নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের জীবনের শেষ ভাষণ

        ইন্তেকালের কয়েক দিন পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কিছুটা সুস্থ অনুভব করলেন। গোছল করে তিনি হযরত আব্বাস ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুমের সাহায্যে যখন মসজিদে পৌঁছলেন, তখন নামাযের জামাত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। নামাযের ইমাম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু অনুভব করতে পারলেন, পরম প্রিয়জন এসেছেন। তিনি ইমামের স্থান থেকে পেছনে সরে আসছিলেন। রাসূল সে স্থানে গিয়ে ইমাম হয়ে নামায আদায় করাবেন। প্রিয় রাসূল তাঁর প্রিয় সাথীকে ইশারা করলেন, সরে আসার প্রয়োজন নেই।

        আল্লাহর নবী হযরত আবু বকরের পাশেই উপবেশন করলেন। হযরত আবু বকর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করলেন। আর সাহাবায়ে কেরাম অনুসরণ করলেন হযরত আবু বকরকে। প্রকারান্তরে সবাই নবীর ইমামতিতে নামায আদায় করলেন। এই নামায আদায় যে কোন্ দিনের যোহরের নামায ছিল, এ সম্পর্কে মত পার্থক্য আছে। মুসলিম শরীফের বর্ণনা অনুসারে জানা যায়, ইন্তেকালের পাঁঞ্জদিন পূর্বে অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের দিনের ঘটনা ছিল এটা।

        নামায শেষ করে আল্লাহর নবী তাঁর পৃথিবীর জীবনের শেষ দায়িত্ব পালন করলেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের সামনে তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্ব পূর্ণ ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, 'মহান আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে ক্ষমতা দিয়েছিলেন, সে দুনিয়ার জীবনে ভোগ বিলাসকে অগ্রাধিকার দিবে- না আখেরাতের জীবনের অমূল্য নেয়ামতকে প্রাধান্য দিবে। তিনি আল্লাহর কাছে রক্ষিত নেয়ামতসমূহকে প্রাধান্য দিয়েছেন।'

        আল্লাহর হাবিবের মুখ থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। লোকজন তাঁর দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন না হযরত আবু বকরের কাঁন্নার হেতু কি। কারণ রাসূল ভিন্ন এক লোকের কথা বললেন যে, সেই লোক আখিরাতের জীবনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু হযরত আবু বকর 'স্পষ্টই অনুভব করলেন, সেই ব্যক্তি স্বয়ং আল্লাহর নবী।

        আল্লাহর নবী বললেন, 'আমি যার সান্নিধ্য লাভ করে সবচেয়ে অধিক উপকৃত হয়েছি, তিনি হলেন আবু বকর। যদি আমি এই পৃথিবীতে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হতাম তাহলে আমি আবু বকরকেই প্রাধান্য দিতাম। কিন্তু আল্লাহর ইসলামের ভিত্তিতে যে সম্পর্ক স্থাপন হয় সে সম্পর্কই বন্ধুত্বের জন্য যথেষ্ট। শোন, মসজিদের দিকে আবু বকরের ঘরের জানালা ব্যতীত আর কারো জানালা রাখা যাবে না। তোমাদের পূর্বের জাতিসমূহ নিজেদের নবী এবং সৎলোকদের কবরকে ইবাদাতের স্থানে পরিণত করেছিল। সেখানে তাদের মূর্তি স্থাপন করেছিল। আমি তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছি, তোমরা কখনো এমন করবে না।'

        রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ, এ কথা সর্বত্রই প্রচার হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত মানুষের চেহারা যেন একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার ছায়া ঢেকে রেখেছিল। কারো মুখেই হাসি নেই, নেই সে খুশীর উচ্ছ্বাস। তাঁরা যাকে নিয়ে আনন্দ করে, সেই নবী অসুস্থ। আনসারদের প্রতি বিশ্বনবীর অবদানের কথা স্মরণ করে তাঁরা কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। সংবাদ এলো, আনসারদের ভেতরে কাঁন্নার রোল পড়েছে। হযরত আবু বকর এবং হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম তাদের কাছে ছুটে গেলেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমরা এমন করে কাঁদছো কেন?'

        তাঁরা জানালো, 'আমাদের প্রতি আল্লাহর নবীর অবদানের কথা স্মরণ করেই আমরা কাঁদছি।' আল্লাহর নবীর কাছে এই সংবাদ গেল যে, তাঁর দুর্দিনের সাথীগণ আনসাররা তাঁর অসুস্থতার সংবাদ শুনে শুধুই কাঁদছে। তিনি সেই দিনের কথা স্মরণ করলেন। এই আনসাররা কিভাবে তাঁকে এবং মক্কার হিজরতকারী মুসলমানদেরকে জীবনের সমস্ত, কিছু উজাড় করে দিয়ে সাহায্য করেছে। তিনি যখন ছিলেন আশ্রয়হীন, তখন তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলো।

        আল্লাহর নবী রোগাক্লান্ত কণ্ঠে উপস্থিত লোকদেরকে বললেন, 'আমি আনসারদের সম্পর্কে তোমাদেরকে অসিয়ত করে যাচ্ছি, সমস্ত মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি লাভ করবে। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না। আহার করার মত বস্তুর ভেতরে যেমন লবনের সংখ্যা কম থাকে। আনসাররা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এখন তাদের প্রতি তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন করবে। আনসারদের সাথে আমার এমন সম্পর্ক যে, দেহের সাথে যেমন হৃদপিন্ডের সম্পর্ক। যে ব্যক্তির হাতে মুসলমানদের সমস্ত কিছুর দায়িত্ব অর্পিত হবে, তাদের দায়িত্ব হলো আনসারদের মধ্যে যোগ্যতা সম্পন্নদেরকে গ্রহণ করা এবং তাদের ভুলসমূহ ক্ষমা করে দেয়া।'

         অর্থাৎ মুসলমানদের ভেতরে যিনি খলীফা হবেন, তিনি যেন আনসারদের প্রতি যথাযোগ্য দৃষ্টি দেন। তাদের ভেতরে যিনি যে কাজের যোগ্য তাকে সেই কাজ দেন। আল্লাহর নবী বলেছিলেন, 'হালাল ও হারামের নির্ধারণকে তোমরা আমার ওপরে করো না। মহান আল্লাহ যা হারাম করেছেন, আমি তা হারাম ঘোষনা করেছি। ঐ আল্লাহ যা হালাল ঘোষনা করেছেন, আমি তাই হালাল ঘোষনা করেছি। মানুষের কৃতকর্মের বিনিময় তার নির্জের কর্মের ওপরেই নির্ভর করবে।'

        এরপর তিনি তাঁর আপন কলিজার টুকরাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বললেন, 'হে' আল্লাহর নবীর কন্যা ফাতিমা! হে আল্লাহর নবীর ফুফু সুফিয়া! আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবার মত সম্পদ সংগ্রহ করো। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে গ্রেফতার হওয়া থেকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারবো না।'

Post a Comment

0 Comments