এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শন করার জন্য যে সমস্ত নবী এবং রাসূল প্রেরণ করেছিলেন, তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। দায়িত্ব পালন করার পরে তাঁরা এই পৃথিবীতে অতিরিক্ত সময় অবস্থান করবেন কুদরতের এটাই ছিল নিয়ম। পৃথিবীর জীবন হতে তাদের কাছে ঐ পবিত্র জগৎ ছিল অধিক প্রিয়। ঐ জগতে মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হবার জন্য তাঁরা ব্যাকুল হয়ে থাকতেন। কোন নবীকে যখন আল্লাহর সাথে মিলিত হবার কথা জানানো হয়েছে, তাঁরা এতটুকুন দ্বিধা না করে অতিদ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে যে দায়িত্ব দান করা হয়েছিল, তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। এমন লোক যখন প্রস্তুত হয়ে গেল, যে লোকগুলো স্বেচ্ছায় অন্তরের তাগিদে আল্লাহর বিধান সমুন্নত রাখবে, আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজনে নিজের জান-মাল কোরবান করবে, যে কোন ত্যাগ স্বীকার করবে, তখন মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে নিজের সান্নিধ্যে গ্রহণ করার ইচ্ছা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জানিয়ে দিলেন।
তিনি হিজরতের' পরে ফরজ হজ্জ আদায় করার সুযোগ পাননি। দশম হিজরীতে তিনি তাঁর জীবনের শেষ হজ্জ আদায় করার নিয়ত করলেন। জিলকদ মাসে ঘোষনা করা হলো আল্লাহর নবী হজ্জ আদায় করতে যাবেন। এই ঘোষনা গোটা আরবে বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দূরে অবস্থানরত মুসলমানগণ যখন জানতে পারলেন, আল্লাহর নবী এই বছর হজ্জ আদায় করতে যাবেন। যার সামান্য সামর্থও আছে, সে ব্যক্তিও হজ্জ আদায় করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। তাছাড়া এমন অনেক গোত্র ছিল, যারা সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু আল্লাহর নবীকে দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়নি। হজ্জ আদায় করতে গেলে নষীকে দেখা যাবে, এ কারণেও অনেকে এবারের হচ্ছে যোগদান করার জন্য প্রস্তুত হলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম জিলকদ মাসের শনিবারের দিন গোসল করে তহবন্দ এবং চাদর পরিধান করলেন। যোহরের নামায আদায় করে তিনি মদীনা থেকে বের হলেন। পবিত্রা স্ত্রীদেরকে এবার তিনি সাথে নিলেন।
মদীনা থেকে দুই মাইল দূরে জুল হুলাইফা নামক স্থানে এসে প্রথম রাত অতিবাহিত করলেন। এই স্থান থেকেই মদীনাবাসী হজ্জের ইহরাম বাঁধেন। তিনি এখানে গোছল করলেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা নিজের হাতে প্রিয় নবীর পবিত্র, শরীর মোবারকে আতর মাখিয়ে দিলেন। তারপর দুই রাকায়াত নামায আদায় করে উটের ওপর আরোহণ করে হজ্জের ইহরাম বাঁধলেন। ইহরাম বেঁধেই তিনি বিনয় অবনত চিত্তে উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত হয়েছি! হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত হয়েছি! হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত হয়েছি এবং ঘোষনা করছি, তোমার কোন অংশীদার নেই। হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা এবং নিয়ামত তোমারই জন্য নির্দিষ্ট এবং আধিপত্য ও সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র তোমারই জন্য, তোমার কোন অংশীদার নেই।
কাফেলা এক সময় এসে সরফ নামক স্থানে উপনিত হলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেখানে যাত্রা বিরতি করে গোছল করলেন। তারপর তিনি জিলহজ্জ মাসের চার তারিখে ফজরের নামার্থের সময় পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করলেন। মদীনা থেকে মক্কায় পৌঁছতে তাঁর নয় দিন সময় লেগেছিল।
আল্লাহর নবী মক্কায় এসেছেন, এ সংবাদ শোনার পরে দলে দলে মুসলমানরা তাঁকে অভ্যর্থনা করতে বের হয়ে এসেছিল। বিশেষ করে তাঁর নিজের গোত্র বনী হাশেমের শিশুরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাস্তায় বের হয়ে এসেছিল। আল্লাহর নবী শিশুদেরকে ভালোবাসতেন। তিনি কোন শিশুকে নিজের উটের পেছনে বসিয়ে নিলেন, কোন শিশুকে উটের সামনে বসিয়ে নিলেন। তিনি এগিয়ে গেলেন কা'বার দিকে। কা'বার প্রতি দৃষ্টি পড়তেই তিনি আল্লাহর কাছে বললেন, 'হে আল্লাহ! এই ঘরের সম্মান মর্যাদা আপনি বৃদ্ধি করে দিন।'
এরপর তিনি কা'বা তাওয়াফ করলেন। মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে দু'রাকায়াত নামায আদায় করলেন। তারপর সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছে বললেন, 'সাফা এবং মারওয়া পাহাড় আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত।' এখানে দাঁড়িয়ে কা'বা ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আল্লাহ ব্যতীত দাসত্ব লাভের উপযোগী কেউ নেই। কেউ তাঁর অংশীদার নেই। সমস্ত ক্ষমতা তাঁরই, তাঁরই জন্য সমস্ত ক্ষমতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশংসা। তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দান করেন। সমস্ত কিছুর ওপরে তিনিই শক্তিশালী। তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। আল্লাহ নিজের অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন এবং নিজের বান্দাকে সাহায্য করেছেন, সমস্ত গোত্রকে পরাজিত করেছেন।'
আরববাসীরা হজ্জের সময় ওমরাহ করতো না। সাফা-মারওয়া তাওয়াফ করে তিনি সায়ী শেষ করলেন। তারপর যাদের সাথে কোরবানীর পশু ছিল তাদেরকে তিনি ইহরাম হতে মুক্ত হবার নির্দেশ দিলেন।
কুরাইশরা একটা প্রথা বানিয়ে নিয়েছিল যে, তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ ধারণা করে অন্য হাজিদের মত আরাফাতে অবস্থান না করে মুজদালিফায় অবস্থান করতো। এই মুজদালিফা ছিল কা'বা শরীফের সীমানায় অবস্থিত। তারা হজ্জের সময় কা'বার সীমানা অতিক্রম করতো না এ কারণে যে, অন্যদের ভেতরে আর তাদের ভেতরে তাহলো তো আর কোন পার্থক্য থাকবে না।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই কু-প্রথার কবর দিলেন। তিনি সমস্ত বিভেদ এবং অহংকারের মাথায় পদাঘাত করলেন। তিনি সাধারণ হাজীদের সাথে আরাফাতে গমন করে ঘোষনা করলেন, 'তোমরা নিজেদের পবিত্র স্থানসমূহে অবস্থান করো। কারণ তোমরা তোমাদের পূর্ব পুরুষ ইবরাহীমের উত্তরাধিকারী হিসাবে পরিচিত।'
0 Comments