৬৩৮ সালের ঘটনা। জেরুযালেম মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে এলো। খলীফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু একটি সাদা উটের পৃষ্ঠে আরোহণ করে জেরুযালেম নগরীতে প্রবেশ করলেন। বিশাল মুসলিম জাহানের খলীফা- কিন্তু তাঁর চেহারা বা পোষাক দেখে কেউ বুঝতে পারবে না যে, তিনিই দোর্দন্ড প্রতাপশালী খলীফা ওমর। তাঁকে যে বিজয়ী সেনাবাহিনী অনুসরণ করছে, তাঁদের চেহারা বা পোষাক দেখেও বুঝা যাচ্ছে না, এরাই সেই অমিত তেজী বীর তাওহীদের অতন্দ্র প্রহরী মহান আল্লাহর সৈনিক।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যখন জেরুযালেম নগরীতে প্রবেশ করছিলেন, তখন তাঁর পাশে ছিলো পরাজিত ও আত্মসমর্পণকারী খৃষ্টবাহিনীর প্রধান জেরুযালেম নগরীর শাসক ও সর্বোচ্চ ধর্মযাজক সফ্রোনিয়াস। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু জেরুযালেম নগরীতে প্রবেশ করেই গেলেন মজজিদুল আকসায়- যেখানে হযরত সুলাইমান আলাইহিস্ সালাম নামায আদায় করতেন'।
এসব স্থান পরিদর্শন শেষে হযরত ওমর ভ্রমন করতে চাইলেন খৃষ্টানদের গির্জাসমূহ। তাঁর উদ্দেশ্যে ছিলো, খৃষ্টানদের এসব গির্জা যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিনা তা দেখা। মহান আল্লাহর রহমত- ইসলামের শিক্ষা অনুসারে মুসলিম বাহিনী কোনো একটি দেশও বিজয় করার পর সেদেশের অমুসলিম নাগরিক বা তাদের ধর্মীয় স্থানসমূহের সামান্যতম ক্ষতি হতেও দেয়নি।
খৃষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মযাজক খলীফাকে নিয়ে গেলেন হোলি সেপালকারের গির্জায়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু খৃষ্টানদের প্রধান গির্জা পরিদর্শন করছেন, এমন সময় নামাযের সময় হলো। তিনি নামায আদায় করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই খৃষ্টানদের ধর্ম যাজক আবেদন করলে, তিনি যেন এই গির্জাতেই নামায আদায় করেন। ধর্ম যাজকের প্রস্তাবে মুসলিম জাহানের খলীফা মৃদু হেসে গির্জা থেকে বের হয়ে অন্যত্র নামায আদায় করলেন।
মুসলিম জাহানের একচ্ছত্র খলীফা- জেরুযালেম নগরীও মুসলমানদের দখলে। তিনি যেখানে খুশী সেখানেই নামায আদায় করতে পারতেন। কিন্তু মুসলমানদের খলীফা তা করলেন না। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো, কেন তিনি গির্জায় নামায আদায় করলেন না। জবাবে তিনি বললেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হয়ে এবং মুসলমনাদের খলীফা হিসেবে তিনি যদি গির্জায় নামায আদায় করতেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ মুসলমানরা দৃষ্টান্ত হিসেবে এটা উল্লেখ করে বলতো, গির্জা দখল করে নামায আদায় করা যাবে এবং মুসলমানদের অনেকে গির্জা দখল করে মসজিদ বানাতো।
প্রথম ক্রুসেডের কথা
১০৯৯ সালের ৭ই জুন।
চাঁদ-তারা খচিত ইসলামী পতাকার তখন দুর্দিন, আর সুদিন ক্রস চিহ্নিত খৃষ্টান সম্পদ্রায়ের পতাকার। মুসলিম শাসিত জেরুযালেম নগরীকে বেষ্টন করে আছে খৃষ্টান সেনাবাহিনী। দুপুরের দিকে খৃষ্টান সৈন্যরা নগরীর বাইরের একটি স্তম্ভ থেকে নগরীর দেয়াল পর্যন্ত নির্মাণ করলো একটি সেতু। মুসলমানরা অনুভব করলো তাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে। পালাতে লাগল তারা হারাম শরীফের দিকে যেখানে শেষ প্রতিরোধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য রয়েছে 'প্রস্তুত-গুম্বজ' (Dome of the Rock) ও মসজিদুল আকসা। কিন্তু মুসলমানরা সেগুলোকে প্রতিরোধের উপযোগী করে তোলার সময় পেলনা। বাধ্য হয়ে তাঁরা আত্মসমর্পণ করলো খৃষ্টান সেনাবাহিনীর কাছে।
এবার বিজিতের উপর বিজয়ীর আচরণ। খৃষ্টান সৈন্যরা অপবিত্র করে ধ্বংস করে দিল সেই 'প্রস্তর-গুম্বজ'। বিজয়ী মদমত্ত খৃষ্টান ধর্মযোদ্ধাগণ ছুটে গেলো মুসলমানদের ঘরে ঘরে, প্রত্যেক মসজিদে এবং মুসলমানদের ব্যবসা কেন্দ্রে। নির্মমভাবে হত্যা করলো মুসলিম নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সকলকে। কারো পক্ষেই পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হলো না। কারণ সারা নগরী খৃষ্টান বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ। হত্যাযজ্ঞ চললো সারা দিন ও রাত ব্যাপী।.
পরের দিন ভোরে একদল খৃষ্টান ধর্মযোদ্ধা শক্তির বলে প্রবেশ করলো মসজিদুল আকসায়। হত্যা করলো সেখানের প্রত্যেক মুসলিমকে এবং ধ্বংস করে দিল সেই পবিত্র মুসলমানদের পবিত্র স্থানসমূহ। এরপর খৃষ্টান সেনানায়কগণ গেলেন মুসলমানদের মসজিদ ও অন্যান্য এলাকা পরিদর্শনে। তাদের যাবার কোনো পথ ছিলো না, সর্বত্র মুসলমানদের লাশ আর লাশ। মুসলমানদের লাশ সরিয়ে তাদের জন্য পথ পরিষ্কার করা হয়েছিলো। তবুও তাদের ঘোগাগুলোর পা হাঁটু পর্যন্ত মুসলমানদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিলো। এভাবেই সেদিন খৃষ্টান প্রধানগণ মুসলমানদের লাশ আর রক্ত মাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছিলো।
খৃষ্টানরা কোনোদিনই মুসলমানদের সামান্যতম অধিকার সহ্য করেনি, আজও করছে না। সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নত করে যেসব মুসলিমকে গ্রেফতরা করার পর স্বদম্ভে তারা ঘোষণা করছে, 'এসব সন্ত্রাসীর জন্য মানবাধিকারের কোনো বিধান প্রযোজ্য নয়।' তাদের এই আচরণ নতুন কিছু নয়। সেদিন জেরুযালেম নগরী দখল করে মুসলিমদের সাথে যে আচরণ করেছিলো, আজও মুসলমানদের সাথে তারা সেই একই আচরণ করছে।
এরপর খৃষ্টবাহিনী জেরুযালেমের ইয়াহুদীদের বসতি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থানসমূহে ছুটে গেলো। তাদের বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ উত্থাপন করলো, 'তোমরা মুসলমানদের সমর্থন করেছো।' এই অভিযোগে ইয়াহুদীদেরকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। অগনিত ইয়াহুদীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করলো। তাদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থানসমূহ ধ্বংস করে দিলো খৃষ্টবাহিনী।
মুসলমানদের আত্মসমর্পণের সমস্ত শর্ত ভঙ্গ করে খৃষ্টানরা হত্যা করেছিল মুসলমানদেরকে ও ধ্বংস করেছিল তাদের মসজিদসমূহ। এই নির্মম ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ফলে জেরুযালেম হয়ে গেল মুসলমান ও ইয়াহুদী শূন্য। হত্যা করার জন্য কোন মুসলমান এবং ইয়াহুদী যখন আর অবশিষ্ট রইলো না, তখন খৃষ্টান পাদরী ও ধর্মযোদ্ধারা ভাবগম্ভীর পরিবেশে এক ধর্মীয় মিছিলের আয়োজন করলো। মুসলমানদের লাশ আর রক্ত মাড়িয়ে সেই মিছিল অগ্রসর হলো খৃষ্টানদের হোলি সেপালকার গির্জায় 'গড'-এর কাছে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য। এভাবে করে খৃষ্টানরা 'সেদিন থ্যাঙ্কস গিভিং ডে পালন করেছিলো।
0 Comments