পানি থেকেই জীবন্ত বস্তুর উদ্ভব

        এই পৃথিবীতে মানুষ এমন অনেক কিছু ভোগ করে এবং চোখে তা দেখে, জ্ঞানে ধরা পড়ে এসব হলো আল্লাহ তা'য়ালার প্রকাশ্য নেয়ামত। আর যেসব নেয়ামত সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না এবং অনুভবও করতে পারে না সেগুলো হলো আল্লাহ তা'য়ালার গোপন নেয়ামত। স্বয়ং মানুষের নিজের দেহে এমন অনেক কিছু কাজ করে যাচ্ছে এবং দেহের বাইরে পৃথিবীর পরিবেশে মানুষের স্বার্থে কল্যাণময় ভূমিকা পালন করছে এমন অগণিত জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে কিন্তু মানুষ এসব সম্পর্কে জানেও না যে, মহান আল্লাহ তাকে সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য, তার প্রতিদিনের আহারের জন্য, তার দেহের জীব কোষ বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশের জন্য এবং তার অন্যান্য কল্যাণ্যের জন্য নানা ধরনের উপকরণ থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন। বর্তমানে বিজ্ঞানের নানা শাখায় মানুষ যতই গবেষণা করছে ততই মানুষের সামনে আল্লাহ তা'য়ালার এমন অগণিত নেয়ামত স্পষ্ট দৃষ্টি গোচর হচ্ছে যে, এসব নেয়ামত সম্পর্কে মানুষের কোন পূর্ব ধারণাও ছিল না। পক্ষান্তরে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই মানুষ আল্লাহর যেসব নেয়ামত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছে, সেগুলো ঐসব নেয়ামতের তুলনায় অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ, যেসব নেয়ামত বর্তমান সময় পর্যন্তও মানুষের জ্ঞানের অগোচরে রয়েছে।

        বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পানি থেকেই প্রথমে জীবন্ত বস্তুর উদ্ভব হয়েছে। অথচ চৌদ্দ শত বছর পূর্বে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমন এক ব্যক্তির মুখ দিয়ে পৃথিবীবাসীকে শুনিয়ে দিয়েছেন যে, 'পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে পানি থেকে।' অথচ তিনি কোন দিন কোন বিজ্ঞান গবেষণাগারে গবেষণা করেননি। আল্লাহ তা'য়ালা সেই মহামানবের মুখ দিয়েই উচ্চারিত করালেন-

وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَي 

        আমি পানি থেকে প্রত্যেক জীবন্ত বস্তুকে সৃষ্টি করেছি। (সূরা আম্বিয়া-৩০)

        জীবন্ত বস্তু বলতে শুধু মানুষকেই বুঝানো হয় না। সৃষ্ট জগতের অসংখ্য জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ এবং উদ্ভিদসমূহও জীবন্ত বস্তুর মধ্যে শামিল রয়েছে। প্রজননের মাধ্যমেও জীবের জন্ম ও বিকাশের ক্ষেত্রেও পানি অপরিহার্য। জীব কোষের পদার্থসমূহের অধিকাংশই পানি এবং অতি সামান্য অংশ রয়েছে অন্যান্য পদার্থ। পানি ব্যতিত জীব কোষ জীবিত থাকতে পারে না এবং কোন ধরনের জীবের উৎপত্তি ও বিকাশ কোন ক্রমেই সম্ভব নয়।

        বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় নিকটবর্তী গ্রহ। আর আয়তনের দিক থেকে পৃথিবী হলো পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১৪ কোটি ৯৬ লক্ষ কিলোমিটার। এই দুরত্বকে জ্যোতির্বিদ্যার একক বা এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (Astronomical unit) বলে। এই হিসেবে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১ জ্যোতির্বিদ্যা একক। পৃথিবীর ব্যস ১২ হাজার ৭ শত ৫৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার। আর ভর ৬. ৬ সেক্সটিলিয়ন। পৃথিবীর গতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিটে পৃথিবী এক পাক সম্পন্ন করে। যাকে আমরা একদিন বলে থাকি। আর সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে আমাদের এই পৃথিবী সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট, ৯ দশমিক ৫৪ সেকেন্ড।

        এই পৃথিবীর আকার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর এক মেরু থেকে আরেক মেরুর দুরত্ব ৭ হাজার ৮ শত ৯৯ দশমিক ৮৩ মাইল বা ১২ হাজার ৭ শত ১৩ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার। আর বিষুবীয় অঞ্চলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব ৭ হাজার ৮ শত ৯৯ দশমিক ৮৩ মাইল বা ১২ হাজার ৭ শত ১৩ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার। পৃথিবী পৃষ্ঠের আয়তন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৯ কোটি ৬৯ লক্ষ ৫১ হাজার বর্গমাইল বা ৫১ কোটি ১ লক্ষ কিলোমিটার। এই বিশাল আয়তনের পৃথিবীর মধ্যে ভূ-ভাগ হলো মাত্র ৫ কোটি ৭২ লক্ষ ৫৯ হাজার মাইল বা ১৪ কোটি ৮৩ লক্ষ ফিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবীর আয়তনের মোট ৩০ শতাংশই হলো পানি।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীতে জীবের উৎপত্তি করেছেন পানি থেকে। পৃথিবীতে জীব টিকে থাকা ও বিকাশের জন্যও পানি একান্তই প্রয়োজন। পৃথিবীতে পানির অংশের আয়তন হলো ১৩ কোটি ৯৬ লক্ষ ৯২ হাজার মাইল বা ৩৬ কোটি ১৫ লক্ষ কিলোমিটার। কত পানি যে আল্লাহ এই পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন তা কল্পনাও করা যায় না। জীবন ধারনের জন্য পানির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী, এ কারণে আল্লাহ তা'য়ালা অসংখ্য নদী-নালা, ডোবা-পুকুর, হৃদ, সাগর, মহাসাগর সৃষ্টি করেছেন। এরপরেও আল্লাহ তা'য়ালা মুষলধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এসব কিছুই করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য।

        আল্লাহ তা'য়ালা এই পৃথিবীতে যত সাগর-মহাসাগর সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গভীর এলাকার নাম হলো ম্যারিনা ট্রেঞ্চ। গুয়ামের দক্ষিণ পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে এই এলাকাটির গভীরতা ৩৬ হাজার ১৯৮ ফুট বা ১১ হাজার ৩৩ মিটার। পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরগুলোর গড় গভীরতা ১২ হাজার ৪ শত ৫০ ফুট বা ৩ হাজার ৭ শত ৯৫ মিটার। এই পরিমাপের কম বা বেশী হলেই পৃথিবীর পরিবেশ বিপন্ন হবে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আল্লাহ তা'য়ালা বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে পানির পরিমাপ এই পৃথিবীতে ঠিক রেখেছেন। এই ব্যবস্থা যথাযথভাবে যিনি সম্পাদন করেন তিনিই হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।

        এ পৃথিবীতে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে লিবিয়ার আল আজিজিয়ায় ১৩৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এ্যান্টার্টিকার ভোকষ্ট-এ মানইনাস ১২৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট অর্থাৎ মাইনাস ৮৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আল্লাহ তা'য়ালা এই তাপমাত্রার ব্যতিক্রম করে দিলেই পৃথিবীর প্রাণীকুল বিপন্ন হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে এমন কোন শক্তির অস্তিত্ব নেই, আল্লাহর মোকাবিলায় পৃথিবীর পরিবেশ প্রাণী বসবাসের উপযোগী করতে পারে। আল্লাহ বলেন, এসব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করি আমি আল্লাহ। সুতরাং আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আমার বিধান অকুণ্ঠিত চিত্তে গ্রহণ করো আর আমার বিধান গ্রহণ করার মধ্যেই তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তোমরা কি দেখতে পাওনা, তোমাদেরকে আমি পানি থেকে সৃষ্টি করেছি। শুধু তোমাদেরকেই নয়-পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকেই আমি পানি থেকেই সৃষ্টি করেছি। এই পানি ব্যতিত মুহূর্তকালের জন্যও তোমাদের জীবন চলতে পারে না। এ জন্য আমি পৃথিবীতে অসংখ্য বিশালাকের জলাধার নির্মাণ করেছি। এসব দেখেও কি তোমরা নিজেদেরকে ভুল পথেই পরিচালিত করবে? পৃথিবীতে আল্লাহ তা'য়ালা অসংখ্য বিচিত্র প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত প্রাণীর চলার ধরণ ও গতি এক রকম নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَاللهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِّنْ مَّاءٍ فَمِنْهُمْ مَّنْ يَمْشِي عَلَى بَطْنِهِ وَمِنْهُمْ مَّنْ يَمْشِي عَلَى رِجْلَيْنِ وَمِنْهُمْ مَّنْ يَمْشِي عَلَى أَرْبَعٍ يَخْلُقُ اللهَ مَا يَشَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ 

        আল্লাহ সমস্ত জীবকেই পানি থেকেই সৃষ্টি করেছেন। তাদের কোনটি বুকের ওপরে ভর করে চলে। কোনটি দু'পায়ে ভর করে চলে। আবার কোনটি চলে চার পায়ে ভর করে। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই সৃষ্টি করেন, তিনি তো সমস্ত কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান। (সূরা আন্ নূর-৪৫)

পানির দুটো ধারা

        রাব্বুল আলামীন বলেন, নদী-সাগর ও সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখো, পানির দুটো ধারা কিভাবে বয়ে চলেছে। একটি ধারা সুমিষ্ট আরেকটি ধারা লবণাক্ত। এই পানির ভেতরে নানা ধরনের মাছ আমি তোমাদের খাদ্য হিসাবে মওজুদ রেখেছি। তোমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ নানা ধরনের অলঙ্কার প্রস্তুত করার উপাদান রেখেছি। পবিত্র কোরআনে সূরা ফাতিরে বলা হয়েছে-

وَمَا يَسْتَوِي الْبَحْرَانِ هَذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ سَائِعُ شَرَابُهُ وَهَذَا مِلْحٌ أُجَاجٌ وَمِنْ كُلَّ تَأْكُلُونَ لَحْمًا طَرِيًّا وتَسْتَخْرِجُونَ حِلْيَةٌ تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ فِيهِ موَاخِرَ لِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ يُوْ لِجُ الَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي الَّيْلِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لأَجَلٍ مُسَمًّى ذَالِكُمُ اللَّهُ رَبَّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ 

        পানির দুটো উৎস সমান নয়। একটি সুমিষ্ট ও পিপসা নিবারণকারী সুস্বাদু পানীয় এবং অন্যটি ভীষণ লবণাক্ত যা কণ্ঠনালীতে ক্ষত সৃষ্টি করে, কিন্তু উভয়টি থেকে তোমরা সজীব গোস্ত লাভ করে থাকো, পরিধান করার জন। সৌন্দর্যের সরঞ্জাম বের করো এবং এ পানির মধ্যে তোমরা দেখতে থাকো নৌযান তার বুক চিরে ভেসে চলছে, যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। তিনি দিনের মধ্যে রাতকে এবং রাতের মধ্যে দিনকে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে আসেন। চন্দ্র ও সূর্যকে তিনি অনুগত করেছেন। এসব কিছু একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। এ আল্লাহই তোমাদের রব্ব, সার্বভৌমত্বও তাঁরই।

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমন রব্ব, তিনি তাঁর বান্দাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করেছেন। লবণাক্ত পানি পান করার অযোগ্য কিন্তু লোনা পানির ভেতর দিয়ে মানুষ যখন জলযানে পথ অতিক্রম করতে থাকে, তখন যদি তার পানির প্রয়োজন হয়, এ জন্য আল্লাহ সাগর-মহাসাগরের ভেতরে অসংখ্য মিষ্টি পানির স্রোতধারা প্রস্তুত করে রেখেছেন। তিনি বলেন-

وَهُوَ الَّذِي مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ هَذَا عَذْبٌ فَرَاتٌ وَهَذَا مِلْحٌ أجَاجٌ وَجَعَلَ بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌاو حِجْرًا مَّحْجُورًا -

        আর তিনিই দুই সাগরকে মিলিত করেছেন। একটি সুস্বাদু ও মিষ্টি এবং অন্যটি লোনা ও খারযুক্ত। আর দু'য়ের মাঝে একটি অন্তরাল রয়েছে, একটি বাধা তাদের এককার হবার পথে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে রেখেছে। (সূরা আল ফুরকান-৫৩)

        পৃথিবীর কোন বড় নদী এসে যেখানে সাগরে মিলিত হয়, সেখানেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সমুদ্রের মধ্যেও বিভিন্ন স্থানে মিষ্টি পানির স্রোত পাওয়া যায়। সমুদ্রের ভীষণ লবণাক্ত পানির মধ্যেও মিষ্টি পানির স্রোত তার নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সক্ষম। পারস্য উপসাগরেও মিষ্টি পানির স্রোত রয়েছে। চারদিকে লবণাক্ত পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে, আর মাঝখানে গোল বৃত্তের মতো মিষ্টি পানির স্রোত ঘুরছে। একটি লবণাক্ত পানির স্রোত এসে মিষ্টি পানির স্রোতের সাথে মিলিত হয়েছে, কিন্তু সে পানি পরস্পর মিলিত হয়ে আপন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে না। রাব্বুল আলামীন এমন এক অদৃশ্য প্রহরার ব্যবস্থা সেখানে করেছেন, যেন তারা পরস্পর মিলিত হতে না পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِينِ بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لا يَبْغِينِ

        দুটো সমুদ্রকে তিনি প্রবাহিত করেছেন, যেন পরস্পরে মিলিত হয়। এরপরেও উভয়ের মাঝে একটি আবরণ আড়াল হয়ে রয়েছে, যা তারা অতিক্রম বা ললংঘন করে না। (সূরা রাহমান-২০)

Post a Comment

0 Comments