অধীনস্থ অমুসলিমের ধৃষ্টতা ও নবী করীম (সা:) এর সীরাত

 


        হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রত্যক্ষ ফসল ছিলো মক্কা বিজয়। মক্কায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন হবার অর্থই ছিলো সমগ্র আরব ইসলামের প্রভাবাধীনে আসা। মক্কা বিজয়ের পরে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ এসে ইসলাম গ্রহণ করছিল। আরবে একটি বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, মক্কায় আল্লাহর ঘর কোনো মিথ্যাবাদীর নিয়ন্ত্রণে কখনোই যাবে না। নবী করীম (সা:) এর আন্দোলনের প্রতি সজাগ সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল তারা অপেক্ষায় ছিল, কুরাইশরা পরাজিত হলেই তারা বিজয়ী নবীর আনুগত্য করবে। মক্কা বিজয়ের পরে তারা বিশ্বনবী (সা:) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

        কিন্তু হাওয়াজেন গোত্র ও ছাকিফ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করলো না। তারা ছিল যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী। তাদের মধ্যে যাদু বিদ্যারও চর্চা ছিল। তারা ধারণা করেছিল, মুহাম্মাদ (সা:) প্রায় সমগ্র আরবই নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। এবার তাদের এলাকা দখল করলে তাদের নিজস্ব কর্তৃত্ব আর থাকবে না। যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হিসাবে তারা হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, উভয় গোত্র একত্রিত হয়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমন করে তাদেরকে পর্যদুস্ত করবে।

        নবী করীম (সা:) সংবাদ পেলেন হাওয়াজেন গোত্র ও ছাকিফ গোত্র একত্রিত হয়ে এক বিশাল বাহিনী সংগ্রহ করে মুসলমানদের ওপর আক্রমন করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসছে। তিনিও দ্রুত শত্রুপক্ষের সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য লোক প্রেরণ করলেন। নবী করীম (সা:) এর প্রেরিত লোকজন ছদ্মবেশে প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনীর সাথে মিশে গেলো। কয়েকদিন তাদের ভেতরে অবস্থান করে তাদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করে ফিরে এসে তাঁরা নবী করীম (সা:) কে সংবাদ জানালেন।

        আল্লাহর রাসূল (সাঃ)ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। এই যুদ্ধই ইতিহাসে হুনাইনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা মুসলমানদের জন্য খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়লো। সবেমাত্র রাসূল (সা:) মক্কা বিজয় করেছেন। তিনি ইচ্ছা করলে মক্কার কুরাইশদের কাছ থেকে হুনাইন যুদ্ধের খরচ বাধ্যতামূলক ভাবে আদায় করতে পারতেন এবং পরাজিত কুরাইশরা যুদ্ধের খরচ দিতে বাধ্য ছিলো। কিন্তু নবী করীম (সা:) পরাজিত ও নিয়ন্ত্রিত জনগোষ্ঠীর কাছে যুদ্ধের খচর দাবী করেননি। ইসলাম বিদ্বেষী জ্ঞানপাপীরা নবী করীম (সা:) এর এই মহত্বের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকে, এসব ইতিহাস তারা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়।

        নবী করীম (সা:) বাধ্য হলেন ঋণ করতে। আবু জাহিলের বৈমাত্রেয় ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে রবিয়া ছিল মক্কার ধনাঢ্য লোকদের একজন। রাসূল (সা:) তার কাছে থেকে ৩০ হাজার দিরহাম ঋণ নিয়েছিলেন। মক্কার কুরাইশদের বিখ্যাত নেতা সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, মক্কা বিজয়ের পরেও তখন পর্যন্ত ধনাঢ্য সে লোকটি ইসলাম গ্রহণ করেনি। এ লোকটির কাছে অস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল। নবী করীম (সা:) এই অমুসলিমের কাছে গেলেন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। বিজয়ী নেতা বিজিত দেশের এক সাধারণ নাগরিকের কাছে গেলেন অস্ত্র ঋণ হিসাবে গ্রহণ করার জন্য। তিনি স্বয়ং না গিয়েও লোক মারফত তাকে সংবাদ দিয়ে নিজের কাছে আসতে বাধ্য করতে পারতেন। রাসূল (সা:) যা আদেশ করতেন তা মানতে তাকে বাধ্য করতে পারতেন।

        কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মানবতার মুক্তিদূত নবী করীম (সা:) স্বয়ং পরাজিত সেই অমুসলিমের কাছে গেলেন। তাকে অনুরোধ করলেন, 'আমাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করো'।

        অমুসলিম সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া আল্লাহর রাসূল (সা:) এর দিকে তাকিয়ে বললো, হে মুহাম্মাদ (সা:)! তুমি কি আমার অস্ত্র কেড়ে নিতে এসেছো?'

        ' স্মিতহাস্যে আল্লাহর হাবিব বললেন, 'না কেড়ে নিতে আসিনি। আমি তোমার অস্ত্র পুনরায় ফেরৎ দিবো। ঋণ হিসাবে দাও'।

        বিজয়ী নেতার সাথে বিজিত দেশের একজন অমুসলিম কি ভাষায় কথা বলছে আর বিজয়ী নেতা কি জবাব দিচ্ছেন, এদিকে দৃষ্টি দিলেও কি ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষীদের মনে হয়, নবী করীম (সা:) তরবারীর জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন? প্রকৃতপক্ষে হিংসা আর বিদ্বেষ যাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করেছে, তারা কখনোই স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে রাসূল (সা:) এর পবিত্র সীরাত ও ইসলামপন্থীদের মহত্ব দেখতে পায় না। প্রকৃত সত্য আড়াল করার লক্ষ্যে তারা কৌশলী পন্থা অবলম্বন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। তাদের নিয়ন্ত্রিত পত্র-পত্রিকা, রেডিও ও টিভি চ্যানেল এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের দিকে দৃষ্টি দিলেই স্পষ্ট অনুভব করা যায়, কিভাবে তারা অসত্য প্রচার করছে, প্রকৃত ঘটনার বিপরীত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করছে, লেখা ও বলার ক্ষেত্রে ভাষার কৌশলী শব্দ ব্যবহার করছে। সুদূর অতীতকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলিম চেতনা বিদ্বেষী লোকজন মিথ্যা ব্যতীত সততা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে পারেনি। আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকে হিদায়াত দান করুন।

Post a Comment

0 Comments