নবী করীম (সাঃ)-এর শিখানো পদ্ধতি

        কোরআন-সুন্নাহয় মানুষের জন্য যেসব আদেশ নিষেধ বর্ণিত হয়েছে, তা বাস্তবায়িত করার পদ্ধতিও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাঁর বান্দাদের শিখিয়েছেন। কোরআন-সুন্নাহ্র আদেশ-নিষেধ কিভাবে কোন্ পদ্ধতি অনুসরণ করে বাস্তবায়িত করতে হবে, এ ব্যাপারে একমাত্র আদর্শ নমুনা বা মডেল হলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রোজা পালন, যাকাত আদায় বা নামায আদায়ের নিয়মাবলী কি- তা অনুসন্ধান করতে হবে আল্লাহর রাসূলের জীবনে।

        মহান আল্লাহর গোলামী করা বা তাক্বওয়া অবলম্বনের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'য়ালার সান্নিধ্য অর্জন করতে চায়, তাঁর নির্দেশ পালন করে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে, যে পদ্ধতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং অনুসরণ করেছেন এবং একমাত্র তাঁকেই অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

        মহান আল্লাহর গোলামী করা তথা তাঁর সন্তুষ্টি বা সান্নিধ্য অর্জন করার ক্ষেত্রে কেউ যদি নিজের মনগড়া পদ্ধতি অনুসরণ করে বা অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দেয়, তাহলে তা অবশ্যই পালন করা যাবে না। সুতরাং নামায আদায়ের ক্ষেত্রেও সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে, যে পদ্ধতিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায আদায় করেছেন। তিনি বলেছেন-

صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أَصَلَّى

        তোমরা ঠিক সেভাবেই নামায আদায় করো, যেভাবে আমাকে আদায় করতে দেখেছো। 
(বোখারী-মুসলিম)

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরণ করেছেন আল্লাহর দেয়া নিয়ম নীতি। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে যে পদ্ধতিতে নামায আদায়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তিনিও সেই একই পদ্ধতিতে নামায আদায়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- 

إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَى

        আমি কারো কোন আদর্শই অনুসরণ করি না, আমি তাই অনুসরণ করি, যা আমার কাছে ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়।

        আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কোরআনেও তাঁর নবীর শিখানো পদ্ধতি অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-

وَمَا أَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهِكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا

        রাসূল তোমাদেরকে যা কিছু দান করেন তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ ও ধারণ করো এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাকো। (সূরা হাশর-৭)

        একমাত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিখানো পদ্ধতি অনুসরণ করলেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বা তাঁর সান্নিধ্য অর্জন করা সম্ভব। ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করলে মানুষ অবশ্যই পথ ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَإِنْ تُطِعُوْهُ تَهْتَدُوا -

        তোমরা রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করলেই সত্য সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে। (সূরা নূর-৫৪)

        সুতরাং সেই পদ্ধতিতে নামায আদায় করলে মানুষের চরিত্র সংশোধন হবে এবং মানুষ কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে- যে পদ্ধতিতে স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায আদায় করেছেন। কালের প্রবাহে শুধুমাত্র নামায আদায়ের ক্ষেত্রেই নয়- মুসলিম হিসেবে দাবীদার লোকজন ইবাদাতের নামে এমন সব নিয়ম-পদ্ধতি ও অনুষ্ঠান পালন করে থাকে, যা আল্লাহর রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ-তাবেতাবেঈ এবং সালফে সালেহীনের জীবনেও খুঁজে পাওয়া যায় না। অজ্ঞতার কারণে নামায আদায়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ লোকজন বর্তমানে ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। নামায হলো মহান আল্লাহ তা'য়ালার সেই ইবাদাত- যা পালন করে বান্দা পৃথিবী ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করবে। অতএব এই অতিব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত যথাযথ নিয়মে এবং সঠিক সময়ে অবশ্যই পালন করতে হবে। ইতোপূর্বে আমরা নামায আদায়ের সঠিক সময় সম্পর্কে কোরআন-হাদীস থেকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে নামায আদায়ের নিষিদ্ধ সময় সম্পর্কে হাদীস থেকে উল্লেখ করছি।

        হযরত উকুবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনটি সময় এমন যে, এই সময়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নামায আদায় ও মৃত লোকদের সমাহিত করতে নিষেধ করেছেন। সে সময় হলো, সূর্য উদিত হয়ে ওপরে না পৌঁছা পর্যন্ত, দ্বি-প্রহরে সূর্য হেলে না পড়া পর্যন্ত এবং সূর্য অস্তমিত হওয়ার সময় থেকে পূর্ণ অস্তমিত না হওয়া পর্যন্ত। (মুসলিম-আবু দাউদ)

        হাদীস গ্রন্থে এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এই তিনটি সময় ছাড়াও ফজরের নামাযের ফরজ নামাযের পরে অর্থাৎ সূর্যের পূর্ণ আলো বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত এবং আসরের ফরজ নামাযের পরে অন্য কোনো নামায আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-আসরের নামাযের পরে সূর্য অস্তমিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো নামায নেই এবং ফজরের নামাযের পর সূর্য উদিত না পর্যন্ত কোনো নামায নেই। (বোখারী-মুসলিম)

        প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ফরজ নামায আদায়ের পূর্বে ও পরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত যে কয় রাকাআ'ত নামায আদায় করেছেন, তা ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় সুন্নাত নামায হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। হযরত উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা বলেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-যে ব্যক্তি দিন ও রাতের মধ্যে মোট ১২ রাকাআ'ত নামায আদায় করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মিত হবে। তাহলো, যোহরের নামাযের পূর্বে চার রাকাআ'ত এবং পরে দুই রাকাআ'ত, মাগরিবের নামাযের পরে দুই রাকাআ'ত, ইশার নামাযের পরে দুই রাকাআ'ত আর ফজরের নামাযের পূর্বে দুই রাকাআ'ত। (তিরমিযী, নাসায়ী)।

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাযের পূর্বে দুই রাকাআ'ত নামায আদায়ের ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন- এই দুই রাকাআ'ত নামায পৃথিবী ও এর মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি ফজরের (ফরজ) নামাযের পূর্বে দুই রাকাআ'ত সুন্নাত নামায আদায় করতে পারেনি, সে যেনো সূর্যোদয়ের পরে তা আদায় করে নেয়। (আবু দাউদ-তিরমিযী)

        তিরমিযীর একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, যোহরের ফরজ নামায আদায়ের পূর্বে চার রাকাআ'ত সুন্নাত নামায আদায় করতে না পারলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ নামাযের পরে তা আদায় করতেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে নফল নামায আদায় করেছেন এবং সবশেষে বিতিরের নামায আদায় করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহ তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা রাতে বিতিরের নামাযকে তোমাদের শেষ নামায করো। (বোখারী)

        হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি শেষ রাতে ঘুম থেকে জাগতে পারবে না বলে মনে করে, সে যেনো রাতের প্রথম ভাগেই (ইশার নামাযের পরেই) বিতির আদায় করে নেয় এবং ঘুমায়। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রাতের শেষ অংশে (তাহাজ্জুদ) নামায আদায়ের আশা করে সে যেনো শেষ রাতে বিতির আদায় করে। কারণ শেষ রাতের ক্বিরাআত (শ্রবণ করার জন্য ফেরেস্তাদের) উপস্থিতির সময় এ জন্য তা অধিক উত্তম। (ইবনে মাজাহ্)

        শুধুমাত্র ফরজ ও সুন্নাত নামাযই নয়- নিয়মিত নফল নামাযও আদায় করা উচিত। এতে করে মহান আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন বান্দার কর্মসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব গ্রহণ করা হবে। বান্দা যদি নিয়মিত যথাযথভাবে নামায আদায় করে থাকে তাহলে সে মুক্তি লাভ করবে এবং সফলকাম হবে। আর যদি নামায আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু পাওয়া যায়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যদি ফরজ নামাযের মধ্যে কোনো ভুল-ত্রুটি পাওয়া যায় তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফেরেস্তাদেরকে আদেশ করবেন, দেখো- আমার বান্দার ফরজ ব্যতীতও কোনো অতিরিক্ত নামায রয়েছে কিনা। থাকলে তা দিয়ে ফরজ নামাযের ভুল-ত্রুটি দূর করা হবে। সুতরাং সমস্ত কাজের বিচার পর্যায়ক্রমে এভাবেই করা হবে। (তিরমিযী)

        নফল নামায সাধারণত বাড়িতেই আদায় করা উচিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা মসজিদে যখন নামায আদায় করবে তখন ঘরের জন্যও নামাযের কিছু অংশ রেখে দিবে। কারণ, আল্লাহ তা'য়ালা নামাযের মাধ্যমে তার ঘরের কল্যাণ সাধন করে থাকেন। তোমাদের নামাষের কিছু অংশ ঘরেও আদায় করবে। (মুসলিম)

        নামায আদায়ের পূর্বে নামায আদায়কারীর প্রতি ৭টি বিষয় ফরজ। এর মধ্যে ব্যতিক্রম হলে নামায সহীহ হবে না। প্রথমটি হলো নামাযের সঠিক সময় সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকতে হবে। এ ব্যাপারেও আমরা ইতোপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। দ্বিতীয়টি হলো, শরীর পবিত্র হতে হবে। তৃতীয়টি হলো, পোশাক পবিত্র হতে হবে। চতুর্থটি হলো, নামায আদায়ের স্থান পবিত্র হতে হবে। পঞ্চমটি হলো, শরীরের ঐসব স্থান আবৃত রাখতে হবে, আল্লাহ তা'য়ালা যা নারী-পুরুষের জন্য আবৃত রাখা ফরজ করেছেন। অপবিত্র শরীর, পোশাক ও স্থানে নামায আদায় করলে নামায হবে না। ষষ্ঠটি হলো, ক্বিবলা মুখী হতে হবে। এ ব্যাপারেও আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

        সপ্তম বিষয় হলো, নিয়্যত করতে হবে। নিয়্যত আরবী শব্দ এবং এর অর্থ হলো, অভিপ্রায় বা ইচ্ছা। এই অভিপ্রায় বা ইচ্ছা সম্পূর্ণভাবে মানুষের মনের সাথে সম্পৃক্ত। মুখে উচ্চারণের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে বা সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে বা তাবেঈ-ভাবেতাবেঈ অথবা পরবর্তী সাল্ফে সালেহীনের জীবনীতেও দেখা যায় না যে, তাঁরা নিয়্যত মুখে উচ্চারণ করেছেন। বর্তমানে নামায শিক্ষা নামক বই-কিতাবে যেভাবে আরবী নিয়্যত বর্ণিত হয়েছে, এসব ব্রাক্যাবলী সাহাবায়ে কেরাম বা তাঁদের পরবর্তী যুগের সাল্ফে সালেহীন মুখে উচ্চারণ করেননি। নিয়্যতের নামে এসব স্বাক্যাবলী অনেক পরে একশ্রেণীর মানুষ-নামায আদায়ের পদ্ধতির সাথে সংযোজন করেছেন।

Post a Comment

0 Comments