হুনাইনের প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজিত ইসলামের শত্রুদের কয়েক হাজার বাহিনী আওতাস নামক স্থানে এসে জমায়েত হয়েছিল। নবী করীম (সা:) দুশমনদের মুকাবেলায় হযরত আবু আমের আশয়ারী (রা:) কে কিছু সৈন্যসহ প্রেরণ করলেন। তিনি আওতাস নামক স্থানে পৌঁছার পর প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলো। হযরত আবু আমের (রা:) প্রতিপক্ষের হাতে শাহাদাত বরণ করলেন। এমনকি তাঁর হাতের পতাকা শত্রুদের হাতে চলে গেল।
হযরত আবু আমের (রা:) এর চাচাত ভাই হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা:) এগিয়ে গিয়ে শত্রু পক্ষের ওপরে তীব্র আক্রমন করলেন। শত্রুপক্ষ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো। মুসলমানদের হাতে প্রচুর গণীমাতের সম্পদ জমা হলো। বহু সংখ্যক বন্দীও হলো। এই বন্দীদের মধ্যে নারী এবং শিশুও ছিল। হযরত হালিমা তুসসাদিয়া (রা:) এর বড় মেয়ে সায়মাও বন্দী হলেন, তিনি ছিলেন নবী করীম (সা:) এর দুধবোন।, তাঁকে যখন বন্দী করা হয় তখন তিনি বলেছিলেন, 'আমি তোমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর দুধবোন। আমি তাঁকে শিশুকালে কোলে রাখতাম'।
এ কথা শোনার পরে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর কথার সততা প্রমাণের জন্য তাঁকে সম্মানের সাথে নবীর দরবারে উপস্থিত করলেন। সায়মা আল্লাহর রাসূলের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললো, 'হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! আমি আপনার দুধবোন। আপনি যখন শিশু ছিলেন তখন আপনাকে আমি কোলে রাখতাম'।
মানবতার মহান মুক্তিদূত বিশ্বনবী (সা:) পলকহীন দৃষ্টিতে সায়মার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, তাঁর পবিত্র চোখ দু'টোয় অশ্রু টলমল করছে। স্মৃতিতে ভেসে উঠলো স্নেহময়ী দুধমাতা হযরত হালিমার কথা। আল্লাহর নবী উঠে দাঁড়িয়ে দুধবোন সায়মাকে সম্মান প্রদর্শন করলেন। শ্রদ্ধেয়া বড় বোনকে রেসালাতে নববীর পাশে বসার জন্য নিজের চাদর মুবারক বিছিয়ে দিলেন। নবী করীম (সা:) মমতা জড়ানো কণ্ঠে সায়মার কুশলাদি জানলেন। বোন সায়মা অবাক হয়ে শিশুকালে যাকে কোলে রাখতেন আর তাঁর প্রশংসা এবং দোয়া করে কবিতা পাঠ করতেন তাঁকে প্রাণভরে দেখলেন।
বিশ্বনবী (সা:) এর শিশুকালে সায়মা ছিলেন বয়সে কিশোরী। তিনিই শিশুনবীকে কোলে নিয়ে ঘুরতেন। শিশুনবীকে তিনি আদর করতেন আর কবিতা আকারে বলতেন, 'আমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সা:) জীবিত থাক। সে সুন্দর সুঠামদেহী বলিষ্ঠ যুবক হোক, আমরা তাকে দু'নয়নভরে দেখবো। নেতা হয়ে সে যেন ইয়েমেন নিজের অধিকারে নিতে পারে। তাঁর সাথে যারা শত্রুতা করবে তাদের যেন মঙ্গল না হয়। হে আল্লাহ, তাঁকে অসীম সম্মানের অধিকারী করে দাও'।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন সায়মা। তাঁর সেই কিশোরী বয়সের প্রার্থনা মহান আল্লাহ কবুল করেছিলেন! তাঁর দুধভাই আজ আল্লাহর নবী, বিপুল ক্ষমতা এবং অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী। তাঁর দুধভাই তাকে ভুলে যাননি। নবী করীম (সা:) পরম মমতায় তাঁর বোনকে বললেন, 'বোন, তোমার যদি মন চায় তাহলে আমার কাছে বসবাস করতে পারো। আর যদি তুমি তোমার বাড়িতে ফিরে যেতে চাও তাহলে আমি তোমাকে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছি'।
সায়মা নিজের পরিবার-পরিজনের কাছেই ফিরে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আল্লাহর নবী (সা:) উপঢৌকন দিয়ে সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে দুধবোনকে যথাস্থানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলেন। শৈশবে যারাই নবী (সা:) কে স্নেহ-মমতা প্রদর্শন করেছে তিনি তাদেরকে অসীম শ্রদ্ধা করতেন এবং তাদের প্রতি তাঁর কর্তব্যবোধের কথা স্মরণ রাখতেন।
মানবতার শত্রু আবু লাহাবের দাসী সুয়ায়বার দুধ তিনি শিশুকালে কয়েক দিন পান করেছিলেন, এ কারণে সে জীবিত থাকা পর্যন্ত নবী করীম (সা:) তাঁর প্রতি যত্নের দৃষ্টি রেখেছেন, তেমনি হযরত হালিমার প্রতিও তিনি তাঁর কর্তব্য পালনে ছিলেন সজাগ। মক্কা ছেড়ে নবী করীম (সা:) যখন মদীনায় হিজরত করেছিলেন তখনও তিনি তাঁর দুধ মা সুয়ায়বার জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় ও অর্থ প্রেরণ করতেন। হযরত খাদিজার (রা:) এর সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরে হযরত হালিমা রাসূল (সা:) এর কাছে এসেছিলেন। তাঁকে দেখেই তিনি নিজের পবিত্র শরীরের চাদর বিছিয়ে বসতে দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, 'আসুন আমার আম্মা আসুন!'
হযরত হালিমা (রা:) আল্লাহর নবীকে জানালেন, 'আমাদের অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে এবং সে কারণে আমাদের পশু সম্পদ সব নিঃশেষ হয়ে গেছে'। দুধ মায়ের মুখে অভাবের কথা শুনে তিনি ৪০ টি ছাগল এবং একটি উটের ওপরে নানা ধরনের সামগ্রী দিয়ে দিলেন। ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, হুনাইনের যুদ্ধের সময় নবীর দুধমাতা তাঁর কাছে যখন এসেছিলেন সে সময় রাসূল (সা:) নিজের পবিত্র চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে দিয়েছিলেন। হযরত হালিমা (রা:) আল্লাহর নবীর কাছ থেকে শুনে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর কাছ থেকে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা:) রেওয়ায়েত করেছেন। (ইবনুল বার-আল্ ইস্তিয়াব)
বনী সাআদ ছিল হাওয়াজেন গোত্রের একটি শাখা। সে সময় হাওয়াজেন গোত্রের খ্যাতি ছিল যে, তারা স্পষ্ট উচ্চারণে আরবী ভাষা বিশুদ্ধভাবে বলে থাকে। ইবনে সাআদ উল্লেখ করেছেন, বিশ্বনবী (সা:) বলেছেন, 'আমি তোমাদের মধ্যে উত্তম বিশুদ্ধ ভাষী। কারণ আমি কুরাইশ বংশের লোক এবং আমার ভাষা হচ্ছে হাওয়াজেন গোত্রের ভাষা'।
নবী করীম (সা:) যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন না। যদি তাদেরকে মুক্ত করার জন্য তাদের আত্মীয়-স্বজন আসে, এ জন্য তিনি কিছুদিন অপেক্ষা করলেন। অশেষে হাওয়াজেন গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এসে নবী করীম (সা:) এর কাছে করুণ আবেদন জানালো, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছি কিন্তু আমাদের অপরাধ সীমাহীন। আপনি আমাদের অপরাধের দিকে অনুগ্রহ করে দৃষ্টি দিবেন না। আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের মা-বোন ও সন্তানদের ফেরৎ দিন'।
যারা বন্দীদের মুক্ত করতে এসেছিল তারা সকলেই ছিল হযরত হালিমা (রা:) এর গোত্রের। এই গোত্রের নেতা জুহায়ের ইবনে সুরাদ (রা:) আবেদন করলেন, 'বন্দীদের মধ্যে আপনার দুধমাতার আত্মীয়-স্বজন অর্থাৎ আপনার খালা, ফুফুগণ রয়েছেন। মহান আল্লাহর শপথ! আরবের রাজা-বাদশাহর মধ্যে কেউ যদি আমাদের বংশের কারো দুধপান করতো, তাহলে তার কাছে আমরা অনেক কিছুই আবদার করতে পারতাম। পক্ষান্তরে আমরা আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা সবথেকে বেশি'। তাদের আরেকজন আবেদন জানালো, 'শিশুকালে আপনি আমাদের মাঝেই পালিত হয়েছেন। আজ আপনার অতুলনীয় মর্যাদা! শৈশবের কথা স্মরণ করে আপনার দুধমাতার আত্মীয়দের মুক্তি দিন'।
তাদের কথা শুনে শৈশবের স্মৃতি এসে নবী করীম (সা:) কে নাড়া দিয়ে গেল। তিনি তাদেরকে একদিন অপেক্ষা করতে বললেন। সাহাবায়ে কেরামের সাথে তিনি পরামর্শ করে বললেন, 'আমার গোত্রের যে দাবী আছে বন্দীদের ওপর আমি তা ত্যাগ করছি'।
রাসূল (সা:) এর কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম জানালেন, 'আমরাও বন্দীদের প্রতি আমাদের দাবী ত্যাগ করছি'।
দুইজন অমুসলিম তাদের দাবী ছাড়লো না। নবী করীম (সা:) তাদেরকে বললেন, 'তোমরা তোমাদের দাবী ত্যাগ করো, তোমাদের যা প্রাপ্য আমি আদায় করবো। আমিই তোমাদের প্রাপ্য শোধ করবো'।
আল্লামা শিবলী (রাহ:) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা:) হাওয়াজেন গোত্রের লোকদেরকে বলেছিলেন, 'আমি আমার গোত্রের লোকদের নির্ধারিত অংশ ত্যাগ করতে পারি। তোমরা এমন করতে পারো, নামাজ আদায় শেষে সমবেত লোকদের সামনে তোমাদের আবেদন পেশ করো'।
তাঁরা রাসূল (সা:) এর পরামর্শ অনুযায়ী যুহরের নামাজ শেষে আবেদন করলে নবী করীম (সা:) নিজের গোত্রের অধিকার ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করেন। তাঁর ঘোষণা শুনে সকল সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের অধিকার ত্যাগের ঘোষণা দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার নারী, শিশু, বালক-বালিকা মুক্তি লাভ করেছিল। এতগুলো মানুষকে দীর্ঘ প্রায় এক মাস প্রতিপালন করতে গিয়ে মুসলমানদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল। নবী করীম (সা:) কোনো বিনিময় গ্রহণ করলেন না। শুধু তাই নয়, প্রতিটি বন্দীকে নতুন পোষাক দিয়ে তিনি বিদায় করেছিলেন। পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্দীদের প্রতি এমন অপূর্ব ব্যবহার অন্য কোনো জাতির ইতিহাসে নেই। আধুনিক যুগের গণতন্ত্রের দাবীদাররা সম্পদের লোভে শুধু ভিন্ন দেশ দখলই করছে না, দেশ দখলে যেসকল দেশ প্রেমিকগণ বাধা দিয়েছে, যুদ্ধবন্দীর নামে তাদেরকে গ্রেফতার অবর্ণনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করছে। এরাই লুণ্ঠিত সম্পদ ব্যবহার করে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী অপপ্রচার করছে।
0 Comments