নামায আদায়ের পূর্ব শর্ত কি

        নামায আদায় তথা নামাযে দন্ডায়মান হবার পূর্ব শর্ত হলো, প্রস্তুতি গ্রহণ করা। অর্থাৎ প্রথমে তাহারাত বা পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। দৈহিকভাবে পবিত্র হতে হবে এবং পরিধেয় বস্ত্রও পবিত্র হতে হবে। যে স্থানে নামায আদায় করা হবে, সেই স্থানও পবিত্র হতে হবে। কেউ যদি জেনে বুঝে অপবিত্র দেহে, পোষাকে বা অপবিত্র স্থানে নামায আদায় করে, তাহলে তার নামায তো হবেই না, সেই সাথে ব্যক্তি গোনাহগার হবে। মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত নামায গ্রহণযোগ্য নয়। পবিত্রতা অর্জনের ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَثِيَابَكَ فَطَهُرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ

          এবং নিজের পরিধেয় পোষাক পবিত্র রাখো। আর মলিনতা অপরিচ্ছন্নতা থেকে দূরে অবস্থান করো। (সূরা আল মুদ্দাস্স্সির-৪-৫)

        বিজ্ঞ তাফসীরকারগণ কোরআনের এই আয়াতের ব্যাপক তাফসীর করেছেন। প্রকৃতপক্ষে উক্ত আয়াতের মর্মও বড় ব্যাপক। ছোট একটি কথা দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালা ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে একটা অর্থ হলো, পরিধেয় পোষাক পাক-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখা। পোষাক মানুষের মনের ওপরে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে এতে কোন সন্দেহ নেই। এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর বিশেষ পোষাক নির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষকগণ বলেছেন, পোষাক-পরিচ্ছেদের পবিত্রতা এবং আত্মার পবিত্রতা অবিচ্ছিন্ন। একটার সাথে আরেকটা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

        পবিত্র রুচি সম্পন্ন কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয় সে পুঁতিগন্ধময় কোন খাদ্য তাঁর মুখ গহ্বর দিয়ে দেহে প্রবেশ করাবে। সুতরাং, কোন পবিত্র আত্মার পক্ষেও সম্ভব নয় সে কোন অপবিত্র দেহের ভেতরে বাস করবে। কোন পবিত্র দেহের পক্ষেও সম্ভব নয় সে নিজেকে অপবিত্র অপরিচ্ছন্ন পোষাকে আবৃত রাখবে। মহান আল্লাহ পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন। তিনি অপবিত্রতা প্রশ্রয় দেননা।

        আরবী 'তাহের বা তাহারাত' শব্দের অর্থ শুধু বাহ্যিক পবিত্রতা নয়। অন্তরের কলুষতা দূর করাকেও বোঝায়। পবিত্রতা বা তাহারাতকে কোরআন যে অর্থে উপস্থাপন করেছে, পৃথিবীর এমন কোন ভাষা নেই যে, সে ভাষার একটি শব্দ তাহারাতের সমার্থক হতে পারে বা পবিত্রতার ব্যাপক ধারণা পেশ করতে পারে। পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করাও পবিত্রতা এবং পাপের ভেতরে নিজেকে জড়িত করাকে অপবিত্রতা বলা হয়েছে। কোন অন্যায় কাজ বা মিথ্যা কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখার অর্থও হলো পবিত্রতা। মিথ্যা কথা বলা অপবিত্রতা।

        এভাবে যাবতীয় অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, অত্যাচার, অপরিচ্ছন্নতা, মিথ্যা, চিন্তার জগতে অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকাকেই পবিত্রতা বলা হয়েছে। দেহ এবং দেহের পোষাক পবিত্র-এটা তো বাহ্যিক পবিত্রতা মাত্র। চিন্তার জগৎ হতে যাবতীয় অপরিচ্ছন্নতা এবং অপবিত্রতা দূর করতে হবে। অজ্ঞানতা তথা মূর্খতাও এক ধরণের অপবিত্রতা। এ সমস্ত অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকার নামই হলো পবিত্র কোরআনের ভাষায় তাহারাত।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং পবিত্র এবং পবিত্রতা তিনি ভালোবাসেন- এ কথা পবিত্র কোরআনে তিনি বার বার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ

        যারা পাপকাজ থেকে বিরত থাকে ও পবিত্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা বাকারা-২২২)

        শুধুমাত্র নামায আদায় করার পূর্বেই নয়- প্রত্যেক মুসলমানকে সর্বাবস্থায় শারীরিক ও পোষাকের দিক থেকে পবিত্র থাকতে হবে। মুসলিম শরীফের হাদীসে বলা হয়েছে, পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক। প্রকৃতপক্ষে পবিত্রতা হলো সেইসব ভিত্তিসমূহের একটি, যেসব ভিত্তির ওপর আল্লাহর তা'য়ালার দ্বীন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। ইসলাম মানুষকে পরিপূর্ণ পবিত্রতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ইসলাম একটি সুন্দর ও পরিপূর্ণ এবং পরিচ্ছন্ন জীবন বিধান। এর কাঠামোর বাইরের দিক যেমন সুন্দর ও পবিত্র, অনুরুপভাবে এর ভেতরের দিকও অতিব পবিত্র এবং সুন্দর। মহান আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্রতা অর্জনের প্রতি কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, তা পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াতের দিকে দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট অনুধাবন করা যাবে। সূরা বাকারার ২২২ নং আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ

        ঋতুস্রাব চলাকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকো এবং তাদের নিকটে গমন করো না যতক্ষণ না তারা পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হয়। তারা যখন পবিত্র হবে, তখন তাদের কাছে যাও, ঠিক সেইভাবে যেভাবে যেতে আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন।

وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا 

        আর তোমরা যদি অপবিত্র হয়ে থাকো, তবে পবিত্র হয়ে নাও। (সূরা মায়িদা-৬)

وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَلِدُونَ 

        সেখানে তাদের জন্য থাকবে পবিত্র স্ত্রীরা। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সূরা বাকারা-২৫)

خلِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ 

        চিরকাল তারা সেখানে থাকবে। পবিত্র স্ত্রীরা হবে তাদের সঙ্গী। আল্লাহর সন্তুষ্টি দ্বারা তারা সৌভাগ্যমন্ডিত। (সূরা আলে ইমরাণ-১৫)

        পবিত্রতা একদিকে যেমন ঈমানের অংশ, অপরদিকে তা মুসলিম হবারও অন্যতম শর্ত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম বর্ণনা করেছেন, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম মানুষকে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইসলাম কি? তিনি জবাবে বলেছিলেন, ইসলাম হলো- তুমি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো আদেশদাতা নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। নামায প্রতিষ্ঠিত করবে, যাকাত পরিশোধ করবে, হজ্জ আদায় করবে, উমরাহ্ করবে, অপবিত্রতা দূর করার জন্য গোসল করবে, অযু পূর্ণ করবে, রমযানের রোযা পালন করবে। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম জানতে চাইলেন, এগুলো আদায় করলে কি আমি মুসলিম হতে পারবো? আল্লাহর রাসূল জবাব দিলেন, হ্যাঁ। আল্লাহর ফেরেস্তা বললেন, আপনি সঠিক কথাই বলেছেন। (বোখারী)

        সুতরাং ইসলামে পবিত্রতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা, তা উল্লেখিত কোরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীস থেকেই অনুধাবন করা যায়। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর মানুষকে পবিত্রতা সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণাই দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম ব্যতীত কোনো মতবাদ-মতাদর্শ বা ধর্মের নামে যেসব মত, পথ ও প্রথা পৃথিবীতে চলে আসছে, এসব আদর্শ বা ধর্মে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার কোনো গুরুত্ব নেই। বরং ধর্ম নামে পরিচিত কতক ধর্মে অপবিত্র বস্তু বা অপবিত্রতা ব্যতীত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই পালন করা নিষিদ্ধ। স্রষ্টার নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবে তারা যে সাধনার পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে, সেই সাধনা করতে হলে নানা ধরনের অপবিত্র বস্তু প্রয়োজন- এমনকি মদ ও নারীর ঋতুস্রাবের রক্তের মতো অপবিত্র বস্তুরও প্রয়োজন হয়।

        সারা পৃথিবীর মানুষকে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। দাঁত পরিষ্কার করতে হবে, গোসল করতে হবে, মল-মূত্র ত্যাগ করার পর কুলুপ ও পানি ব্যবহার করতে হবে; দেহ থেকে বীর্য নির্গত হলে গোসল করতে হবে, চুল, দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে কেটে চিরুনী ব্যবহার করতে হবে, দেহের অপ্রয়োজনীয় পশম পরিষ্কার করতে হবে, পোষাক পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, খাদ্য গ্রহণের পূর্বে ও পরে হাত ধুতে হবে, বাসন-পত্র পরিষ্কার করতে হবে, দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত থাকতে হবে ইত্যাদি শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। মুসলিম ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য মানব সম্প্রদায় এখন পর্যন্ত পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা, রুচি ও সৌন্দর্যবোধের পরিপূর্ণ ধারণা পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি। এসব লোক যেসব দেশে বাস করে, সেসব দেশ ভ্রমণ করলে ও তাদের সাথে মেলামেশা করলে স্পষ্ট বুঝা যায়, পবিত্র-পরিচ্ছন্নতা, রুচি ও সৌন্দর্যবোধের কতটা দৈন্যতায় তারা জীবন-যাপন করে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এসব লোক মুখ না ধুয়েই চা পান করে থাকে। পশ্চিমা সভ্যতায় এর নাম দেয়া হয়েছে বেড-টি।

        পক্ষান্তরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য রয়েছে, এমন কোনো পাত্র উন্মুক্ত রাখতে নিষেধ করেছেন। পাত্র খোলা থাকলে এর মধ্যে নানা ধরনের পোকা-মাকড় বা অখাদ্য কিছু পড়তে পারে। তিনি বলেছেন- যখন তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠবে, তখন সে যেন নিজের হাত পরিপূর্ণ পাত্রে না ডুবায়। যতক্ষণ না সে হাত পরিষ্কার করে ধুয়ে নেবে তিনবার। (মুসলিম)

        পবিত্রতা অর্জনের ব্যাপারে ইসলাম এতটা গুরুত্ব দিয়েছে যে, গোসল আর অযু করে পবিত্র হবার জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব দেখা দিলে পবিত্র মাটি ব্যবহার করে পবিত্রতা অর্জন করতে বলা হয়েছে। মাটি ব্যবহার করে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতিকে ইসলাম তায়াম্মুম নামে অভিহিত করেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াতে বলেছেন-

فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا

        অতপর যদি পানি না পাও, তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করো। (সূরা নিসা) 

        হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নামাযের জন্য উঠবে, তখন তোমরা নিজেদের মুখমন্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত করবে, মাথার ওপর হাত ঘুরাবে এবং পা গোড়ালী পর্যন্ত ধুবে। অপবিত্র অবস্থায় থাকলে গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করবে। আর যদি রোগাক্রান্ত হও অথবা পথে-প্রবাসে থাকো বা তোমাদের কোনো লোক মল-মূত্র ত্যাগ করে আসে বা তোমরা যদি নারীকে স্পর্শ করো আর যদি পানি পাওয়া না যায়, তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তার ওপর হাত রেখে নিজেদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় মাসেহ করে নাও। (সূরা মায়িদা-৬)

        পবিত্রতা অর্জন করে নামায আদায় করার গুরুত্ব সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি পবিত্রতা গ্রহন করে এবং মহান আল্লাহর নির্ধারিত পন্থায় পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করে এরপর এভাবে পবিত্রতাসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, তার এই নামাযসমূহ প্রতি দুই ওয়াক্ত নামাযের মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহের কাফফারা স্বরূপ। (মুসলিম)

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে অযু করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এই কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন-

مَنْ تَوَضًا فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدَهِ حتى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِهِ

        যে ব্যক্তি অযু করে। পূর্ণ নিয়ম-নিষ্ঠার সাথে অযুকে পূর্ণ করে। তার দেহ থেকে তার সমস্ত পাপ-পঙ্কিলতা বের হয়ে যায়। এমনকি তা বের হয়ে যায় তার নখের নিচে থেকে পর্যন্ত। (বোখারী-মুসলিম)

        তিনি আরো বলেছেন- অযুর পরিপূর্ণতার কারণে কিয়ামতের দিন তোমরা হস্ত ও মুখমন্ডলের উজ্জ্বলতার অধিকারী হবে। (বোখারী- মুসলিম)

        একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে সেসব কাজের কথা বলবো না, যেসব কাজ করলে আল্লাহ তা'য়ালা গোনাহ্ ক্ষমা করে দেন? সাহাবায়ে কেরাম নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলবেন। তিনি বললেন- সেসব কাজ হলো, কষ্ট এবং মন না চাইলেও অযু পূর্ণ করা। মসজিদে যেতে অধিক অধিক পা ফেলা এবং এক ওয়াক্ত নামায শেষ হলে অন্য ওয়াক্ত নামায আদায় করার অপেক্ষায় থাকা। এটা হলো তোমাদের জন্য প্রকৃত রিবাত। (মুসলিম)

        শেষের কথাটি তিনি দুই বার উচ্চারণ করেছেন। আরবী ভাষায় রিবাত বলা হয়, ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা দেয়ার লক্ষ্যে নির্মিত ছাউনীকে। অর্থাৎ এসব ছাউনী থেকে যেমন শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা হয়, অনুরূপভাবে হাদীসে বর্ণিত উক্ত কাজগুলো যথাযথভাবে আদায় করলে একজন মুসলমান শয়তানের আক্রমণও প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।

        ইসলাম প্রত্যেক নারী-পুরুষের নিকটই পবিত্রতা দাবি করে এবং এ ব্যাপারে উভয়ের জন্য একই নির্দেশ দিয়েছে। অপবিত্রতার অবস্থা যদি এমন হয় যে, যা গোসল না করা পর্যন্ত দূর হবে না, তাহলে নারী-পুরুষ উভয়কেই ইসলাম গোসলের নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াতে গোসল না করে অর্থাৎ অপবিত্র অবস্থায় নামায আদায় দূরে থাক- নামাযের ধারে কাছেও আসতে নিষেধ করা হয়েছে।

        যে স্থানে নামায আদায় করা হবে, সেই স্থানও পৰিত্র হতে হবে। জেনে বুঝে অপবিত্র স্থানে নামায আদায় করলে নামায যেমন হবে না, তেমনি ব্যক্তিকে গোনাহগার হতে হবে। ইসলাম এভাবে মানুষকে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার দিকে আকৃষ্ট করেছে। পরিধেয় বস্ত্র তা কম মূল্যের বা পুরনো হোক না কেনো, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হতে হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় মসজিদে নববীতে বসে আছেন। একজন সাহাবী মলিন পোষাকে অবিন্যস্ত চুলে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে সালাম জানালেন। তিনি সালাম জবাবের না দিয়ে বললেন, এই ব্যক্তির কি পোষাক পরিচ্ছন্ন করার মতো কিছু জুটে না? মাথার চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়াতে পারে না? আল্লাহর রাসূলের কথা শুনে ঐ ব্যক্তি দ্রুত সেখান থেকে বাড়িতে গিয়ে পরিচ্ছন্ন পোষাক পরে এবং মাথার চুলগুলো সুন্দরভাবে আঁচড়িয়ে নবীজীর সামনে উপস্থিত হয়ে সালাম জানালেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, দেখোতো- এখন তোমাকে কি সুন্দর লাগছে! আর একটু পূর্বে তোমাকে শয়তানের মতো দেখাচ্ছিলো

        অনেকে বাড়িতে একাকী যখন নামায আদায় করে, তখন এমন পোষাক পরিধান করে নামায আদায় করে, যে পোষাক পরিধান করে সেই ব্যক্তি বাড়িতে আগত কোনো অতিথির সামনে উপস্থিত হন না। মানুষ সাধারণতঃ কোনো সম্মানিত মর্যাদাবান ব্যক্তি বা উচ্চ পদস্থ কারো সাথে দেখা করতে যাবার সময় নিজেকে যথাসম্ভব উত্তম পোষাকে সজ্জিত করে, চুল-দাড়ি পরিপাটি করে তারপর অভিষ্ট ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। কিন্তু যে আল্লাহ তা'য়ালা সর্বাধিক সম্মান-মর্যাদার অধিকারী, সেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে যখন দাঁড়ানো হয়, তখন নিজেকে সুন্দর পোষাকে সজ্জিত করা এবং নিজেকে পরিপাটি করে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় না। এটা মহান আল্লাহ তা'য়ালার সম্মান-মর্যাদা সম্পর্কে উদাসীনতার শামিল।

        এটা করা যাবে না, বরং নামায আদায় করতে হবে, উত্তম পোষাক পরিধান করে। হাদীসে বলা হয়েছে, 'যখন তোমরা আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হরে, তখন সর্বোত্তম পোষাকে উপস্থিত হবে।' সামর্থ থাকার পরও ময়লাযুক্ত পোষাক পরিধান করে নামায আদায় করা মহা অন্যায় এবং এ জন্য আদালতে আখিরাতে জবাবদিহি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ তা'য়ালা কৃপণতা পছন্দ করেন না। এই কৃপণতা আল্লাহর ক্ষেত্রে হোক বা তাঁর বান্দার ক্ষেত্রেই হোক। আল্লাহ বলেন-

الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسِ بِالْبُخْلِ وَيَكْتُمُونَ مَا اتَهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَفِرِينَ عَذَابًا مُّهِيْنًا

        সেই সব লোককে আল্লাহ পছন্দ করেন না, যারা কার্পণ্য করে এবং অন্য লোককেও কার্পণ্য করার উপদেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দান করেছেন, তা গোপন রাখে। এ ধরনের অকৃতজ্ঞ-নি'মাত অস্বীকারকারী লোকদের জন্য আমি অপমানকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি। 
(সূরা নিসা-৩৭)

        মহান আল্লাহর নি'মাত গোপন করে রাখার অর্থ হলো, এমনভাবে পৃথিবীতে জীবন-যাপন করা, দেখলে যেন মনে হয় যে, এই লোকটির প্রতি মহান আল্লাহ তা'য়ালা কোনো ধরনের অনুগ্রহ করেননি। যেমন আল্লাহ তা'য়ালা যাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে নিজের সামর্থ থাকার পরও এমন নিম্নতম মানে জীবন-যাপন করে, দেখলে মনে হবে এই লোকটির চেয়ে হতদরিদ্র আর দ্বিতীয় কেউ নেই। সে নিজের জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে না, নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করে না, এমনকি মহান আল্লাহর রাস্তায় একটি কানাকড়িও ব্যয় করে না। তার পরনের পোষাক ও চাল-চলন দেখলে মনে হবে, সে দরিদ্রতার নিম্ন সীমায় অবস্থান করছে। মূলত এর চেয়ে মহান আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা আর কিছুই হতে পারে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- 'আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে নি'মাত দেন, তখন তিনি তার ওপর সেই নি'মাতের বাহ্যিক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতে ভালোবাসেন।' অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির দৈনন্দিন আহার, পোষাক ও দান-খয়রাত ইত্যাদি প্রতিটি ব্যাপারে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর দেয়া নি'মাতের প্রভাব দেখতে চান। সুতরাং অবহেলিত বা অন্যের সামনে যে পোষাক পরিধান করে উপস্থিত হতে লজ্জানুভব হয়, এমন পোষাক পরিধান করে মহান আল্লাহর সম্মুখে তথা নামাযে দন্ডায়মান হওয়া যাবে না।

        সুতরাং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা হলো মহান আল্লাহর গোলামদের গুণ-বৈশিষ্ট্য। আর অপবিত্রতা হলো শয়তান ও তার অনুগামীদের গুণ-বৈশিষ্ট্য। নামায আদায় করার অর্থ হলো, মহান আল্লাহকে সিজদা করা তথা মহান আল্লাহর দাসত্ব করা হবে- এই স্বীকৃতি প্রদান করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং পবিত্র এবং তিনি তাঁর গোলামদেরকেও পবিত্র দেখতে চান। তাঁর সমীপে অপবিত্রতার স্থান নেই এবং অপবিত্র অবস্থায় তাঁকে সিজদা দেয়ারও অবকাশ নেই। সুতরাং নামায আদায়ের পূর্বশর্ত হলো পবিত্রতা অর্জন এবং এই পবিত্রতা শুধুমাত্র বাইরেরই নয়- ভেতরের দিক থেকেও মানুষকে পবিত্র হতে বলা হয়েছে। মানুষ কল্পনার জগতে যেন অপবিত্রতার কোনো স্থান না দেয়, এ জন্য পবিত্র কোরআনের মহান আল্লাহর গুণাবলীর উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের মনে যেসব কল্পনার উদ্রেক হয়, সে সম্পর্কেও অবগত আছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

أنَّ اللَّهَ عَلامُ الْغُيُوبِ

        আল্লাহ জানেন এবং যা অদৃশ্য তাও তিনি বিশেষভাবে জানেন। (সূরা তওবা-৭৮)

عَلِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

        তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাগাবুন-১৮)

        মানুষের মন-মস্তিষ্ক কখন কি চিন্তা-পরিকল্পনা করে, মনের গহীনে কখন কোন্ মুহূর্তে কি কল্পনা ও আশার উদ্রেক হয়, তা জানার মতো কোনো যন্ত্র আবিষ্কার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের মনের জগৎ তথা চিন্তার জগৎ অজ্ঞাত নয়। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَإِنَّ رَبَّكَ لَيَعْلَمُ مَا تُكِنُّ صُدُورُهُمْ وَمَا يُعْلِنُونَ

        তাদের অন্তর যা গোপন করে এবং তারা যা প্রকাশ করে, তা তোমার প্রতিপালক অবশ্যই জানেন। (সূরা নামল-৭৪)

أَوْ لَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَلَمِينَ

        বিশ্ববাসীর অন্তঃকরণে যা আছে, আল্লাহ তা'য়ালা কি তা সম্যক অবগত নন? 
(সূরা আনকাবুত-১০)

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ

        আর আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি। আমি তার কাছে তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর। (সূরা কাফ-১৬)

        মানুষে একা একা নীরবে নির্জনে মনে মনে যে চিন্তা-কল্পনা করে, সেটা যেমন আল্লাহ তা'য়ালার জ্ঞানের বাইরে নয়, তেমনি দুই জন মানুষ যখন কোথাও নির্জনে গোপন সলাপরামর্শ করে, সেটাই আল্লাহর কাছে অজানা থাকে না। সর্বত্র আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতা বিরাজ করছে। সূরা মুজাদালায় আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

        তুমি কি অনুধাবন করো না, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ তা'য়ালা তা জানেন, নন, তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোনো গোপন পরামর্শ হয় না যেখানে চতুর্থজন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না; এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে এমন কোনো গোপন পরামর্শ হয় না- যেখানে ষষ্ঠজন হিসেবে যিনি উপস্থিত থাকেন না, তারা এর চেয়েও কম হোক বা বেশী হোক, তারা যেখানেই থাকুক না কেনো, আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন। তারা যা কিছু করে, তিনি তাদেরকে কিয়ামতের দিন তা জানিয়ে দেবেন। আল্লাহ তা'য়ালা সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত। (আয়াত-৭)

         অদৃশ্যের কুঞ্জি তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে ও স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত। তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কেনো বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই। (সূরা আনআম-৫৯)

وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَّبِّكَ مِنْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ

        আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অণু-পরিমাণও তোমার প্রতিপালকের অগোচর নয়। (সূরা ইউনুস-৬১)

رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِى وَمَا نُعْلِنُ وَمَا يَخْفَى عَلَى اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ

        হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি জানো যা আমরা গোপন করি ও প্রকাশ করি। আকাশ ও যমীনে কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে গোপন নয়। (সূরা ইবরাহীম-৩৮)

        এসব কথা এজন্যই বলা হয়েছে, মানুষ যেন শুধুমাত্র দৈহিক তথা বাহ্যিক পবিত্রতাই অর্জন না করে, মনের পবিত্রতাও অর্জন করে। মনের জগতে কোনো ধরনের অপবিত্রতা তথা পাপ-পঙ্কিলতা যেন স্থান না দেয়। তবুও মানুষের মন- সামান্য অসতর্ক হলেই নানা ধরনের পাপ-কল্পনা তথা অপবিত্রতা এসে মনের জগতে ভীড় জমায়। মনের জগতের এই অপবিত্রতার বিষয়টি আল্লাহ তা'য়ালার জ্ঞানের বাইরে নয় এবং এ ব্যাপারে তিনি আখিরাতের ময়দানে বান্দার কাছে জানতে চাইবেন। এরপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দিবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিবেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ فَيَغْفِرُ لِمَنْ يُشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ

        তোমাদের মদের কথা প্রকাশ করো আর না-ই করো, আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের কাছ থেকে সেই সম্পর্কে হিসাব গ্রহণ করবেন। এরপর যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন।
  (সূরা বাকারা-২৮৪)

        সুতরাং নামাযের প্রথম শিক্ষা হলো, দেহ-মন ও পোষাকের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষকে পবিত্র ও রুচিবান করে গড়ে তোলা। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি যদি পবিত্র ও রুচিবান হয়, তাহলে সেই সব ব্যক্তি সমষ্টিগতভাবে যে সমাজ গড়বে, সেই সমাজও পবিত্র তথা পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকবে। অর্থাৎ অপরাধমুক্ত সমাজ গঠিত হবে। এভাবে অপরাধমুক্ত সমাজের সমন্বয়ে যে রাষ্ট্র গঠিত হবে, সেই রাষ্ট্রই কেবলমাত্র শোষণ মুক্ত সুখী-সমৃদ্ধশালী ও নিরাপত্তাপূর্ণ রাষ্ট্র হতে পারে।

Post a Comment

0 Comments