না?'
আল্লাহর রাসূলের এ কথা শুনে বয়স্ক একজন আনসার সাহাবী উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জিহ্বা বের করে রাসূলকে দেখালেন। তারপর তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সাথে অনুমতি কামনা করে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এ কাজের জন্য আমি উপস্থিত। মহান আল্লাহর শপথ! আল্লাহর শত্রুদের কথার মোকাবেলা করার মতো বাক্যের থেকে বসরা, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে আমার কাছে অন্য কোন বাক্য-ই প্রিয় নয়।' আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'আমি যে বংশ থেকে স্বয়ং উদ্ভূত সে বংশের লোকদের বিদ্রূপ তুমি কিভাবে করবে?' হযরত হাছান বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তাদের মধ্য থেকে আপনাকে এমনভাবে পৃথক করবো যেভাবে আটার স্তূপ থেকে চুল বের করা হয়।'
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সে প্রিয় সাহাবীর দিকে পরম মমতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং তাঁকে দায়িত্ব দিলেন, তিনি যেন ইসলাম বিদ্বেষী কবিদের জবাব কবিতা দিয়েই দেন। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী কবিতা রচনা করে শত্রুদের মুখ বন্ধ করে দিতেন। তিনিই দরবারে রেসালাতের সবচেয়ে বড় কবি হবার মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। হযরত বিলালের মতো একজন হাবশী গোলামও অতুলনীয় কাব্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পরে প্রাথমিকভাবে মদীনার আবহাওয়া অনুকুল না হবার কারণে অনেকেই প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। জ্বরের তীব্রতা এতটা ছিল যে, কারো কারো মাথার চুল পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু জ্বরে আক্রান্ত হলেন। প্রচন্ড জ্বরের কারণে কখনও কখনও তিনি অসামঞ্জস্যমূলক কথা বলতেন। এই অবস্থাতেও তাঁর হৃদয়ে সুপ্ত দেশ প্রেম জাগ্রত হয়ে উঠতো এবং যার প্রকাশ ঘটতো কবিতার মাধ্যমে। তিনি তাঁর শৈশব কৈশোর আর যৌবনের চারণভূমি মক্কার বিভিন্ন স্থানের স্মৃতি চারণ করতেন কাব্যাকারে।
প্রিয় জন্মভূমি মক্কার কথা মনে পড়লেই তাঁর চোখ থেকে ঝর্ণার মত পানি ঝরতো। মাতৃভূমি মক্কার কথা স্মরণ করে তিনি বিরহ গাঁথা রচনা করে গাইতেন। তখন তাঁর দু'নয়ন থেকে তপ্ত অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তো। তাঁর হৃদয়ের ক্ষত থেকে কবিতাকারে বের হয়ে আসতো, 'হায়! সেদিন কি আর আমি ফিরে পাবো না! যেদিন আমি মক্কার উন্মুক্ত প্রান্তরে নির্জনে একাকী রজনী অতিবাহিত করবো, আমার সঙ্গী হবে সেখানের সুগন্ধি ঘাস ইজখির আর রাতের শিশির। হায়! সেদিন কি আর আমার জীবনে দেখা দেবে! যেদিন আমি মাজনার সরোবরে সাঁতার কাটতে সক্ষম হবো! প্রাণভরে আমি তাফীলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করবো! মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন একটি কিতাব দান করলেন, যে কিতাবের সামনে পৃথিবীর সমস্ত কবি-সাহিত্যিকদের কাব্য ও সাহিত্য প্রতিভা চিরদিনের জন্য ম্লান হয়ে গেল। আল্লাহ পবিত্র কোরআন সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করলেন-
أَمْ يَقُولُونَ تَقَوْلَهُ بَلْ لا يُؤْمِنُونَ - فَلْيَا تُوا بِحَدِيثِ مِثْلِهِ إِنْ كَانُوا صدقين
এরা কি এ কথা বলে যে, এই ব্যক্তি কোরআন নিজে রচনা করে নিয়েছে? প্রকৃত কথা হলো, এরা বিশ্বাস স্থাপন করতে চায় না। এরা যদি তাদের এই কথায় সত্যবাদী হয়ে থাকে, তাহলে তারা এমন মর্যাদাপূর্ণ একটি কালাম রচনা করে নিয়ে আসুক না। (সূরা আত্-তুর-৩৩-৩৪)
পবিত্র কোরআন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রচনা নয়-আল্লাহর চ্যালেঞ্জ শুধু এ ব্যাপারেই নয়, আল্লাহ তা'য়ালার চ্যালেঞ্জ হলো, আদৌ এ কিতাব মানব রচিত নয়। মানুষ যে জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও প্রতিভার অধিকারী, তা প্রয়োগ করে এ ধরনের মর্যাদাপূর্ণ একটি কিতাব প্রণয়ন করা আদৌ সম্ভব নয়। এ ধরনের একটি কালাম রচনা করা মানুষের শক্তি ও প্রতিভার সীমার বাইরের বিষয়। মহান আল্লাহর এই চ্যলেঞ্জ কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কোন দেশের জনগণের জন্যই শুধু নয়-নয় তা কালের গন্ডিতে আবদ্ধ। আল্লাহর চ্যালেঞ্জ সারা পৃথিবীবাসীর জন্য এবং অনন্ত কাল ব্যাপী।
এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো সাহস সেই অতীতকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্তও কেউ প্রদর্শন করেনি, অনাগত কালেও কেউ প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই চ্যালেঞ্জের প্রকৃত তাৎপর্য অনেক পন্ডিত ব্যক্তি অনুধাবন করতে অক্ষম হয়ে মন্তব্য করে থাকেন, 'বিষয়টি শুধুমাত্র কোরআনের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য গ্রন্থ প্রণেতা ও রচিয়তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একজন যে ভাব-ভাষা ও ভঙ্গী, শব্দ চয়ন করে গ্রন্থ প্রণয়ন করে থাকেন, তা আরেকজন পারবেন না। কারণ কাব্য ও সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিগণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকেন। তাদের একের বৈশিষ্ট্য আরেকজনের অনুরূপ হয় না। যেমন একজন খ্যাতিমান বক্তার অনুরূপ আরেকজন বক্তা বক্তৃতা করতে সক্ষম হন না, হ্রাস বৃদ্ধি হয়ে থাকে।'
আসলে এ ধরনের লোকজন আল্লাহর চ্যালেঞ্জের প্রকৃত তাৎপর্য ও স্বরূপ যথার্থভাবে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে বিভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হতে থাকে। এরা মনে করে, কোরআনে যেভাবে শব্দ চয়ন করা হয়েছে, যে ভাব প্রকাশ করা হয়েছে, যে ভঙ্গী অনুসরণ করা হয়েছে, বর্ণনার ক্ষেত্রে যে অলঙ্কার ব্যবহার করা হয়েছে, আল্লাহর চ্যালেঞ্জ বোধহয় এসব ক্ষেত্রেই করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর চ্যালেঞ্জের স্বরূপ হলো, পবিত্র কোরআন যে ধরনের সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চতর মু'জিযার অধিকারী গ্রন্থ, মান-মর্যাদার সুষমামন্ডিত উচ্চতর বৈশিষ্ট্য ও বিশাল মাহাত্মসম্পন্ন গ্রন্থ, অতুলনীয় শিক্ষাদর্শ প্রদানের ক্ষমতা সম্পন্ন গ্রন্থ, এমন ধরনের কোন গ্রন্থ রচনা করতে যদি সক্ষম হও, তাহলে সে ক্ষমতা প্রদর্শন করো। শুধুমাত্র আরবী ভাষাতেই নয়, সারা পৃথিবীর যে কোন ভাষায় কোরআনের সমকক্ষ মু'জিযা, বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বসম্পন্ন গ্রন্থ রচনা করতে যদি সক্ষম হও তাহলে তা করো। এটাই আল্লাহর চ্যালেঞ্জের প্রকৃত স্বরূপ।
মহান আল্লাহ যখন কোরআন অবতীর্ণ করেন, তখনও এ কোরআন একটি সর্বশ্রেষ্ঠ মু'জিযা ছিল, বর্তমান কালেও তা রয়েছে এবং অনন্ত কাল ধরেও তা অক্ষুন্ন থাকবে। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর কোরআন এক অতুলনীয় ও অনুপম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এক মহাগ্রন্থ। আল্লাহ তা'য়ালা এই কিতাবে যে ব্যাপক ও সর্বাত্মক জ্ঞান সন্নিবেশিত করেছেন, সে জ্ঞানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশও অতীত কালে যেমন কোন মনীষীর মধ্যে স্ফুরণ ঘটতে দেখা যায়নি, বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগেও দেখা যায় না, অনাগত কালেও দেখা যাবে না।
বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সমূহে কোন ব্যক্তি জ্ঞানের কোন একটি শাখায় পারদর্শিতা অর্জনের লক্ষ্যে গোটা জীবনকাল অতিবাহিত করার পরও জ্ঞানের সেই শাখার শেষ স্তর পর্যন্ত তার পক্ষে পৌঁছা সম্ভব হয় না। সেই ব্যক্তিই যখন তার আকাংখিত জ্ঞানের শাখায় বিচরণের লক্ষ্যে আল্লাহর কোরআনের প্রতি অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তখন সে দেখতে পায়-গোটা জীবনকাল সে যার অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিল, তার স্পষ্ট জবাব ও সমাধান এ কিতাবে রয়েছে।
এই বিষয়টি শুধুমাত্র পরিচিত-অপরিচিত, আবিষ্কৃত-অনাবিষ্কৃত জ্ঞানের বিশেষ কোন একটি শাখার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়-গোটা বিশ্বলোক ও সৃষ্টি জগৎসমূহ, গোটা প্রাণীজগৎ এবং উদ্ভিত জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রথম স্তর থেকে শেষ স্তর পর্যন্ত পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে। অথচ যে যুগকে বলা হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ, যে যুগে জ্ঞানের কোন একটি শাখাও বর্তমান কালের ন্যায় বিকশিত হয়নি, সেই সুর্যোত্তাপস্নাত মরুপ্রান্তরে মুর্খতার তিমিরাবৃত যুগে সম্পূর্ণ নিরক্ষর একজন ব্যক্তি কারো কোন সাহায্য ও গবেষণা ব্যতীত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত শাখা-প্রশাখায় অকল্পনীয় নির্ভুল ব্যাপক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতা অর্জন করলেন এবং প্রতিটি মৌলিক বিষয়ের নির্ভুল স্পষ্ট জবাব রচনা করেছিলেন, এ কথা কি কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই কোরআন নিজেকে আল্লাহর কালাম বলে দাবী করে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরবী ভাষায় পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। ভাষাবিদগণ বলেন, পৃথিবীর সমস্ত ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে আরবী ভাষা থেকে। অর্থাৎ সমস্ত ভাষার মা হলো আরবী, এই ভাষার গর্ভ থেকেই অন্যান্য সমস্ত ভাষা জন্ম গ্রহণ করেছে। এ কারণে পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার ভেতরেই আমরা দেখতে পাই, পরিবর্তিত রূপে বর্তমান সময় পর্যন্তও আরবী শব্দ বিদ্যমান রয়েছে।
এই আরবী ভাষার সর্বোন্নত এবং পূর্ণপরিণত যাবতীয় উচ্চাঙ্গের বৈশিষ্ট্যসহ সাহিত্য মানের চূড়ান্ত বাস্তব দৃষ্টান্ত হলো কিতাবুল্লাহ বা আল্লাহর কিতাব। পবিত্র কোরআনের ত্রিশ পারার মধ্যে কোথাও কোন একটি শব্দ অথবা কোন একটি ব্যাখ্যাও অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে না, যা নিম্নমানের হতে পারে। যে সূরায় বা যে আয়াতে যে বিষয়েই বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত শোভন, উপযুক্ততম শব্দ চয়ন এবং বাচনভঙ্গীতে পেশ করা হয়েছে।
কোরআনে একই বক্তব্যের পুনরুচ্চারিত করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই তা সম্পূর্ণ নতুন রূপে পরিবেশন করা হয়েছে এবং বলার ভঙ্গীতে অভিনবত্ব রয়েছে, ভিন্ন ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। এ কারণে কোথাও পুনরুচ্চারণের বা পুনরাবৃত্তির অশোভনতা অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে না। কোরআনের সূরা ফাতিহা থেকে সূরা নাছ পর্যন্ত শব্দ চয়ন ও সংযোজন এমনভাবে করা হয়েছে, যেন কোন অলঙ্কার শিল্পী তার সাধনালব্ধ কারিগরী কৌশল প্রয়োগ করে হীরক খন্ড একটার পরে আরেকটা সজ্জিত করে, এক অনুপম সৌন্দর্যময় আভা ফুটিয়ে তুলেছে। কোরআনের কথার অলঙ্কার ও বর্ণনাশৈলীর প্রভাব এতটা মাধুর্যমন্ডিত যে, ভাষাশিল্পীগণ তা শোনার পরে নিজের অজ্ঞাতেই শ্রদ্ধা নিবেদনে বিরত থাকতে পারে না।
আল্লাহর কোরআনের প্রতি যাদের হৃদয়ে অবিশ্বাস, সন্দেহ-সংশয় রয়েছে, এ ধরনের ব্যক্তির কানে কোরআন তেলওয়াতের শব্দ প্রবেশ করলে তারা আভিভূত হয়ে পড়েন। প্রায় দেড় হাজার বছর অতিবাহিত হতে চললো, আল্লাহর কোরআনে জীর্ণতার স্পর্শ ঘটেনি-কিয়ামত পর্যন্তও ঘটবে না এবং কোরআন তার নিজ ভাষায় সাহিত্যের এক অতুলনীয় উচ্চতর নিদর্শন হিসেবে পৃথিবীবাসীর সামনে স্বীয় মাহিমা প্রকাশ করে আসছে। এই কোরআনের সমকক্ষ হওয়ার দাবি করা তো অনেক দূরের ব্যাপার, আরবী ভাষায় রচিত কোন একটি গ্রন্থও আল্লাহর কিতাবের উচ্চতর সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য এবং তার মূল্যমানের প্রথম সীমা পর্যন্ত এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি, আল্লাহর কোরআন আরবী ভাষাকে এমন দৃঢ় ভিত্তি দান করেছে যে, কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্তও আরবী ভাষার বিশুদ্ধতা ও বিশিষ্টতার মান তাই অক্ষুন্ন রয়ে গিয়েছে, যা আল্লাহর কোরআন প্রথম থেকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল।
অথচ গত প্রায় দেড় হাজার বছরের ব্যবধানে পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাতেই পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন ভাষাই এতটা সুদীর্ঘকাল ব্যাপী শব্দ গঠন, উপমা প্রয়োগ, সংযোজন, রচনারীতি, বানান পদ্ধতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে তার আদি ও অকৃত্রিম রূপ-কাঠামোসহ টিকে থাকতে সক্ষম হয়নি। শুধুমাত্র কোরআনের মু'জিযা-অভ্যন্তরীণ অমিত দুর্জয় শক্তিই আরবী ভাষাকে তার সর্বোচ্চ মান ও বৈশিষ্ট্যের আসন থেকে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত করার প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেয়নি। যেসব কারণে কোরআন নিজেকে আল্লাহর বাণী বলে দাবী করে, উল্লেখিত কারণও তার ভেতরে একটি।
মহান আল্লাহ যে শব্দ, অক্ষর, বর্ণনাশৈলী, রচনারীতি, বাচনভঙ্গী সহযোগে যখন অবর্তীর্ণ করেছিলেন, বর্তমান কাল পর্যন্তও তার একটি অক্ষরও পরিত্যক্ত হয়নি-কিয়ামত পর্যন্তও হবে না। কোরআনের প্রতিটি বাকরীতি আরবী সাহিত্যে বর্তমান সময় পর্যন্তও অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। আল্লাহর কিতাবের সাহিত্য এখন পর্যন্তও আরবী ভাষায় সর্বোচ্চ মানের সাহিত্য হিসেবে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি লাভ করে আসছে এবং কোরআনে যে বিশুদ্ধতম ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, বর্ণনায়, রচনায়, লিখনে-ভাষণে এখন পর্যন্তও তাকেই ভাষার বিশুদ্ধ রীতি বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখা হয়েছে। পৃথিবীতে এ যাবৎ কাল পর্যন্ত বহু পন্ডিত ব্যক্তি তাদের স্ব-স্ব ভাষায় কালজয়ী সাহিত্য নির্মাণ করে আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। কিন্তু কোন একটি সাহিত্যই কি আল্লাহর কোরআনের উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের একটিকেও স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে? হয়নি এবং কখনো হবে না বলেই পবিত্র কোরআন নিজেকে আল্লাহর কিতাব বলে দাবী করে।
আল্লাহর এই কোরআন কোন এক নির্দিষ্ট দিনে একত্রে অবতীর্ণ হয়নি। প্রথমে প্রাথমিক পর্যায়ের হেদায়েত অবতীর্ণ করা হলো। তারপর সেই হেদায়েতের মাধ্যমেই একটি সংস্কারমূলক আন্দোলন ও ভবিষ্যতের গর্ভস্থ দিনগুলোর জন্য সর্বব্যাপী বিপ্লবের সূচনা করে দেয়া হলো। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে যে আন্দোলন পুনঃজাগরিত হলো, সে আন্দোলন দীর্ঘ তেইশ বছরে এসে সফলতা অর্জন করলো। দীর্ঘ তেইশ বছরে আন্দোলন যেসব চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে সম্মুখে সফলতার সোনালী দ্বার প্রান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, তার অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে কোরআনের বিভিন্ন অংশসমূহ ইসলামী আন্দোলনের আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত নেতা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ মোবারক থেকে কখনো নাতিদীর্ঘ ভাষণ কখনো বা সংক্ষিপ্ত ভাষণাকারে এ কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হচ্ছিলো। পরবর্তীতে আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন সফলতা অর্জনের পর্যায়ে কোরআনের বিভিন্ন অংশসমূহকে পরিপূর্ণ একটি গ্রন্থাকারে পৃথিবীবাসীর সামনে 'কোরআন' নামকরণ করে পেশ করা হয়েছে।
কোন ব্যক্তি যদি এই কোরআনকে রাসূলের স্বকপোলকল্পিত বলে দাবী করে, তাহলে তার এটা দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, সারা পৃথিবীর ইতিহাস একত্রিত করে তার ভেতর থেকে এমন একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যে, একজন মানুষ বছরের পর বছর ধরে একটি প্রবল পরাক্রান্ত শক্তির মোকাবেলা করে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কখনো উপদেশ দানকারী হিসেবে, কখনো নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে, কখনো একটি মজলুম জনগোষ্ঠীর মুক্তির অগ্রনায়ক হিসেবে, কখনো একটি বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে, কখনো আইন প্রণেতা ও আইনদাতা হিসেবে, কখনো একটি বিশাল সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর সিপাহসালার হিসেবে, কখনো বিজয়ী নেতা হিসেবে, কখনো আধ্যাত্মিক জগতে পৌছার পথপ্রদর্শক হিসেবে এবং সে আসনে আসীন হয়ে যে বক্তৃতা ও ভাষণ দান করেছেন, নানা উপলক্ষ্যে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তা একত্রে সংগ্রহ করে একটি পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ সুসংবদ্ধ বিপ্লবাত্মক সর্বব্যাপী চিন্তাদর্শ ও ব্যবহারিক জীবনে কর্ম বিধানে পরিণত করা হয়েছে এবং সে নিন্ধানে কোন ক্রম-বিরোধ, অসামঞ্জস্য বা বৈষম্যের স্পর্শ ঘটেনি, তার সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত একই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও চিন্তা-শৃংখলার ধারা বাস্তবায়িত হয়ে টিকে থাকতে দেখা গিয়েছে, তা মানব গোষ্ঠীর সামনে প্রদর্শন করা। এ ধরনের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা কারো পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি, অনাগত দিনেও সম্ভব হবে না বিধায় কোরআন নিজেকে আল্লাহর বাণী বলে দাবি করে।
কোরআন যাঁর ওপরে অবতীর্ণ হলো, সেই মহামানব বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম দিনই তাঁর মহান বিপ্লবী আন্দোলনের যে ভিত্তি স্থাপন করেছেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেই ভিত্তির ওপর অটল অবিচল থেকে চিন্তা-চেতনা, আকিদা-বিশ্বাস ও বাস্তব জীবনে কর্মের এমন একটি সর্বাত্মক ব্যবস্থা নির্মাণ করে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়েছেন, যার প্রতিটি স্তর অন্যান্য স্তরের সাথে পরিপূর্ণরূপে সামঞ্জস্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। রাসূলের পবিত্র জবান মোবারক থেকে কোরআন যে ভাষণাকারে প্রকাশিত হয়েছে, তা চিন্তাবিদ ও গবেষকগণ সত্যানুসন্ধিৎসু মন-মানসিকতা নিয়ে পাঠ করলে এ কথার স্বীকৃতি দানে বাধ্য হবেন যে, রাসূল যে আন্দোলনের সূচনা করলেন, তার শেষ স্তর পর্যন্ত পৌছাতে পথের কোন বাঁকে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে, কোন ধরনের পরিস্থিতিকে স্বাগত জানাতে হবে, তার পরিপূর্ণ একটি চিত্র রাসূলের দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট ছিল। আন্দোলনের যাত্রাপথে পথিমধ্যে রাসূলের মন-মস্তিষ্কে এমন কোন নতুন চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে, যা ইতিপূর্বে অনুপস্থিত ছিল অথবা থাকলেও সে চিন্তার পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে, এমন কোন বিহয় অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় না। এমন ধরনের বিস্ময়কর সৃজনশীল প্রতিভা প্রদর্শনকারী, অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী কোন ব্যক্তিত্ব সুদূর অতীতকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্তও পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করেনি, ভবিষ্যতের গর্ভে অপ্রকাশিত শতাব্দীসমূহেও কখনো পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না। যতগুলো কারণে কোরআন নিজেকে আল্লাহর বাণী বলে দাবী করে, এ কারণটিও তার মধ্যে অন্যতম।
আল্লাহর এই কোরআনে মহান আল্লাহ যে বিষয়বস্তু গ্রহণ করেছেন, তা যেমন সর্বব্যাপী বিপ্লবাত্মক তেমনি ব্যাপক ও বিশাল। এর আলোচিত বিষয়ের পরিধি অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত গোটা সৃষ্টিলোকে পরিব্যপ্ত এবং বিস্তৃত। সৃষ্টি জগতসমূহের অন্তর্নিহিত রহস্য, মহাসত্য, প্রকৃত তত্ত্ব; এর সূচনা ও সমাপ্তি, বিনাশ এবং সর্বশেষ পরিণতি; এর নিয়ম-শৃঙ্খলা, আইন-বিধান, পরিচালনা ইত্যাদির ব্যাপারে এ গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে। এই মহা-বিশাল সৃষ্টিলোকের স্রষ্টা, পরিচালনাকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী, লালন-পালনকারীর পরিচয় কি, তিনি কি ধরনের গুণাবলীর অধিকারী, এসব গুণাবলীর ধরন কি, তাঁর ক্ষমতার পরিধি কতটা ব্যাপক, কর্মের সীমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, কোন মহাসত্যের ভিত্তিতে এই বিশাল বিশ্বলোক তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে রয়েছে এবং পরিচালিত হচ্ছে, তা পবিত্র কোরআনে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই বিশ্বলোকে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষের সম্মান-মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে কোরআন সস্পষ্টরূপে ঘোষণা দিয়ে তা নির্ধারণ করে এ কথা জানিয়ে দিয়েছে যে, এটাই হলো মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও জন্মগত সম্মান-মর্যাদা। এতে সামান্যতম পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের যে সম্মান ও মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি রেখে মানুষের জন্য চিন্তা ও কর্মের অভ্রান্ত পথ ও জীবনাদর্শ কি হতে পারে, যা স্রষ্টার সৃষ্টিপদ্ধতির সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যশীল এবং মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের সাথে সাম স্যপূর্ণ, তা বিস্তারিতভাবে এই কোরআনে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর মানুষের জন্য অন্ধকার ও ধ্বংসের পথ কোনটি, যে পথ মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের সাথে সাংঘর্ষিক, মানুষের স্বভাব ও চিন্তা-চেতনার বিপরীত, সেটাও এই কোরআন সুস্পষ্টরূপে পার্থক্য নির্দেশ করেছে।
অভ্রান্ত পথ ও পদ্ধতি কেন অভ্রান্ত তা যেমন এ কোরআনে অখন্ডনীয় যুক্তির মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়েছে, তেমনি ভ্রান্ত পথ ও পদ্ধতি কেন ভ্রান্ত তা-ও নির্ভুল যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য পবিত্র কোরআন গোটা বিশ্বলোকের প্রতিটি জিনিস, সৃষ্টি জগতের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম দিক, বিশ্ব-ব্যবস্থার এক একটি স্তর, মানুষের দেহাভ্যন্তরের নানা দিক, তার সত্ত্বার অস্তিত্ব, মানুষের ইতিহাস থেকে অসংখ্য ও অগণিত বাস্তব প্রমাণ ও নিদর্শনাদি পৃথিবীর সামনে পেশ করেছে। সেই সাথে এ কথাও মানুষকে এ কোরআন অবগত করেছে যে, মানুষ কি কি কারণে, কোন আকর্ষণে, কিভাবে ভ্রান্ত পথের পথিক হয় এবং এর পরিণতি কি, আর যা চিরসত্য, অনন্তকাল উত্তীর্ণ মহাসত্য, তা কিভাবে অনাদীকাল পর্যন্ত অবিকৃত ও অভ্রান্ত থাকবে এবং এ বিষয়টি মানুষ কি করে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, তা মানুষকে এই কোরআন নির্ভুল পদ্ধতির দিকে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দান করেছে।
কোনটি ভ্রান্ত পথ আর কোনটি অভ্রান্ত পথ তা এই কোরআন মানুষকে অবগত করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই অভ্রান্ত পথের একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার অনুপম চিত্রও মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে। এই চিত্রে মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের যে বিভাগে যেখানে যা প্রয়োজন, তা অত্যন্ত সুসংবদ্ধ বিধি-ব্যবস্থা. ও মূলনীতিসমূহ অত্যন্ত বোধগম্য পদ্ধতিতে পেশ করেছে। সেই সাথে এ কথাও স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, অভ্রান্ত পথ অবলম্বন করলে এবং ভ্রান্ত পথ অনুসরণ করলে তার কি ফল ও পরিণতি এই পৃথিবীতে প্রকাশিত হবে, মানুষের চলমান জীবনে তার কি পরিণতি অনিবার্যভাবে দেখা দেবে, আখিরাতের জীবনেই বা কি ধরনের পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে, তা স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে।
মানুষের জীবন ও এই পৃথিবীর সমাপ্তি কিভাবে ঘটবে এবং দ্বিতীয় আরেকটি জীবন ও জগৎ কিভাবে আত্মপ্রকাশ করবে তা এই কোরআনে অঙ্কিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই পরিবর্তন কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় ঘটবে, তার প্রতিটি স্তরে কি ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হবে, এসবের প্রতিটি দিকের এক একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র কোরআন তার পাঠকের দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত করে তুলে দিয়ে ঘোষণা করেছে, এই পৃথিবীর পরবর্তী পৃষ্ঠায় মানুষ তার দ্বিতীয় জগতে কিভাবে অস্তিত্ব লাভ করবে; কোন প্রক্রিয়ায় মানুষ এই পৃথিবীতে করে যাওয়া যাবতীয় কর্মকান্ডের জবাবদিহি করবে; কোন ধরনের অনস্বীকার্য পরিস্থিতির ভেতরে তার কর্মের রেকর্ড তুলে দেয়া হবে; এই রেকর্ডের সত্যতা প্রমাণের জন্য কি ধরনের অখন্ডনীয় বলিষ্ঠ যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে; শাস্তি ও পুরস্কার কি ধরনের হবে, কেন শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে তা মানুষের সামনে এই কোরআন স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে আর এসব কারণেই কোরআন নিজেকে আল্লাহর কিতাব বলে দাবী করে। এ দাবীর প্রতি চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা না অতীতে কারো ছিল, বর্তমানেও কারো নেই এবং ভবিষ্যতেও কারো হবে না।
এই পৃথিবীতে আল কোরআনই হলো একমাত্র গ্রন্থ যা মানব জাতির সমুদয় চিন্তা-চেতনা, চরিত্র-নৈতিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি এক কথায় মানুষের জীবন-যাপন পদ্ধতির ওপর যে ব্যাপকতর, সুগভীর ও বিপ্লবাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে, এ ধরনের সর্বব্যাপক ও সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তারকারী গ্রন্থের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর একটিও নেই। প্রথম পর্যায়ে এই কোরআন পৃথিবীর একটি জাতির ওপরে প্রভাব বিস্তার করে তাদের জীবন ধারার আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। তারপর কোরআনের রঙে রঙিন সেই জাতি গোটা পৃথিবীর একটি বিরাট অংশের মানুষের জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং পৃথিবীর সমস্ত জাতির ওপরে কম-বেশী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এই কোরআন পৃথিবীতে যে বিপ্লবাত্মক ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে, তা পৃথিবীর কোন একটি আদর্শ বা কোন একটি গ্রন্থের পক্ষে পালন করা সম্ভব হয়নি। কোরআন শুধুমাত্র সজ্জিত অক্ষরের আকারে কাগজের পৃষ্ঠায় আবদ্ধ হয়ে থাকে না, বরং মানুষের বাস্তব কর্মের পৃথিবীতে এর এক একটি শব্দ, প্রভাব, শিক্ষা, চিন্তাদর্শ ও মতবাদের অনুপম রূপায়নে সম্পূর্ণ ভিন্নতর একটি সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্মাণ করে এক দৃষ্টান্তহীন কর্ম সম্পাদন করেছে এবং এখনো করছে। কোরআন যখন অবতীর্ণ হয়েছিল তখন তার যে প্রভাব ও বিপ্লবাত্মক ভূমিকা ছিল, আজও তা বিদ্যমান রয়েছে। সে যুগে কোরআনের শিক্ষা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে যে পাঠক পাঠ করতো, কোরআন তার পাঠককে সে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করতো, কোরআনের এই অতুলনীয় প্রভাব ও ক্ষমতা বর্তমানেও যেমন বিদ্যমান রয়েছে, অনাদিকাল পর্যন্তও বিদ্যমান থাকবে। কোরআন যে মহান আল্লাহর বাণী, এটাও তার একটি বড় প্রমাণ।
আল্লাহর এই কিতাব যাঁর ওপরে অবতীর্ণ হলো তিনি হলেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি • ওয়াসাল্লাম। তাঁর পবিত্র জবান মোবারক থেকেই কোরআন উচ্চারিত হচ্ছিলো। তিনি হঠাৎ করে আকাশ থেকে অবতরণ করেননি। তিনি সেই সমাজেই তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের সোনালী দিনগুলো অতিবাহিত করেছেন। তিনি এমনও ছিলেন না যে, হঠাৎ কোন অদৃশ্যলোক থেকে এসে কোরআন জনসমাজে শুনিয়ে পুনরায় অদৃশ্য হয়ে যেতেন। তিনি সর্বাত্মক বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা করার পূর্বেও যেমন মানব সমাজেই অবস্থান করেছিলেন, আন্দোলনের সূচনা করার পরও সেই সমাজেই উপস্থিত থাকতেন, আন্দোলন সফলতার সিংহদ্বারে উপনীত 'হবার সেই শুভ মুহূর্তেও মানব সমাজেই অবস্থান করছিলেন। তাঁর দৈনিন্দন জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অভ্যাস ও কথা বলার ধরনের সাথে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের সঙ্গী-সাথীগণ অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর সারা জীবনে বলা কথার সিংহ ভাগই বর্তমানেও হাদীস গ্রন্থসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে।
আল্লাহর বাণী হিসেবে তাঁর পবিত্র জবান থেকে যা মানুষ শুনতো এবং তাঁর নিজের কথাগুলোও মানুষ শুনতো। তাঁর সমভাষাভাষী লোকজন স্পষ্ট অনুভব করতে সক্ষম হতো যে, কোনটা আল্লাহর বাণী আর কোনটা তাঁর নিজের কথা। পরবর্তী কালের আরবী ভাষাবিদগণও কোনটি রাসূলের কথা আর কোনটি আল্লাহর বাণী, তার পার্থক্য রেখা স্পষ্টভাবে অঙ্কন করতে সক্ষম হতেন। রাসূলের দীর্ঘ হাদীসের মধ্যে কোথাও কোরআনের আয়াত ব্যবহৃত হলে, হাদীস আর কোরআনের বাকরীতিসহ অন্যান্য পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পার্থক্য এতটাই প্রকট যে, আরবী ভাষায় অভিজ্ঞ যে কোন ব্যক্তি কোরআনের আয়াত আর হাদীস শুনলেই অঙ্গুলি সংকেত করতে সক্ষম হন, কোনটি রাসূলের বাণী আর কোনটি আল্লাহর কালাম। এই বিরাট পার্থক্যের কারণে কোরআন অবিশ্বাসীদের কাছে কতকগুলো বড় প্রশ্ন করা যায় যে, একই ব্যক্তির পক্ষে কি সম্ভব, বছরের পর বছর ধরে দুটো ভিন্নতর ধারায় ও ভাষায় কথা বলা? একই ভাষার দুটো স্বতন্ত্র ধারা রপ্ত করে তা অভ্যাসে ও বাকরীতিতে পরিণত করা কি একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব?
কোরআন ও হাদীসের ভাষা যে একই ব্যক্তির, এ ধরনের দাবী করা কি বর্তমান সময় পর্যন্ত কারো পক্ষে সম্ভব হয়েছে? পৃথিবীর কোন ব্যক্তিই কি এ ধরনের অসম্ভব স্বাতন্ত্র রক্ষা করে প্রতিদিনের জীবন পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছে? একজন মানুষ সাময়িকভাবে এ ধরনের অভ্যাস রপ্ত করে কৃত্রিমতার অভিনয় কিছু দিনের জন্য চালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ তেইশ বছর ব্যাপী কারো পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সতর্কতার সাথে দুটো ধারা বজায় রাখা সম্ভব? একজন মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়া কালাম পাঠ করে শুনালে তার ভাষা-ভাব ও ভঙ্গী হবে ভিন্ন এক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আর তার নিজের কথা ও বক্তৃতার ভাষা-ভাব ও ভঙ্গী পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে এবং এই নীতিদীর্ঘ তেইশ বছর ধরে অবিকল অক্ষুন্ন থাকবে, এটা কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব হতে পারে? পারে না বলেই এই কিতাব আল্লাহর বাণী হওয়ার দাবী পেশ করে।
কোরআন আল্লাহর বাণী-এ কথার ওপরে পাহাড়ের মতোই অটল অবিচল থেকে রাসূল দাওয়াতী কাজ ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছেন এবং এ পথে অবর্ণনীয় সমস্যার মোকাবিলা তাঁকে করতে হয়েছে। কোরআনের প্রতি অবিশ্বাসীগণ তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছে, নির্যাতনের এমন কোন পদ্ধতি অবশিষ্ট ছিল না যা তাঁর ওপরে করা হয়নি। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তাঁর আন্দোলনের কর্মীগণ কষ্টার্জিত সহায়-সম্পদের মমতা বিসর্জন দিয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বছরের পর বছর তাঁকে ও তাঁর আন্দোলনের সাথীদেরকে অনাহারে থাকতে হয়েছে, বৃক্ষের পত্র-পল্লব ও শুকনো চামড়া খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবৃত্ত করতে হয়েছে। দরিদ্রতার কষাঘাতে নির্মমভাবে জর্জরিত হতে হয়েছে। প্রতিপক্ষ তাঁদের ওপরে এমন নির্যাতন করেছে যে, তাঁদের দেহের চর্বি-গোস্ত আগুনের তাপে গলে গলে পড়েছে। তাঁদের বুকের ওপরে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, বন্য পশুর পায়ের সাথে তাঁদেরকে বেঁধে দিয়ে সে পশুকে দৌড়াতে বাধ্য করা হয়েছে। তাঁদের গায়ের গোস্ত নির্মম কন্টকের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পথের ধুলোয় মিশেছে।
তাঁকে ও তাঁর সাথীদেরকে হত্যা করার পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছে প্রতিপক্ষ। লড়াই-সংগ্রাম হয়েছে তাঁদের প্রতি মুহূর্তের সাথী। সংগ্রামের ময়দানে কখনো তিনি ও তাঁর সাথীগণ বিজয়ী হয়েছেন, আবার কখনো প্রতিপক্ষ বিজয়ী হয়েছে। তাঁর প্রাণের শত্রু যখন পরাজিত হয়েছে, তখন তাঁর মহানুভবতা অবলোকন করে শত্রু তার মাথা সেই পবিত্র কদম মোবারকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছে। প্রথম থেকেই তিনি আল্লাহ প্রদত্ত মহাক্ষমাণর অধিকারী ছিলেন, আবার অতিরিক্ত ক্ষমতা হিসেবে তিনি বিশাল রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। জনপ্রিয়তার সর্বশীর্ষে, তিনি অবস্থান করছেন। একজন মানুষের জীবনে যখন এতগুলো অবস্থার সমাবেশ ঘটে, তখন সে মানুষের মন-মানসিকতা কখনো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই ধরনের থাকতে পারে না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত কঠিন ব্যক্তিত্বশালী লোকের মধ্যেও হৃদয়াবেগের ক্ষুরণ কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে ঘটে যায়। মানুষ হিসেবে আল্লাহর রাসূল যেসব কথা বলেছেন, সেসব কথা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁর ভেতরে কোথাও কোথাও হৃদয়াবেগের প্রতিফলন ঘটেছে। পক্ষান্তরে আল্লাহর কালাম হিসেবে যে কথাগুলো তাঁর জবান মোবারক থেকে মানুষ যা শুনেছে, তার মধ্যে মানবীয় হৃদয়াবেগের সামান্যতম চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতেও কোরআনের প্রতি অবিশ্বাসী গবেষকগণ আল্লাহর কিতাবে মানবীয় হৃদয়াবেগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
0 Comments