অঙ্গীকার পূরণ, নবী করীম (সা:) এর সীরাত

 


         কিলাব গোত্রের নেতা আবু বারা (রা:) দরবারে নববীতে এসে আবেদন করেছিল, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আমাদের সাথে কিছু লোক দিন, যারা আমাদের গোত্রে গিয়ে ইসলামের শিক্ষা দিবে'।

        নবী করীম (সা:) তাকে বলেছিলেন, 'আমি নজদবাসীর দিক থেকে আশঙ্কা বোধ করি। তাদের গোত্র তো কুরাইশদের শুভাকাঙ্খী'।

        আবু বারা (রা:) বলেছিল, 'আমরাই সেখানে প্রভাবশালী, আমরা যা বলবো তাই হবে। আমি তাদের জিম্মাদার হচ্ছি'।

        আবু বারার আবেদনে সাড়া দিয়ে নবী করীম (সা:) ৭০ জন সাহাবীকে তাদের সাথে প্রেরণ করেছিলেন। এ সকল সাহাবী ছিলেন আসহাফে সুফফার দলভুক্ত। সংসার জীবন গঠন করার মতো তখন পর্যন্ত তাদের সুযোগ হয়নি। তাদের নৈতিক চরিত্র ছিল অতি উচ্চস্তরের। এই সাহাবায়ে কেরাম সারা দিন জঙ্গলে কাঠ কেটে তা বিক্রি করে যা উপার্জন করতেন তা অন্য সাহাবায়ে কেরামের জন্য ব্যয় করতেন এবং নিজের কাজে ব্যয় করতেন। এই লোকগুলো দিবারাত্রি নবী করীম (সা:) এর সাহচর্যে অবস্থান করে ইসলামী জ্ঞান এবং আল্লাহ তা'য়ালার নৈকট্যর দিক থেকে অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী ছিলেন।

        বনী আমের গোত্রের কাছে নবী করীম (সা:) একটি পত্রও প্রেরণ করলেন। বীরে মাওনা নামক স্থানে পৌঁছার পরে উক্ত পত্রসহ একজন লোক বনী আমের গোত্রের নেতা আমের ইবনে তুফায়েলের কাছে গিয়েছিলো। তুফায়েল প্রচলিত সকল নীতি নৈতিকতার প্রতি পদাঘাত করে মুসলিম দূতকে হত্যা করলো এবং বনী সালেম গোত্রের সহযোগীতায় মুসলিম প্রচারকের দলকে হত্যা করার জন্য এগিয়ে এলো। যে সাহাবা রাসূল (সা:) এর কাছে মুসলমানদের জিম্মাদার হয়ে তাদেরকে এনেছিল, সেই আবু বারা (রা:) বনী আমের গোত্রের নেতা তুফায়েলকে বারবার অনুরোধ করলো, মুসলমানদেরকে হত্যা না করার জন্য। সে তাদেরকে জানালো যে, সে স্বয়ং জিম্মাদার হয়ে এই মুসলমানদেরকে সাথে এনেছে, সুতরাং তাদের যেন কোনো ধরনের ক্ষতি করা না হয়।

        কিন্তু ইসলামের দুশমনরা তাঁর কোনো কথায় কর্ণপাত করলো না। আশেপাশের কুরাইশদের মিত্র গোত্রগুলোর সহায়তায় মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করলো। একজন মাত্র সাহাবী হযরত আমের (রা:) কে বনী আমেরের নেতা তাঁর মাথার চুল কিছুটা কেটে এ কথা বলে ছেড়ে দিয়েছিল যে, 'আমার মা একজন দাস মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তোমাকে মুক্তি দিয়ে আমি আমার মায়ের মানত পূরণ করলাম'। বীরে মাওনার হত্যাকান্ডের সাথে বনী আমের গোত্রকে প্রকাশ্যে দেখা গেলেও এর পেছনে মদীনার এবং মদীনা থেকে বহিষ্কৃত ইয়াহূদীদের চক্রান্ত ক্রিয়াশীল ছিলো, ইতিহাসের পাঠক মাত্রই তা অবগত রয়েছেন।

        প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেই সাহাবীর ৬৯ জন সাথীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং সাথীহারা বেদনা বুকে নিয়ে মদীনার দিকে আসছিলেন। পথে হত্যাকারী বনী আমের গোত্রের দু'জন লোককে সামনে দেখেই তাঁর মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হলো এবং তিনি তাদেরকে হত্যা করলেন। কিন্তু তাঁর জানা ছিলো না, এই দুইজন লোককে নবী করীম (সা:) আমান অর্থাৎ নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। মাত্র একজন ব্যতীত প্রেরিত সকল মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে, এ সংবাদ জেনে নবী করীম (সা:) অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। তারপরও তিনি হযরত আমের (রা:) কর্তৃক বনী আমের গোত্রের যে দু'জনকে হত্যা করেছিলেন তা সমর্থন করলেন না। তিনি তাদের রক্তপণ আদায় করলেন।

        এটাই নবী করম (সা:) এর ক্ষমা ও উদারতার সীরাত। যে গোত্রের লোকজন মুসলমানদের ৬৯ জন লোককে নির্মমভাবে হত্যা করলো, অথচ তিনি কোনো ক্ষতিপূরণ দাবী করলেন না। আর সাহাবা কর্তৃক সেই গোত্রের মাত্র দু'জন লোককে হত্যা করার কারণে তিনি ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন।

        তিনি এই ক্ষতিপূরণ না দিলে নিহত গোত্রের করার কিছুই ছিল না। মুসলিমরা দাবী করতে পারতো, 'আমাদের ৬৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর বদলে আমাদের এক ভাই, যাকে তারা হত্যা না করলেও চুল কেটে লাঞ্ছিত করেছে, তিনি মাত্র দু'জনকে হত্যা করেছেন'। মুসলিমরা এমন দাবী করেনি, তাঁরা নবী করীম (সা:) এর সীরাতের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। নবী করীম (সা:) এগিয়ে গেলেন তাঁর ওয়াদা পালনের পথে। তিনি ঐ গোত্রের সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা বাস্তবায়ন করলেন, নিহত দু'ব্যক্তির রক্তঋণ আদায় করলেন। নবী করীম (সা:) কে মহান আল্লাহ তা'য়ালা মর্যাদার যে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, তিনি নিজ মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণই করলেন বিশ্বাসঘাতক বনী আমের গোত্রের সাথে। ফল এটাই হলো যে, পরবর্তীতে বনী আমের গোত্রের সকল মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। ইসলাম বিদ্বেষী বন্ধুরা, বীরে মাওনার ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ইসলাম তরবারীর শক্তিতে পৃথিবীতে বিস্তৃতি লাভ করেছে, না তার আপন মহত্ত্বের কারণে পৃথিবীতে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

Post a Comment

0 Comments