যাকাতের হকদার কারা কারা

        প্রকাশ থাকে যে, এমন ব্যক্তি যাকাতের হকদার, যে মুসলমান, স্বাধীন (হাশেমী ও মুত্তালেবী বংশীয় নয়) এবং যার মধ্যে কোরআন বর্ণিত আটটি গুণের মধ্য থেকে কোন একটি গুণ বিদ্যমান আছে। এই আটটি গুণ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। কাফের, গোলাম ও হাশেমী বংশীয়কে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। নিম্নে আট প্রকার লোক আলাদা আলাদা বর্ণিত হচ্ছে।

        প্রথম প্রকার- ফকীর। যার কাছে অর্থ-সম্পদ নেই এবং যে উপার্জনক্ষম নয়, তাকে ফকীর বলা হয়। যার কাছে একদিনের খাদ্য ও পোশাক আছে, সে ফকীর নয়; বরং মিসকীন। অর্ধেক দিনের খাদ্য থাকলে সে ফকীর। সওয়াল করা যেব্যক্তির অভ্যাস সে ফকীর দলের বাইরে নয়। কেননা, সওয়াল করা কোন উপার্জনের পেশা নয়। হাঁ, উপার্জন করতে সক্ষম হলে সে ফকীরদের দল থেকে খারিজ হয়ে যাবে। যন্ত্রপাতি দিয়ে উপার্জন করতে সক্ষম ব্যক্তিও ফকীর, তাকে যাকাতের টাকা দিয়ে যন্ত্রপাতি কিনে দেয়া জায়েয। যদি কেউ এমন পেশা অবলম্বনে করতে সক্ষম না হয়, যা তার ভদ্রতা ও মর্যাদার অনুপযোগী, তবে সে ফকীর বলেই গণ্য হবে। এমনিভাবে আলেম ব্যক্তির যদি কোন পেশা গ্রহণ এলেম চর্চায় বাধ্য সৃষ্টি করে, তবে সে-ও ফকীর। পেশা গ্রহণ করো এবাদতে বাধা সৃষ্টি করলেও তা করা উচিত। কেননা, খয়রাতের তুলনায় কাজ করা উত্তম। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন  হালাল জীবিকা অন্বেষণ ঈমানী ফরযের পরের ফরয। উদ্দেশ্য, উপার্জনের চেষ্টা করা দরকার। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন: হালাল-হারামের সন্দিগ্ধ উপার্জন সওয়াল অপেক্ষা উত্তম।

        দ্বিতীয় প্রকার- মিসকীন। যার আয় ব্যয়ের জন্যে যথেষ্ট নয়, তাকে মিসকীন বলা হয়। অতএব কেউ হাজার দেরহামের মালিক হয়েও মিসকীন হতে পারে। পক্ষান্তরে একটি কুড়াল ও রশির মালিক হয়েও মিসকীন না হতে পারে। মাথা গোঁজার মত গৃহ ও অবস্থানুযায়ী পোশাক পরিচ্ছদ থাকলেই মানুষ মিসকীনদের দল থেকে খারিজ হয়ে যাবে না। এমনিভাবে ঘরকন্নার প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও মানুষকে মিসকীনদের দল থেকে খারিজ করে দেয় না। ফেকাহ্ শাস্ত্রের কিতাবসমূহের মালিকানাও মিসকিনীর পরিপন্থী নয়। কিতাব ব্যতীত অন্য কোন কিছুর মালিক না হলে তার উপর সদকায়ে ফেতর ওয়াজেব নয়। কিতাবপত্র এবং পোশাক পরিচ্ছদও গৃহের জরুরী আসবাবপত্রের অনুরূপ। তবে কিতাবের প্রয়োজন বুঝার ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত। তিনটি উদ্দেশে কিতাবের প্রয়োজন হয়, পড়া, পড়ানো ও অধ্যয়ন করা। চিত্তবিনোদন কোন প্রয়োজন নয়। উদাহরণতঃ কবিতা, ইতিহাস, সংবাদপত্র এবং দুনিয়া ও আখেরাতে উপকারী নয় এমন কিতাব সংগ্রহ এক্ষেত্রে ধর্তব্য নয়। এ ধরনের কিতাব মিসকিনীর পরিপন্থী। বেতনভুক্ত শিক্ষক যেসকল কিতাবের সাহায্যে পাঠদান করে, সেগুলো তার জন্যে দর্জি প্রমুখ পেশাদার ব্যক্তিদের যন্ত্রপাতির অনুরূপ। এগুলো থাকলেও কেউ মিসকীন হতে পারে।

        তৃতীয় প্রকার- আমেল (কর্মচারী)। বিচারক ও শাসনকর্তা ছাড়া যারা যাকাত আদায় করে, তারা এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। দলপতি, হিসাব রক্ষক, ক্যাশিয়ার, নকল নবীশ প্রমুখ কর্মচারীও এর মধ্যে দাখিল। তাদের কাউকে এ কাজের সাধারণ মজুরির চেয়ে বেশী দেয়া যাবে না।

        চতুর্থ প্রকার- তারা, যাদেরকে মন জয় করার উদ্দেশে যাকাতের অর্থ দেয়া হয়। তারা আপন আপন গোত্রের সর্দার হয়ে থাকে। তাদেরকে দেয়ার উদ্দেশ্য তাদেরকে ইসলামের উপর কায়েম রাখা এবং তাদের অধীনস্থদেরকে উৎসাহ প্রদান করা।

        পঞ্চম প্রকার- মুকাতাব। যে গোলামকে তার প্রভু কিছু অর্থের বিনিময়ে মুক্ত করতে বলে, তাকে মুকাতাব বলা হয়। মুকাতাবের অংশ তার প্রভুকে দেয়া উচিত। স্বয়ং মুকাতাবকে দেয়াও জায়েয। প্রভু তার মালের যাকাত মুকাতাবকে দেবে না। কেননা, সে এখনও তার গোলাম।

        ষষ্ঠ প্রকার- ঋণী ব্যক্তি। যারা বৈধ কাজে ঋণ গ্রহণ করে, অতঃপর দারিদ্র্যের কারণে শোধ করতে পারে না; তারা এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। গোনাহের কাজে ঋণ গ্রহণ করে থাকলে যে পর্যন্ত তওবা না করে তাকে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে না। ধনী ব্যক্তির যিম্মায় ঋণ থাকলে যাকাতের অর্থ দ্বারা তা শোধ করা যাবে না। তবে সে কোন জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকলে তা শোধ করতে অসুবিধা নেই।

        সপ্তম প্রকার- গাজী। সরকারী ভাতাভুকদের রেজিস্টারে যার কোন ভাতা নেই; তাকে যাকাতের একটি অংশ দেয়া উচিত- যদিও সে ধনী হয়। এতে জেহাদে সাহায্য করা হবে।

        অষ্টম প্রকার- মুসাফির। যেব্যক্তি সফরের উদ্দেশে আপন শহর থেকে রওয়ানা হয়, সে মুসাফির। সফর গোনাহের উদ্দেশে না হলে এবং মুসাফির ব্যক্তি নিঃস্ব হলে তাকে যাকাত দিতে হবে। তার স্বগৃহে ধন সম্পদ থাকলে তাকে এতটুকু দিতে হবে, যদ্দ্বারা সে গৃহে পৌঁছতে পারে।

        এখন প্রশ্ন, উপরোক্ত আট প্রকার হকদার ব্যক্তিকে কিরূপে চেনা যাবে? জওয়াব, ফকীর ও মিসকীনের বেলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উক্তিই যথেষ্ট হবে। এ জন্যে সাক্ষ্য ও কসম নিতে হবে না। আমি ফকীর- কেউ একথা বললেই তাকে যাকাত দেয়া যাবে, যদি সে মিথ্যাবাদী বলে দৃঢ় বিশ্বাস না হয়। জেহাদ ও সফর ভবিষ্যতের ব্যাপার। যদি কেউ বলে, সে সফর অথবা জেহাদের ইচ্ছা রাখে, তবে তাকে দেয়া জায়েয। যদি কেউ পরবর্তীতে এই ইচ্ছা পূর্ণ না করে, তবে যা দেয়া হয়, তা ফেরত নিতে হবে। অবশিষ্ট চার প্রকার হকদারকে চেনার জন্যে সাক্ষী অত্যাবশ্যক। এ পর্যন্ত হকদার হওয়ার শর্ত ও কারণসমূহ বর্ণিত হল।

Post a Comment

0 Comments