যাকাত গ্রহীতার আদব

        যাকাত গ্রহীতার আদব পাঁচটি: (১) সে মনে করবে, আল্লাহ. তাআলা তাকে এক চিন্তা ছাড়া সকল চিন্তা থেকে মুক্ত রাখার জন্যে অন্যের উপর যাকাত ওয়াজেব করেছেন। মানুষের নিষ্ঠাকে আল্লাহ তাআলা এবাদত সাব্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ, মানুষ কেবল আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের কথা চিন্তা করবে- অন্য কোন চিন্তায় মগ্ন হবে না।

        আমি মানুষ ও জ্বিনকে একমাত্র আমার এবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু আল্লাহ তাআলার আদি রহস্যের তাগিদ অনুযায়ী বান্দার উপর কামনা-বাসনা ও অভাব-অনটন চাপিয়ে তার চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তাই অনুগ্রহস্বরূপ তাকে বিভিন্ন নেয়ামতও পৌঁছানো হয়েছে, যাতে তার অভাব অনটন মোচনের জন্যে যথেষ্ট হয়। এ দৃষ্টিতে প্রভূত ধন-সম্পদ সৃষ্টি করে বান্দার হাতে দেয়া হয়েছে। এসব ধন-সম্পদ বান্দার প্রয়োজনাদি মেটানোর ওসিলা এবং এবাদতের জন্যে অবকাশ লাভের উপায়। আল্লাহ তাআলা কতক বান্দাকে অগাধ ধন-দৌলত দান করেছেন, যাতে তা তাদের জন্যে পরীক্ষা হয়। কতক লোককে তিনি তাঁর মহব্বত দ্বারা গৌরবান্বিত করে দুনিয়ার ঝামেলা থেকে এমনভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন, যেমন দরদী ও স্নেহশীল চিকিৎসক রোগীকে কুপথ্য থেকে বাঁচিয়ে রাখে। অর্থাৎ, তিনি তাদেরকে দুনিয়াব অতিরিক্ত সাজসরঞ্জাম থেকে আলাদা রেখেছেন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ধনীদের হাত দিয়ে তাদের কাছে পৌছিয়েছেন, যাতে উপার্জনের চিন্তা, সঞ্চয়ের পরিশ্রম, হেফাযতের পেরেশানী ধনীদের দায়িত্বে থাকে এবং তার লাভ ফকীররা ভোগ করে; ফলে তারা আল্লাহ তাআলার এবাদতেই সর্বক্ষণ মগ্ন থাকে এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ফকীরদের প্রতি এটি আল্লাহ তায়ালার পরম নেয়ামত। ফকীরদের উচিত এ নেয়ামতের কদর করা এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করা, দুনিয়ার সাজসরঞ্জাম থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন রেখে আল্লাহ তাদের প্রতি একান্তই কৃপা করেছেন।

        সারকথা, ফকীর যা নেবে, তদ্দ্বারা স্বীয় রিযিক ও এবাদতে সাহায্য লাভের উদ্দেশে নেবে। যদি তা সম্ভবপর না হয়, তবে এ দানের অর্থ আল্লাহ তাআলার অনুমোদিত খাতে ব্যয় করবে। যদি এই অর্থ দ্বারা পাপ কাজে সাহায্য লাভ করে, তবে সে আল্লাহর নেয়ামতের অকৃতজ্ঞ হবে এবং তাঁর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির পাত্র হবে।

        (২) ফকীর দাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে এবং তার জন্যে নেক দোয়া করবে। দোয়া এভাবে করবে যেন দাতাকে মধ্যবর্তী ছাড়া অন্য কিছু মনে না করা হয়। বরং এটাই বুঝবে, আল্লাহর নেয়ামত পৌঁছার পথ ও উপায় এ ব্যক্তি হয়ে গেছে। এ ধারণা নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করার পরিপন্থী নয়। সেমতে হাদীসে বলা হয়েছে- من لم يشكر الناس لم يشكر الله  যেব্যক্তি মানুষের শোকর করে না, সে আল্লাহ তাআলার শোকর করে না। আল্লাহ তাআলা বান্দার আমলের জন্যে তার প্রশংসা অনেক জায়গায় করেছেন। উদাহরণতঃ এক জায়গায় বলেেেছন-   আমার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। আরও অনেক আয়াতে এই বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। গ্রহীতা এভাবে দোয়া করবে- আল্লাহ পবিত্র লোকদের অন্তরের সাথে আপনার অন্তরকে পবিত্র করুন এবং সৎকর্মীদের কর্মের সাথে আপনার কর্মকে পরিষ্কার করুন। শহীদদের আত্মা সাথে আপনার আত্মার প্রতি রহমত নাযিল করুন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: কেউ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করলে তুমি তাকে কিছু বিনিময় দাও। আর কিছু সম্ভব না হলে তার জন্যে দোয়া কর। এত দোয়া কর যেন প্রতিদান হয়ে গেছে বলে তোমার মনে বিশ্বাস জন্মে। শোকরের পরিশিষ্ট হচ্ছে, দানের মধ্যে কিছু দোষ থাকলে তা গোপন করবে এবং তার নিন্দা করবে না। দাতা যদি না দেয়, তবে তাকে লজ্জা দেবে না। দিলে তার কাজকে মানুষের সামনে বড় বলে প্রকাশ করবে। কেননা, দাতার আদব হল নিজের দানকে ছোট মনে করা এবং কৃতজ্ঞ হওয়া।

        (৩) গ্রহীতা যে অর্থ নিতে চায়, তা হারাম কিনা প্রথমে দেখে নেয়া উচিত। নাজায়েয ও হারাম হলে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা অন্য কোথাও থেকে তাকে দেয়াবেন। আল্লাহ বলেন:

وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلُ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لا يَحْتَسِبُ .

        যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং এমন জায়গা থেকে তাকে রিযিক দেন, যার কল্পনাও সে করে না। এরূপ নয় যে, কেউ হারাম থেকে বিরত থাকলে সে হালাল মাল পাবে না। মোট কথা, সরকারী কর্মচারীদের মাল এবং যাদের উপার্জন অধিকাংশই হারাম, তাদের মাল গ্রহণ করবে না। কিন্তু অবস্থা সংকটজনক হলে এবং প্রদত্ত মালের কোন মালিক জানা না থাকলে প্রয়োজনমাফিক তা গ্রহণ করা জায়েয। কেননা, এরূপ মাল খয়রাত করে দেয়াই বিধান।

        (৪) গ্রহীতা সন্দেহের জায়গা থেকে বেঁচে থাকবে এবং যা নেবে তার পরিমাণে সন্দেহ হলে যতটুকু জায়েয, ততটুকুই নেবে। নিজের মধ্যে হকদার হওয়ার কারণ বিদ্যমান আছে- একথা না জানা পর্যন্ত নেবে না। উদাহরণতঃ যদি ঋণী হওয়ার কারণে যাকাত নেয়, তবে ঋণের পরিমাণের বেশী নেবে না। যদি মুসাফির হওয়ার কারণে যাকাত নেয়, তবে পাথেয় এবং গন্তব্যস্থানে পৌঁছা পর্যন্ত যানবাহনের যা ভাড়া লাগে, তার বেশী নেবে না। এসব বিষযের আন্দাজ গ্রহীতা নিজের ইজতেহাদ দ্বারা করবে। এর কোন সীমা নির্দিষ্ট নেই। মোট কথা, প্রয়োজন পরিমাণ হয়ে গেলে যাকাতের মাল বেশী গ্রহণ করবে না; বরং এই বছরের জন্যে যথেষ্ট হয়, এই পরিমাণ গ্রহণ করবে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) আপন পোষ্যদের জন্যে এক বছরের খাদ্য একত্রিত করেছেন। অতএব ফকীর ও মিসকীনের জন্যে এ সীমাই নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। যদি একমাস অথবা একদিনের প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করে ক্ষান্ত হয়, তবে এটা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী।

        যাকাত ও খয়রাত থেকে ফকীরের কি পরিমাণ গ্রহণ করা উচিত, এ সম্পর্কে আলেমগণ ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ এত বেশী কম বলেন যে, একদিন এক রাতের খাদ্যের বেশী না নেয়া তাদের মতে ওয়াজেব। তাদের এ দাবীর সমর্থনে সহল ইবনে হানয়ালিয়া বর্ণিত একটি হাদীস পেশ করা হয়ে থাকে। তা এই, রসূলুল্লাহ (সাঃ) মালদারী থাকা অবস্থায় সওয়াল করতে নিষেধ করেছেন। এর পর মালদারী কি, এ প্রশ্নের জওয়াবে তিনি বলেছেন- সকাল ও সন্ধ্যার খাদ্য থাকা। কেউ কেউ বলেন, ধনাঢ্যতার সীমা হচ্ছে যাকাতের নেসাব। কারণ, আল্লাহ্ তাআলা যাকাত কেবল ধনাঢ্যদের উপর ফরয করেছেন। তারা এর অর্থ এই বের করেছেন, নিজের জন্যে এবং পরিবারের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে যাকাতের নেসাব পর্যন্ত গ্রহণ করা জায়েয। কেউ কেউ ধনাঢ্যতার সীমা পঞ্চাশ দেরহাম বলেছেন। কেননা, হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:

من سال وله ما يغنيه جاء يوم القيامة وفي وجهه خموس وقيل وما عناه قال خمسون در هما او قيمتها من الذهب .

        যেব্যক্তি মালদার হওয়া সত্ত্বেও সওয়াল করবে, সে কেয়ামতের দিন মুখমণ্ডলে ঘা নিয়ে উপস্থিত হবে। প্রশ্ন করা হল: মালদারী কি? তিনি বললেন: পঞ্চাশ দেরহাম অথবা তার সমতুল্যের স্বর্ণ। কথিত আছে, এ হাদীসের একজন রাবী দুর্বল। কেউ কেউ ধনাঢ্যতার সীমা চল্লিশ দেরহাম বর্ণনা করেছেন। কেননা, আতা ইবনে ইয়াসারের রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ এক ওকিয়া অর্থাৎ, চল্লিশ দেরহাম থাকা সত্ত্বেও যেব্যক্তি সওয়াল করে, সে অযথা সওয়াল করে। অন্য আলেমগণ বিষয়টি অধিক প্রশস্ত করে বলেছেন : ফকীর এই পরিমাণে গ্রহণ করতে পারে, তদ্দ্বারা এক খণ্ড জমিন ক্রয় করে জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে যায় অথবা কোন পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে অভাবমুক্ত হয়ে যায়। কেননা, জীবিকার জন্যে নিশ্চিন্ত হওয়াকেই নিশ্চিন্ততা বলে। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন: যখন এই দান কর, তখন ধনী করে দাও। কারও কারও মতে, কোন ব্যক্তি ফকীর হয়ে গেলে সে এই পরিমাণ গ্রহণ করতে পারে, যদ্দ্বারা তার পূর্বাবস্থা বহাল হয়ে যায়, যদিও তা দশ হাজার দেরহাম দ্বারা হয়। একবার হযরত আবু তালহা (রাঃ) তাঁর বাগানে নামায পড়ছিলেন। এমতাবস্থায় বাগানের দিকে তাঁর ধ্যান চলে যাওয়ায় তিনি বললেন: আমি এ বাগান খয়রাত করলাম। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁকে বললেন: তুমি এ বাগান তোমার আত্মীয়দের মধ্যে খয়রাত কর। এটা তোমার জন্যে ভাল। সেমতে তিনি বাগানটি হযরত হাসান ও আবু কাতাদাহ্ (রাঃ)-কে দান করে দিলেন। একটি খোরমার বাগান পেয়ে তারা উভয়েই ধনী হয়ে গেলেন। হযরত ওমর (রাঃ) জনৈক গেঁয়ো ব্যক্তিকে একটি বাচ্চা উট সেটির পিতামাতাসহ দিয়ে দেন। এসব রেওয়ায়েত থেকে বুঝা যায়, ফকীররা বেশী গ্রহণ করতে পারে। আমাদের মতে, নিম্নে এক দিবা-রাত্রির খাদ্য অথবা চল্লিশ দেরহাম থাকলে সওয়াল করবে না এবং দ্বারে দ্বারে ঘুরাফেরা করবে না। ভিক্ষাবৃত্তি নিন্দনীয়। এ ব্যাপারে পরহেযগার ব্যক্তিকে বলে দেয়া উচিত, তুমি তোমার মনের কাছ থেকে ফতোয়া নাও, অন্যেরা তোমাকে যত ফতোয়াই দিক না কেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ)ও তাই বলেছিলেন। গ্রহীতা যদি সেই মালের ব্যাপারে মনে কোন খটকা পায়, তবে আল্লাহকে ভয় করে মাল গ্রহণ করা উচিত। ফতোয়াকে বাহানা বানিয়ে তা গ্রহণ করা উচিত নয়। কেননা, যাহেরী আলেমগণের ফতোয়া প্রয়োজনের শর্ত থেকে মুক্ত এবং এতে অনেক সন্দেহ থাকে। ধার্মিক ও আখেরাতের পথিকদের অভ্যাস সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকা।

        (৫) ফকীর মালদার ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে, তার উপর কি পরিমাণ যাকাত ওয়াজেব। জানার পর দেখবে, যতটুকু সে পেয়েছে তা মোট যাকাতের এক-অষ্টমাংশের বেশী কিনা। বেশী হলে তা নেবে না। কেননা, সে এবং তার আরও দু'জন শরীক মিলে কেবল এক-অষ্টমাংশের হকদার। সুতরাং সে এক অষ্টমাংশের এক-তৃতীয়াংশ নেবে, বেশী নেবে না। এটা জিজ্ঞেস করা অধিকাংশ লোকের উপর ওয়াজেব। কারণ, মানুষ এই ভাগাভাগির প্রতি লক্ষ্য করে না মূর্খতার কারণে অথবা সহজ করার কারণে। তবে হারাম হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল না হলে এসব বিষয় জিজ্ঞেস না করা জায়েয।

Post a Comment

0 Comments