অগণিত মানুষ যদি একত্রে জামাআত বদ্ধ হয়ে নামায আদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তাহলে সেই জামাআতের ইমাম বা নেতা হতে হবে একজন। একের অধিক ইমাম বা নেতার নেতৃত্বে নামায আদায় করা যাবে না। কেউ যদি তা করে তাহলে তার নামায হবে না। এক কোটি মানুষ যদি কোথাও নামায আদায়ের উদ্যোগ নেয়, তাহলে সেই এক কোটি মানুষই একজন মাত্র নেতার আনুগত্য করবে।
এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, নামায হলো মুসলমানদের জীবনের যাবতীয় কাজের মডেল। এই মডেল সামনে রেখে মুসলমানরা অন্যান্য কাজ সম্পাদন করবে। জামাআতে নামাযে যাকে ইমাম বা নেতা বানানো হবে, সেই ব্যক্তি নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী কিনা তা যাচাই-বাছাই করে তারপর তাকে ইমাম বা নেতা বানানো হয়।
সাধারণত একটি এলাকা বা মহল্লার মসজিদে জামাআতে নামায আদায় করার জন্য একজনকে ইমাম নির্বাচন করা হয়। এমন একজন ব্যক্তিকে ইমাম বা নেতা হিসাবে বরণ করা হয়, যিনি এলাকার সকলের তুলনায় কোরআন-হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী। কোরআন-হাদীস অনুসারে জীবন-যাপন করেন, অর্থাৎ সৎ যোগ্য, আল্লাহ তা'য়ালাকে বেশী ভয় করেন এমন একজন লোককেই ইমাম বা নেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এলাকার সবথেকে বড় চোর, সন্ত্রাসী, চরিত্রহীন, দুর্নীতিবাজ বা কুখ্যাতির অধিকারী কোনো লোককে ইমাম বা নেতা হিসেবে বরণ করা হয় না। এমন লোককেও ইমাম বানানো হয় না, যার স্ত্রী-মেয়ে পর্দায় থাকে না বা ছেলে নামায আদায় করে না।
জামাআতে নামায এভাবে প্রশিক্ষণ দেয় যে, নিজ এলাকা, সমাজ বা দেশ- যেখানেই হোক না কেনো, গন্ডী যত ক্ষুদ্রই হোক- সেই গন্ডীতে যাকে নেতা হিসাবে নির্বাচিত করা হবে, তাকে ঐসব গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে, যে গুণ-বৈশিষ্ট্য মসজিদের ইমাম বা নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছিলো।
কোনো স্থানে কিছু লোক জমায়েত হয়েছে এ অবস্থায় নামাযের সময় হলো। ফরজ নামায জামাআতে আদায় করার ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন দেখা দেবে, উপস্থিত লোকদের মধ্যে থেকে কোন্ ব্যক্তিকে ইমাম বা নেতা নির্বাচিত করে তাঁর পেছনে নামায আদায় করা হবে। ইসলামের বিধান হলো, ইমাম বা নেতৃত্বের পদের জন্য কেউ প্রার্থী হতে পারবে না, কিন্তু যিনি ইমাম হবেন তাকে উপস্থিত ব্যক্তিদের আস্থাভাজন হতে হবে। উপস্থিত লোকজন তাকেই ইমাম বা নেতা নির্বাচিত করবে, যে ব্যক্তি উপস্থিত লোকদের কাছে সৎ-চরিত্রবান ও সর্বাধিক আল্লাহভীরু হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
এভাবে প্রতিদিন পৃথিবীর প্রত্যেক স্থানে অসংখ্যবার ইমাম বা নেতা নির্বাচিত করে জামাআতে নামায আদায় করা হচ্ছে, কিন্তু কোথাও কোনো বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে না। ইমাম বা নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেউ কারো পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে না, এখানে কোনো লোভ-লালসা বা প্রলোভনের স্থান নেই, কেউ কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে না, কেনো বিরোধী দল বা মতেরও সৃষ্টি হচ্ছে না। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইমাম বা নেতা নির্বাচন করে তার কমান্ডে অগণিত মানুষ জামাআতে নামায আদায় করছে। সাংগঠনিক জীবনে, সমাজ জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নামাযের নেতা নির্বাচনের শিক্ষা যদি বাস্তবে অনুসরণ করা হতো, তাহলে বর্তমানে নেতা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা দল-উপদল, হানাহানি, মারামারি ও হত্যার মতো মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হতো না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, যারা নামায আদায় করছেন, তাদের অধিকাংশই নামাযের এই শিক্ষা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছেন মা।
নামায যে পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন শিক্ষা দেয়, এই পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিপর্যয় বা বিশৃংখলার সৃষ্টি না হওয়ার কারণ তিনটি। প্রথম কারণই হলো নির্বাচনের উদ্দেশ্য। যারা ইমাম বা নেতা নির্বাচন করছেন এবং যিনি ইমাম বা নেতা নির্বাচিত হচ্ছেন, তাদের উভয়ের এ কথা স্পষ্ট জানা রয়েছে যে, এতে কারো কেনো স্বার্থ যেমন উদ্ধার হবে না, তেমনি কারো স্বার্থ ক্ষুণ্ণও হবে না। বরং উভয়ে একমাত্র মহান আল্লাহর বিধান অনুসরণ করবেন মাত্র। ইমাম বা নেতা যেমন নিজের স্বার্থে তার অনুসারীদেরকে ব্যবহার করতে পারবেন না, তেমনি মুক্তাদী বা অনুসারী দলও ইমাম বা নেতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবেন না।
দ্বিতীয় কারণ হলো, জামাআতে নামাযের ক্ষেত্রে ইমাম বা নেতা নির্বাচনকালে কেউ প্রার্থী হতে পারে না বা ইসলাম এই সুযোগ কাউকে দেয়নি। দল বা সংগঠনে নেতা নির্বাচনকালে কেউ প্রার্থী হবে, কেউ নেতা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে, কাউকে নেতা নির্বাচিত করার জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে-এসব বিষয় ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি কারো যদি ইশারা-ইঙ্গিতেও নেতা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ পায়, তাহলে তাকে সেই পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হবে।
নেতা নির্বাচন সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি, আমার লেখা 'আমি কেন জামাআতে ইসলামী করি' নামক গ্রন্থে। ইসলাম নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থী প্রথার বিলোপ সাধন করেছে। ইসলামী দল বা সংগঠনে কেউ প্রার্থী হতে পারবে না। যেখানে প্রার্থী প্রথা রয়েছে, সেখানেই একের পক্ষে অন্যের প্রচারণা, হিংসা-বিদ্বেষ, কান কথা, লোভ-লালসা, দল-উপদল, মারামারি, হত্যা তথা যাবতীয় অপকর্মের অস্তিত্ব রয়েছে। জামাআতে নামায নেতা নির্বাচনের যে পদ্ধতি শিক্ষা দেয়, সেখানে সর্বস্তরে শান্তি বজায় থাকে এবং একমাত্র যোগ্য ব্যক্তিই নেতা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পায় নির্বাচন পদ্ধতিও দুর্নীতি মুক্ত থাকে।
জামাআতে নামাযে নেতা নির্বাচনে মুক্তাদী বা অনুসারী দল তথা সর্বস্তরের ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। নির্বাচিত ইমাম বা নেতার কাছে যেমন যে কোনো ব্যক্তি অবাধে যাতায়াত করতে পারেন, তেমনি যে কোনো ব্যক্তির কাছে আল্লাহর বিধানের বিপরীত কাজ করলে তিনি জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। এ কারণেই আমরা সাহাবায়ে কেরামের জীবনে দেখতে পাই, তাঁরা নেতৃত্বের পদে আসীন হবার পরে তাঁদের কর্মনীতি, দৈনন্দিন জীবনধারা' তথা যাবতীয় কাজের জন্য যে কোনো ব্যক্তির কাছে জবাবদিহি করেছেন। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামায এভাবেই মুসলমানদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এবং এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী, শোষণমুক্ত, ভীতিহীন, শান্তিপূর্ণ সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নামায থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেই সাহাবায়ে কেরাম বিশ্ব নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিলেন।
আজও সে নামায রয়েছে, কিন্তু নবীজী যেভাবে নামায আদায়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, সেই নামায খুব অল্প সংখ্যক মুসলমানই আদায় করে থাকে। যে উদ্দেশ্যে নামায ফরজ করা হয়েছে, সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্মরণে রেখে অতি নগণ্য সংখ্যক মুসলমান নামায আদায় করছে। জামাআতে নামায ঠিকই প্রতিদিন আদায় হচ্ছে, কিন্তু এর যে শিক্ষা তা কোথাও বাস্তবায়ন হতে দেখা যাচ্ছে না।
যে নামায থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মুসলমানরা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে, সেই নামায কি মুসলমানরা আদায় করছে? বরং বিষয়টি হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। বিশ্ব শাসন করবে মুসলিম জনগোষ্ঠী, এখন লজ্জাজনকভাবে তারাই এমন জাতিসমূহের দ্বারা শাসিত হচ্ছে, যারা পৃথিবীতে যাবতীয় বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য দায়ী। মুসলমানরা অসৎ কাজের প্রতি বাধার সৃষ্টি করবে, কিন্তু তারাই অমুসলিম জাতিসমূহ কর্তৃক প্রবর্বিত অন্যায়-অসৎ নীতি-পদ্ধতি প্রতিযোগিতা মূলকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করার জন্য নিজেদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করছে।
জামাআতে নামাযের ইমাম বা নেতা নিজের মর্জি অনুযায়ী নামায আদায় করাতে পারেন না। আল্লাহ তা'য়ালা যেভাবে বলেছেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে শিখিয়েছেন, ঠিক সেইভাবেই ইমাম বা নেতাকে নামায আদায় করাতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে নামায হবে না। ইমাম বা নেতা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিখানো পদ্ধতির ব্যতিক্রম করছেন কিনা, তা জানার জন্য অনুসারী বা মুক্তাদীদেরকে কোরআন হাদীসের ততটুকু জ্ঞানার্জন করতে হবে, যতটুকু জ্ঞান থাকলে ইমাম বা নেতা সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করছেন কিনা তা জানা যাবে।
ইমাম বা নেতা যদি ভুল করেন, তাহলে অনুসারী বা মুক্তাদী নেতার ভুল কীভাবে সংশোধন করবেন? ইমাম বা নেতার ভুল সংশোধন করার পদ্ধতিও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়ে দিয়েছেন। এভাবে করে জামাআতে নামায মানুষকে কোরআন-হাদীসের জ্ঞানার্জনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
নেতা যদি বার বার ভুল করতে থাকেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোরআন-হাদীসের প্রদর্শিত পদ্ধতি ত্যাগ করে অন্য কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলে সেই ইমাম বা নেতার নেতৃত্ব পরিত্যাগ করে নতুন ইমাম বা নেতা নির্বাচিত করতে হবে। নেতার নেতৃত্ব পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রেও যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। নামাযে ইমাম যদি কোনো ভুল করেন, তাহলে অনুসারী বা মুক্তাদী উচ্চকণ্ঠে আল্লাহু আকবার বলবেন। কোরআনের আয়াত পাঠ করার সময় যদি কোনো শব্দ বা আয়াত বাদ দিয়ে পরবর্তী আয়াত পাঠ করতে থাকেন, তাহলে মুক্তাদী বা অনুসারীদের মধ্যে কারো জানা থাকলে তা পাঠ করে তিনি ইমাম বা নেতাকে স্মরণ করিয়ে দিবেন। এভাবে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে ইমাম বা নেতার ভুল সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
'জামাআতে নামায নেতা নির্বাচন, নেতার আনুগত্য ও নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ দেয়। ইমাম রুকু সিজদায় গিয়েছেন, মুক্তাদী দাঁড়িয়ে আছে বা ইমাম দাঁড়িয়ে গিয়েছেন, মুক্তাদী রুকু সিজদায় গিয়েছেন, কোথাও কখনো এমন দৃশ্য পরিলক্ষিত হবে না। কোনো মুক্তাদী যদি এমন করে তাহলে তার নামাযই হবে না। অর্থাৎ ইমাম বা নেতা যখন যে কমান্ড করছেন, মুক্তাদী বা অনুসারী তৎক্ষণাত তা প্রশ্নাতীতভাবে নীরবে পালন করছে। মুসলমানদের সাংগঠনিক জীবনে ঠিক এভাবেই নেতার আনুগত্য করতে হবে, যেভাবে জামাআতে নামাযে ইমামের আনুগত্য করা হয়। তবে নেতার আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্তই করা যাবে, যতক্ষণ নেতা কোরআন-হাদীস ভিত্তিক নির্দেশ প্রদান করবে।
0 Comments