দিন-রাতের আবর্তন ও বিবর্তন

      
          আল্লাহর কোরআন ঘোষণা করছে-
         এদের জন্য রাত হচ্ছে আরেকটি নিদর্শন। আমি তার ওপর থেকে দিনকে সরিয়ে দেই তখন এদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায়। আর সূর্য, সে তার নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে ধেয়ে চলছে। এটি প্রবল পরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তার নিয়ন্তিত হিসাব। আর চাঁদ, তার জন্য আমি মনিন্বল নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, সেগুলো অতিক্রম করে সে শেষ পর্যন্ত আবার খেজুরের শূকনো শাখার মতো হয়ে যায়। না সূর্যের ক্ষমতা রয়েছে চাঁদকে অতিক্রম করে এবং রাতের ক্ষমতা রয়েছে দিনকে অতিক্রম করতে পারে, এসব কিছুই একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে সন্তরণ করছে। (সূরা ইয়াছিন-৩৭-৪০)

        পৃথিবীর সামনে থেকে সূর্যের সরে না যাওয়া পর্যন্ত কখনো দিবাবসান ও রাতের আগমন ঘটতে পারে না। দিবাবসান ও রাতের আগমনের মধ্যে যে চরম নিয়মানুবর্তিতা পাওয়া যায় তা সূর্য ও পৃথিবীকে একই অপরিবর্তনশীল বিধানের আওতায় আবদ্ধ না রেখে সম্ভবপর ছিল না। তারপর এ রাত ও দিনের আসা-যাওয়ার যে গভীর সম্পর্ক পৃথিবীর সৃষ্ট প্রাণীকুলের সাথে পরিলক্ষিত হয়.তা স্পষ্টভাবে এ কথাই প্রমাণ করে যে, চরম বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা সহকারে কোন বিজ্ঞ স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির কল্যাণের লক্ষ্যে অনুগ্রহ করে এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই পৃথিবী পৃষ্ঠে মানুষ, প্রাণীকুল ও উদ্ভিদ জগতের অস্তিত্ব, পানি ও বাতাসের অস্তিত্ব এবং নানা ধরনের খনিজ সম্পদের অস্তিত্বও প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীকে সূর্য থেকে একটি বিশেষ দূরত্বে অবস্থান করানোর এবং তারপর পৃথিবীর নানা অংশের একটি ধারাবাহিকতা সহকারে নির্ধারিত বিরতির পর সূর্যের সামনে আসার এবং তার সামনে থেকে সরে যেতে থাকার ফসল।

        যদি পৃথিবীর দূরত্ব সূর্য থেকে একটু কম বা বেশী হতো অথবা তার এক অংশে প্রতি মুহূর্তে ব্রাত ও অন্য অংশে দিন অবস্থান করতো অথবা দিন-রাতের পরিবর্তন অত্যন্ত দ্রুত বা খুবই কম গতিসম্পন্ন হতো অথবা নিয়ম অনুসারে না ঘটে হঠাৎ কখনো দিন বা রাতের আগমন ঘটতো, তাহলে পৃথিবী কোন প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত হতো না। শুধু তাই নয় বরং এ অবস্থা যদি হতো তাহলে পৃথিবীর নিষ্প্রাণ জড় পদার্থসমূহের বর্তমান আকৃতি থেকে ভিন্ন আকৃতির হতো।

        এসব দেখে কোন মানুষ যদি একেবারে মূর্খ না হয় এবং অন্তরের চোখ বন্ধ করে না রাখে, তাহলে সে মানুষ এসব বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার মধ্যে এমন এক আল্লাহর কর্মতৎপরতা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবে, যিনি এই পৃথিবীর বুকে এই বিশেষ ধরনের সৃষ্ট প্রাণী জগতকে অস্তিত্ব দান করার ইচ্ছে করেন এবং সৃষ্টির যথাযথ প্রয়োজন অনুসারে পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন স্থাপন করেন। মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ব তথা তাওহীদ যারা মানতে অস্বীকার করে তারা এ কথা বলুক যে, সৃষ্টিজগতের এই বৈজ্ঞানিক পন্থাসমূহ কয়েকজন স্রষ্টার সাথে সংশ্লিষ্ট করা অথবা কোন অন্ধ ও বধির প্রাকৃতিক আইনের আওতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কিছু সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা কতটা মূর্খতার পরিচয় বহন করে?

        রাত ও দিনের নিয়মতান্ত্রিকভাবে আগমনের অর্থ পৃথিবী ও সূর্যের ওপর একই আল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে, এখানে অন্য কারো আধিপত্য বিস্তারের সামান্যতম সুযোগ নেই। রাত আর দিনের ঘুরে ফিরে আসা এবং পৃথিবীর স্যার সমস্ত সৃষ্টির জন্য তা উপকারী হওয়া এ বিষয়ের স্পষ্ট প্রমাণ যে, একমাত্র আল্লাহই এসব জিমিলের স্রষ্টা এবং নিয়ন্ত্রক। তিনি তাঁর চূড়ান্ত পর্যায়ের জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করে এমনভাবে এই ব্যবস্থা চালু করেছেন যেন তাঁর সৃষ্টির জন্য সমস্ত কিছুই ফল্যাণকর হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন

اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الَّيْلَ لِتَسْكُنُوا فِيْهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ اللَّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ

        আল্লাহই তো সেই মহান সত্তা যিনি তোমাদের জন্য রাত সৃষ্টি করেছেন যাঁতে তোমরা রাতের পরিবেশে' আরাম করতে পারো। আর দিনকে আলোকিত করেছেন। সত্য এই যে, আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত অনুকম্পাশীল। তবে অধিকাংশ লোক শুকরিয়া আদায় করে না। (সূরা আল মু'মিন-৬১)

        ভূগোল সম্পর্কে যাদের সাধারণ জ্ঞান রয়েছে তারাও এ কথা জানে যে, পৃথিবী নামক এই গ্রহের দুটো গতি রয়েছে এবং তার একটি নাম হলো আহ্নিক গতি ও অপরটির নাম হলো বার্ষিক গতি। বিজ্ঞানীগণ বলছেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে আমাদের এই পৃথিবী ৩৬৫ দিনে একবার ঘুরে আসে। আহ্নিক গতির কারণে পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ঘুরছে এবং এ কারণে দিন রাতের আবর্তন ও বিবর্তন হচ্ছে। এই কক্ষগতির সাথে অক্ষগতির একটা সুসামঞ্জস্য রয়েছে বলেই দিন, রাত ও ঋতুর আবর্তন হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে অক্ষগতির সঠিক কারণ কি এবং তার উৎস কোথায় ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান শুধুমাত্র অনুমানলব্ধ। সম্প্রসারণশীল এই মহাবিশ্বের শাসনে বার্ষিক গতির পাশাপাশি দিন রাত আবর্তনকারী এই আহ্নিক গতি একটি মহাবিস্ময়কর বিষয়।

মহাকাশে চাঁদ-সূর্যের দূরত্ব

        এই পৃথিবী যদি চাঁদের সমান হতো অথবা তার নিজস্ব ব্যাসের এক চতুর্থাংশ হতো, তাহলে তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বর্তমানে যতটা রয়েছে তার এক ষষ্ঠাংশ হতো। এই ষষ্ঠাংশ শক্তি সম্পন্ন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কখনো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলীয় পানিকে ধরে রাখতে সমর্থ হতো না। এই পৃথিবীতে মওজুদ সমস্ত পানির ভান্ডার দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যেতো। বাতাসের জলীয় বাষ্পমাত্রা বায়ুমন্ডলীয় বলয় থেকে বিমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবী হারিয়ে ফেলতো তার তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা কল্পনাতীতভাবে বৃদ্ধি লাভ করতো ফলে এখানে জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যেত না। সূর্যের প্রাণঘাতী অবলোহিত রশ্মি (Infrared Ray) প্রত্যক্ষভাবে পৃথিবীতে পৌঁছে সমস্ত কিছু মুহূর্তে চিরকালের জন্য ভস্মীভূত করে দিতো। পৃথিবী হারিয়ে ফেলতো তার জীবন সংক্ষরণ ক্ষমতা। বর্তমান ব্যাসের দ্বিগুণ হলে বর্ধিত পৃথিবীর উপরিভাগের পরিমাণ বর্তমান ভূ-পৃষ্ঠের চারগুণ হতো।

        এমন একটি অবস্থায় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল বৃদ্ধি লাভ করতো বর্তমানের দ্বিগুণ যা প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে সৃষ্টি করতো ৩০ পাউন্ড চাপ। মারাত্মকভাবে কমে যেত বায়ুমন্ডলের স্তরগত উচ্চতাসমূহ। এই উচ্চতা কমে যাওয়ার ফলে অনিবার্য ধ্বংসের ভয়াবহ বিভীষিকা নেমে আসতো এই পৃথিবীতে। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুসারে প্রতিদিন প্রায় ২০ লক্ষ উল্কা এই পৃথিবী পৃষ্ঠের দিকে তীব্র গতিতে ছুটে আসে। আমরা অনুভবও করতে পারিনা, আল্লাহ ঊর্ধ্ব জগতে যে বায়ুমন্ডল সৃষ্টি করেছেন, তার পুরুত্ব ও ব্যাপ্তি দিয়ে পৃথিবীর প্রাণীকুল ও অন্যান্য বস্তুকে ধ্বংসকারী উল্কাপতন থেকে হেফাজত করে যাচ্ছে। পৃথিবীর আকারের বৃদ্ধি যদি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে বর্ধিত করে দিত, তাহলে নীচে নেমে আসতো বায়ুমন্ডলের এই অদৃশ্য প্রতিরোধী ব্যবস্থার বিস্তার। পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌছার পূর্বে বায়ুমন্ডলীয় ঘর্ষণে ভস্মীভূত না হয়ে উল্কাসমূহ প্রত্যক্ষভাবে পৃথিবীতে আঘাত হানার পথ সুগম হয়ে পড়তো। ফলে মুহূর্তে সমস্ত প্রাণী মুহূর্তে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হতো।

        এই পৃথিবী বর্তমানে সূর্য থেকে যে দূরত্বে অবস্থান করছে, এর থেকে যদি দ্বিগুণ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া হতো তাহলে পৃথিবী বর্তমানে সূর্যের কাছ থেকে যে পরিমাণ উত্তাপ লাভ করছে, তখন লাভ করতো মাত্র এক চতুর্থাংশ। এই দূরত্বের কারণে বার্ষিক গতির মাত্রা হতো বর্তমানের অর্ধেক কিন্তু অক্ষ পরিধির পরিমাপ হতো বর্তমানের দ্বিগুণ। ফলে একটি বছরের পরিমাপ হতো চারটি বছরের সমান। এতে যে ফলাফল হতো তাহলো দুরত্ব জনিত কারণে তাপমাত্রার এক মারাত্মক হ্রাসপ্রাপ্তি যা বর্তমানের এক চতুর্থাংশ অথবা তারও কম মাত্রায় পৌঁছে যেতো। শীত মৌসুমের ব্যাপ্তি বর্তমানের চারগুণ দীর্ঘতর হয়ে যেতো ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠের সমস্ত প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদ জগৎ জমাট বদ্ধ হয়ে চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। এমনকি প্রচন্ড খরা মৌসুমে কোন একটি তরুলতাও প্রয়োজনের সময় এক বিন্দু মুক্ত পানি লাভ করতে সক্ষম হতো না। আবার পৃথিবীর সৌর দুরত্ব বর্তমান দূরত্বেয় অর্ধেক হলে কক্ষপথের পরিধি নেমে আসতো অর্ধেকে কিন্তু গতিবেগ হতো দ্বিগুণ। যার ফলে বর্তমানের একটি সৌর বছর হতো মাত্র ৩ মাস দীর্ঘ। এমন অবস্থায় সূর্য থেকে আগত তাপের পরিমাণ হতো বর্তমানের চেয়ে চারগুণ অধিক। ফলে এই পৃথিবীতে কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতো না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনুগ্রহ করে রাত ও দিনের আবর্তনের মাধ্যমে এসব কল্যাণ তাঁর সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। এসবের পেছনে স্রষ্টা যদি একজন না হয়ে অধিক হতো, তাহলে আবহমান কাল থেকে একই নিয়মে এসব চলতো না, ব্যতিক্রম অবশ্যই হতো।

Post a Comment

0 Comments