যথাযথভাবে যদি নামায আদায় করা হয়, নামায যে প্রশিক্ষণ দেয় তা অনুসরণ করা হয় তাহলে সেই নামায অবশ্যই মানুষের অন্তরে আল্লাহ তা'য়ালার ভয় সৃষ্টি করবে এবং সেই ব্যক্তি যাবতীয় অপরাধমূলক কর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। এ কথা মনে রাখতে হবে, 'আল্লাহ তা'য়ালা হলেন আমার মুনিব এবং আমি তাঁর গোলাম' এ কথা সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে হৃদয়ে জীবন্ত রাখার জন্যই আল্লাহ তা'য়ালা নামায কায়েম করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلوةَ لِذِكْرِي
আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত অন্য কেনো ইলাহ নেই, সুতরাং তুমি আমার দাসত্ব করো এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম করো। (সূরা ত্বা-হা-১৪) এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নামাযের মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবীর নানা ধরনের হৃদয়গ্রাহী, চিত্তাকর্ষক, দৃষ্টি নন্দন দৃশ্যাবলী এবং বিভিন্ন স্বার্থের মোহে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ যেনো কোনোক্রমেই মহান আল্লাহ থেকে গাফিল হয়ে না যায়, সে যেনো সত্য বিমুখ হয়ে না পড়ে এ কথাই চেতনার জগতে শাণিত রাখার উদ্দেশ্যেই নামায ফরজ করে দেয়া হয়েছে। মানুষের মনিব কে এবং মনিবের সাথে কি সম্পর্ক, মনিব তাকে কিভাবে জীবন-যাপন করতে আদেশ দিয়েছেন, সে এই পৃথিবীতে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন নয়- এই চিন্তাকে জীবন্ত ও শাণিত রাখার এবং মহান আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক জড়িত করার সবথেকে বড় মাধ্যম হচ্ছো নামায। প্রতিদিন পাঁচবার মানুষকে পৃথিবীর জটিল কাজকারবার থেকে দূরে সরিয়ে নামায তাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে নিয়ে যায়।
নামায ব্যক্তিকে শুধুমাত্র অসৎকাজ থেকেই বিরত রেখেই ক্ষান্ত থাকে না, বরং সামনে অগ্রসর হয়ে সে সৎকাজে উৎসাহিত এবং সুকৃতি সম্পাদনের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী হবার জন্য ব্যক্তিকে উদ্যোগী করে। এর কারণ হলো, নামায মানুষের ভেতরে মহান আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত রাখে। হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর স্ত্রী বলেছেন, 'মহান আল্লাহর স্মরণ নামাষ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয় বরং আল্লাহ তা'য়ালার স্মরণের পরিধি এর থেকেও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন মানুষ রোজা পালন করে, যাকাত আদায় করে বা অন্য কোনো সৎকাজ করে তখন অবশ্যই সে আল্লাহ তা'য়ালাকে স্মরণ করে, কারণ আল্লাহকে স্মরণ করেছে বলেই তো তার দ্বারা ঐ সৎকাজটি সম্পাদিত হয়েছে। অনুরূপভাবে যখন কোনো ব্যক্তি কোনো অসৎকাজ করার সুযোগ লাভ করার পরও তা থেকে নিজেকে বিরত রাখে তখন সেটাও হয় আল্লাহ তা'য়ালার স্মরণের সুফল। এ জন্য মহান আল্লাহর স্মরণ একজন মুমিনের সমগ্র জীবনে পরিব্যপ্ত হয় আর এই কাজটি সম্পাদিত করে নামায।
নামায এমনই এক জিনিস যা মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহর ভয়, পবিত্রতার অনুভূতি ও পূণ্যশীলতার নির্মল ভাবধারা এবং আল্লাহর বিধান পালন করে চলার যোগ্যতা ও প্রস্তুতি সৃষ্টি করে সর্বোপরি তাকে সব সময়ই সততার ওপর স্থির করে রাখে। বস্তুত এই জিনিসগুলো না হলে মানুষ কোনোক্রমেই সুদৃঢ়ভাবে আল্লাহর আইন-বিধান পালন করে চলতে পারে না। মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে যে- সে আল্লাহর গোলাম এবং এই কথাই বারবার স্মরণ করে দেয়ার জন্যই আল্লাহ তায়ালা নামাযের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
فَاقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا - فطْرَتَ اللهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَالِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
অতএব (হে নবী ও নবীর অনুসারীগণ!) একমুখী হয়ে নিজেদের সমস্ত লক্ষ্য এই দ্বীনের দিকে কেন্দ্রীভূত করে দাও। দাঁড়িয়ে যাও সেই প্রকৃতির ওপর যার ওপর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর তৈরী কাঠামে। পরিবর্তন করা যায় না। এটাই সর্বতোভাবে সত্য নির্ভুল দ্বীন।
(সূরা আর রুম-৩০)
মহাসত্য দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হবার পরে সেদিক থেকে দৃষ্টি যেনো শয়তান অন্য দিকে ফিরিয়ে দিতে না পারে, জীবনের জন্য এই সত্য পথটি গ্রহণ করে নেবার পর অন্য কেনো পথের দিকে যেনো দৃষ্টি না যায়, এ জন্যই আল্লাহ তা'য়ালা উল্লেখিত আয়াতে বলেছেন- একনিষ্ঠ হয়ে এই দ্বীনের দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করো। আল্লাহর দেয়া দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো এবং এই নামাযই মানুষকে একনিষ্ঠভাবে দ্বীনের অনুসারী বানিয়ে দেয়। নামায আদায়ের সাথে নামাযী ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা হতে হবে একজন মুসলমানের মতো এবং তার যাবতীয় পছন্দ-অপছন্দও হতে হবে মুসলমানের অনুরূপ। তার মূলবোধ ও মানদন্ড হতে হবে সেটাই যা ইসলাম তাকে দিয়েছে। তার স্বভাব-চরিত্র এবং জীবন ও কার্যক্রমের কাঠামো ইসলামের দাবি অনুসারে হতে হবে। ইসলাম যে পথে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনধারা পরিচালনার লক্ষ্যে বিধান দিয়েছে, সেই পথেই নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালিত করতে হবে। কেননা আল্লাহর বিধানের অনুকূল প্রকৃতি দিয়েই মানব জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
মানব জাতিকে এই প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ ব্যতীত তাদের আর কোনো স্রষ্টা, রব, মাবুদ ও আনুগত্য গ্রহণকারী নেই। এই প্রকৃতির ওপরই মানুষের প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। কোনো মানুষ যখন স্বেচ্ছাচারী নীতি অনুসারে জীবন পরিচালিত করতে থাকে, তখন সে তার নিজের প্রকৃতির সাথেই বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। আর যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দাসত্বের শিকল নিজের কন্ঠদেশে পরিধান করে, তাহলেও সে তার নিজের সৃষ্টিগত প্রকৃতির সাথে বিরোধিতা করতে থাকে। মহান আল্লাহ তা'য়ালা মানুষকে অনুগ্রহ করে নিজের বান্দায় পরিণত করেছেন। এখন কেনো মানুষ ইচ্ছে করলেই এই কাঠামোয় কেনো পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। মানুষ আল্লাহর বান্দাহ্ হওয়া থেকে মুহূর্ত কালের জন্যও নিজেকে মুক্ত করতে পারে না এবং অন্য কাউকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিলেও প্রকৃতপক্ষে সে মেকী ইলাহ কোনোক্রমেই মানুষের ইলাহ হতে পারে না।
মানুষ নিজের জন্য যতো রব, ইলাহ, মালিক, মনিব, উপাস্য যা-ই ইচ্ছা বানিয়ে নিলেও মানুষ যে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো বান্দাহ্ নয়- এই বাস্তব সত্যটি অকাট্য ও অবিচল রয়ে যায়। মানুষ নিজের মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে যাকে ইচ্ছা আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতার ধারক গণ্য করতে পারে এবং মন চায় তাকে নিজের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার মালিক মনে করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ও বাস্তব সত্য এটাই যে, সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ব্যতীত আর কেউ নয়। কেউ তাঁর অনুরূপ ক্ষমতার অধিকারী নয় এবং মানুষের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার শক্তিও একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নেই। এ জন্যই আল্লাহ তা'য়ালা মানব জাতিকে লক্ষ্য করে বলেছেন-
مُنِيبِينَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوهُ وَأَقِيمُوا الصَّلوةَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
আল্লাহ অভিমুখী হয়ে তাঁকে ভয় করো আর নামায কায়েম করো এবং মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ে যেয়ো না। (সূরা আর রূম-৩১)
আল্লাহর অভিমুখী হয়ে তাঁকে ভয় করো- এ কথা বলার পরেই বলা হয়েছে, নামায কায়েম করো। আল্লাহ অভিমুখী হওয়া ও তাঁকে ভয় করা, এ দুটো কাজের কেনো বাহ্যিক রূপ নেই। এই দুটোই কাজ নির্ভর করে মানসিকতার ওপরে। অর্থাৎ কাজ দুটো একান্তভাবেই মানসিক কাজ। একজন আল্লাহ অভিমুখী হয়েছে এবং আল্লাহকে ভয় করছে- এই মানসিক অবস্থার প্রকাশ এবং এর সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনিবার্যভাবে এমন কেনো শারীরিক কর্মের প্রয়োজন যার মাধ্যমে বাইরের দিকে এর প্রকাশ ঘটবে এবং লোকেরা জানতে পারবে যে, অমুক ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে একমাত্র মহান আল্লাহর দাসত্বের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতেও আল্লাহ ভীতির দিকে প্রত্যাবর্তন করার এই অবস্থাটি একটি কার্যকর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সময়ের প্রত্যেক মুহূর্তে বিকাশ লাভ করতে থাকতে। এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে তার মানসিক দিকে পরিবর্তন ঘটানোর আদেশ দেয়ার পর পরই নামায নামক শারীরিক কর্ম সম্পাদন করার আদেশ দিয়েছেন।
এ কথা স্পষ্ট স্মরণে রাখতে হবে যে, মানুষের মনে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো চিন্তা নিছক চিন্তার পর্যায়েই থাকে ততক্ষণ তারমধ্যে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব সৃষ্টি হয় না। এই চিন্তা যদি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সময়ের ব্যবধানে সেই চিন্তায় ভাটা পড়ার সম্ভাবনা থাকে এবং চিন্তায় পরিবর্তন আসারও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু চিন্তা অনুসারে তৎক্ষণাত কর্ম বাস্তবায়ন করতে থাকে তখন মানুষের মধ্যে সেই চিন্তা দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব লাভ করে, মনের জগতে সেই চিন্তা ক্রমশ শিকর গেড়ে বসে যেতে থাকে এবং ধারাবাহিকভাবে যখন সেই চিন্তা অনুসারে বাস্তবে কর্ম সম্পাদন হতে থাকে, ততই তার শক্তিমত্তা ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। ফলে যে আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে চিন্তা করেছে, তা পরিবর্তিত হওয়া এবং তা ম্রিয়মান হয়ে পড়া ক্রমেই দুষ্কর হয়ে যেতে থাকে এবং চিন্তা অনুসারে যে কাজের সূচনা করেছে, সেই কাজ থেকে দূরে সড়ে আসা দূরহ হয়ে পড়ে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে নিজেকে আল্লাহ অভিমুখী করা এবং হৃদয়ে আল্লাহ ভীতিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রত্যেক দিন নিয়মিত যথাযথ পন্থায় পাঁচবার নামায আদায় করার চেয়ে অধিক কার্যকর পন্থা আর দ্বিতীয়টি নেই। নামায কেনো এত কার্যকরী, কারণ রোজা-হজ্জ বা যাকাত নির্দিষ্ট একটি সময়ে সম্পদান করতে হয়। রোজা বছরে একবার, হজ্জ জীবনে একবার ফরজ, যাকাতও বছরের একবার আদায় করতে হয়। কিন্তু নামায এমন একটি কাজ যা নিয়মিতভাবে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কয়েক ঘন্টা পর পর একটি নির্দিষ্ট বাহ্যিক অবয়বে মানুষকে স্থায়ীভাবে আদায় করতে হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল করা মানুষের জন্য যে জীবন ব্যবস্থা কোরআন দিয়েছে, সেই কোরআন ব্যতীত নামায হবে না।
অর্থাৎ নামাযে কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। এই কোরআন ইসলামের যে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেশ করেছেন, তা যেনো মানুষ ভুলে না যায় এ জন্যই পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছে। কারণ নামাযে প্রত্যেক রাকাআতে প্রতিদিন পাঁচবার কোরআন তিলাওয়াত করতে হয়, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া বিধি-বিধান ও আদেশ-নিষেধ নামাযে বারবার পড়তে হয়। ফলে মানুষের আল্লাহ তা'য়ালার একত্বের কথা, তাঁর রাসূলের কথা, তাঁর আদেশ-নিষেধের কথা বারবার মানুষের মনে জীবন্ত হতে থাকে।
এ ছাড়াও মানব জাতির ভেতর থেকে কারা তাদের মনিব আল্লাহ তা'য়ালার প্রতি বিদ্রোহের নীতি অবলম্বন করে ও কারা বিদ্রোহের নীতি পরিহার করে আপন মনিষ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি আনুগত্যের মস্তক নত করে দিয়েছে এবং কারা কাফির ও কারা মুমিন তা প্রকাশ পাওয়ার জন্যেও নামায আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুসলিম সমাজের কাছে এ কথা স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন যে, কে তাদের শত্রু ও কে তাদের মিত্র এবং নামাযই এই পার্থক্যবোধ স্পষ্ট করে তুলে ধরে। সত্যপন্থী মানুষকে সবসময় অন্যায় আর পাপাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়- সংগ্রাম করার এই শক্তিও নামাযই সৃষ্টি করে দেয়।
যেসব অন্যায় ও পাপাচার পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে আর এর গতি রোধ করার লক্ষ্যে সত্য দ্বীনের দাওয়াত যারা দিচ্ছে এবং তাদের সাথে বিরোধিতা করা হচ্ছে, এসব বিরোধিতার মূল উড়ে ফেলার প্রকৃত পথ হলো, সত্য দ্বীনের দাওয়াত দানকারীকে সর্বাধিক নেক চরিত্রের অধিকারী হতে হবে এবং তার নেক আমল দ্বারা অন্যায়কে পরাজিত করতে হবে। আর দাওয়াত দানকারীকে নেক বানানোর সর্বোত্তম মাধ্যম হলো নামায। নামায আদায় করার কারণে তার মধ্যে আল্লাহর স্মরণ নিত্য-নতুন ও জীবন্ত করতে থাকবে এবং এই শক্তির মাধ্যমে সে পাপাচারের সংঘবদ্ধ ঝটিকার শুধু মোকাবেলাই করতে পারবে তা নয় বরং তা উৎখাত করে পৃথিবীতে কার্যত কল্যাণ ও মঙ্গলময় এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
আল্লাহর রাসূল, যে নামায আদায় করেছেন, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম যে নামায আদায় করেছেন এবং কোরআন ও সুন্নাহ যে নামায আদায় করার জন্য তাগিদ দিচ্ছে, সেই নামায যেমন নামাযী ব্যক্তিকে অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে অনুরূপভাবে সমাজ থেকে অসৎকর্ম উৎখাত করতে উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগায়। এ কারণেই আল্লাহ বিমুখ ও পাপাচারে নিমজ্জিত সমাজের লোকজন নামাযী ব্যক্তির প্রতি বিদ্রুপ বাণ নিক্ষেপ করতে থাকে। কেননা নামায হলো দ্বীনদারীর সর্বাধিক স্পষ্ট নিদর্শন এবং পাপাচারে লিপ্ত দুষ্কৃত প্রকৃতির লোকজন এই দ্বীনদারীকে মারাত্মক বিপজ্জনক এক রোগ বলে মনে করে। এ কারণে যে সমাজে ইসলামের বিপরীত চিন্তা-চেতনা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির স্রোত প্রবহামান, সেই সমাজের লোকেরা নামাযকে সর্বোত্তম চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ হিসাবে গ্রহণ না করে নিছক 'পরহেযগারীর লক্ষণ' হিসাবে গণ্য করে। যদিও তারা পরহেযগারীর অর্থ বুঝে না। এই সমাজের কাউকে নামায আদায় করতে দেখলে তাকে 'মোল্লা' রোগে আক্রান্ত হয়েছে-বলে ধারণা করা করে এবং তাকে নানা ধরনের বিদ্রুপ বাণে বিদ্ধ করতে থাকে।
কারণ তারা জানে, এই লোকটি এখন আল্লাহ মুখী হয়েছে, সে নিজে যেমন ভালো থাকতে চেষ্টা করবে এবং সমাজকেও ভালো বানানোর চেষ্টা করবে। নামাযী লোকটি ধর্মহীনতা ও চরিত্রহীনতার ওপর সমালোচনার আঘাত হানবে। সঠিক পথ অবলম্বন ও চরিত্র গড়ার উপদেশ দিতে থাকবে এবং এই লোকটি সমাজের যাবতীয় দুষ্কৃতির দিকে অঙ্গুলী সংকেত করে মানুষকে সচেতন করে দেবে। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার, নির্যাতন-নিষ্পেষণ উৎখাত করার লক্ষ্যে চেষ্টা-সাধনা করবে।
আর এই লোকের অনুরূপ সমাজের সমস্ত লোক যদি নামাযের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়, তাহলে পাপচারে লিপ্ত দুষ্কৃতকারী লোকদের অন্যায় পথে অর্থের পাহাড় গড়া, পরস্বার্থ হরণ করা ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ করা যাবে না- যে কাজের ওপরে তাদের ভোগ-বিলাসিতা নির্ভর করে। এ কারণেই দেশ ও সমাজদ্রোহী লোকেরা নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে দেশ ও সমাজের নেতৃত্বের আসন দখল করে। তারপর সমাজে নগ্নতা আর বেহায়াপনার প্লাবন সৃষ্টি করে মানুষের মন-মানসিকতা আল্লাহ বিমুখ করে দেয়।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক যে ছেলেটি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে আদায় করতো, সেই ছেলেটি যখন কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে তারুণ্যের সোপানে পা স্পর্শ করলো, তখনই সমাজে প্রবাহিত নগ্নতার বাতাস তাকে স্পর্শ করলো। অর্থহীন সাহিত্য, নগ্ন পত্র-পত্রিকা, যৌন উত্তেজক গান-বাজনা আর ছায়াছবি ছেলেটির কন্ঠদেশ থেকে আল্লাহর গোলামীর বন্ধন ছিন্ন করে দিলো। এই ছেলেকে আর মসজিদে পাওয়া যায় না। দেশ ও সমাজের নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়ে যেসব দুর্বৃত্ত সমাজ পরিবেশকে নামায আদায়ের বিপরীত পথে তাড়িত করেছে, সেই সব দুর্বৃত্তদের সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلوةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيَّا
তারপর এদের পর এমন নালায়েক লোকেরা এদের স্থলাভিষিক্ত হলো যারা নামায নষ্ট করলো এবং প্রবৃত্তির কামনার দাসত্ব করলো। তাই শীঘ্রই তারা পথভ্রষ্টতার পরিণামের মুখোমুখি হবে। (সূৱা মায়াম-৫৯)
দেশ ও সমাজের নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়ে এসব দুর্বৃত্ত গোটা দেশ ও সমাজের পরিবেশ এমনভাবে বিষাক্ত করে তোলে যে, সেখানে নামায আদায় করার যাবতীয় পরিবেশ তারা ধ্বংস করে ছাড়ে। চিত্ত বিনোদনের নামে গান-বাজনা, নানা ধরনের খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি এমনভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয় যে, এসব কিছুর সাথে যারা জড়িত হয় এবং যারা এসবের দর্শক-শ্রোতা, তারা এমনভাবে নিজেদেরকে ডুবিয়ে দেয় যে নামায আদায় করার মতো অবসর তাদের হয় না।
নামায থেকে বিরত থাকার স্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ সম্পর্কে বেপরোয়া ও গাফেল হয়ে যাওয়া আর এটাই হলো মুসলিম মিল্লাতের পতন ও ধ্বংসের প্রথম সূচনা। কারণ নামায মহান আল্লাহর সাথে মুসলমানের প্রথম ও প্রধানতম জীবন্ত ও কার্যকর সম্পর্কের বাঁধন অটুট রাখে। এই সম্পর্ক তাকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিচ্যুত হতে দেয় না। সম্পর্কের এই বাঁধন ছিন্ন হবার সাথে সাথেই মানুষ মহান আল্লাহর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যায়। এভাবে কার্যকর সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন হবার পরেই মানসিক সম্পর্কেরও অবসান ঘটে। বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান নামায আদায় করে না, ফলে তাদের সাথে আল্লাহ তা'য়ালার যেমন কার্যকর কেনো সম্পর্ক নেই অনুরূপ মানসিক সম্পর্কও নেই। সুতরাং এই ধরনের মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী অপমানিত আর লাঞ্ছিত হলে আল্লাহ তা'য়ালা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন, এই ধারণা করাও বড় ধরনের বোকামী বৈ আর কিছু নয়।
0 Comments