শক্তি প্রয়োগে নয়, নবী করীম (সা:) এর স্নিগ্ধ সুরভিত আকর্ষণে

        নবী করীম (সা:) প্রত্যেক হজ্জের মৌসুমে আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতেন। নবুয়্যাতের দশম বছর রজব মাসে নবী করীম (সা:) বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেলেন। এ সময় মদীনা থেকে একদল লোক মক্কায় আগমন করেছিল। দলটি ছিল খাজরাজ গোত্রের। মক্কা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম আকাবা। বর্তমানে এখানে মসজিদে আকাবা অবস্থিত। এই আকাবাতে তাঁর সাথে লোকগুলোর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাদের সাথে দেখা হওয়া মাত্র তিনি তাদের পরিচয় জানতে আগ্রহী হলেন। তাঁরা নিজেদেরকে খাজরাজ গোত্রের লোক বলে পরিচয় দিল। তিনি বললেন, 'যারা ইয়াহুদীদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ আপনারা কি সেই গোত্রের?'

        নবী করীম (সা:) এর কথার প্রতি তাঁরা ইতিবাচক জবাব দিল। তিনি তাদেরকে বললেন, 'আপনারা আমাকে একটু সময় দিলে আমি আপনাদের সাথে কিছু কথা বলতে ইচ্ছুক'।

        আগন্তুক দল নবী করীম (সা:) এর কথায় সম্মত হয়ে সেখানে বসলো। তিনি তাদেরকে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে শোনালেন এবং ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করার আহ্বান জানালেন। মদীনার অধিবাসীরা নানা ধরনের মূর্তির পূজা করতো এবং ইয়াহুদীদের সাথে তাঁরা এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। তৎকালীন ইয়াহুদীরা কিতাবের মাধ্যমে নবী করীম (সা:) সম্পর্কে পূর্ব হতেই অবগত ছিল। তাদের কাছ থেকে মদীনার অধিবাসীরাও নবী করীম (সা:) এর আগমন সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছিলো।

        মদীনার ইয়াহুদী এবং পৌত্তলিকদের মধ্যে মতানৈক্যের সূত্রপাত হলে ইয়াহুদীরা পৌত্তলিকদের ভয় দেখিয়ে বলতো, 'বর্তমানে নবী আগমনের আর দেরী নেই। আমরা ইতোপূর্বে আদ ও ইরাম জাতিকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলাম। এখন যে নবী আগমন করবে সে নবীর নেতৃত্বে তোমাদেরকেও সেই একইভাবে হত্যা করবো'।

        ইয়াহুদীদের এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের কারণে মদীনার পৌত্তলিকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, নবীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটলে তাঁরাই ইয়াহুদীদের আগে নবীর অনুসারী হবে। এভাবে মহান আল্লাহ তা'য়ালা মদীনায় ইসলামের জন্য ক্ষেত্র পূর্ব হতেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। নবী করীম (সা:) এর দাওয়াত শোনার সাথে সাথে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, যে নবী সম্পর্কে ইয়াহুদীরা তাদেরকে ভয় দেখায় এই মানুষটিই সেই নবী। সুতরাং ইয়াহুদীরা এই নবীর অনুসারী হবার পূর্বেই তাঁরা ইসলাম কবুল করে মুসলমান হবে এবং সিদ্ধান্ত তাঁরা তৎক্ষণাৎ কার্যকর করেছিল।

        ইসলাম কবুল করেই তাঁরা নবী করীম (সা:) কে জানালো, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আমরা আমাদের গোত্রকে শত্রু কর্তৃক পরিবেষ্টিত অবস্থায় রেখে এসেছি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের গোত্রের সকল লোক আপনার সাথে থাকবে। আমরা আমাদের গোত্রে ফিরে গিয়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদেরকে জানাবো। মহান আল্লাহ তা'য়ালা যদি তাদেরকে আপনার সঙ্গী বানিয়ে দেন তাহলে আপনি হবেন সবচেয়ে সম্মানিত এবং শক্তিশালী'।

        এই সৌভাগ্যবান মানুষগুলো ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় গিয়ে তাদের গোত্রের কাছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করে তাদের ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি জানিয়ে দেন। ফলে মদীনার সর্বত্র ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে। এভাবেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীর কার্যক্রমকে এক যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেন এবং ইসলাম বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায়।

        মহাকালের ঘূর্ণয়মান চক্রের আবর্তনে পুনরায় হজ্জের মৌসুম এসে উপস্থিত হলো। মদীনা থেকে সত্য পিপাসু ব্যক্তিগণ মক্কায় এলেন তাওহীদের সুরা পান করে তৃষ্ণা মিটানোর জন্য। তাঁরা নবী করীম (সা:) এর সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। হযরত উবাদা (রা:) বলেন, 'আমি আকাবার প্রথম বাইয়াতে উপস্থিত ছিলাম। আমরা মোট ১২ জন পুরুষ উপস্থিত ছিলাম। আমরা নবী করীম (সা:) এর কাছে ওয়াদা করেছিলাম, 'আল্লাহ তা'য়ালার সাথে কাউকে শরীক করবো না। সন্তান হত্যা করবো না। চুরি ডাকাতি করবো না। ব্যভিচার করবো না। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়াবো না। ন্যায় সংগত বিষয়ে নবীর সাথে অবাধ্যতা প্রদর্শন করবো না'।

        আমরা নবী করীম (সা:) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করার পরে তিনি বললেন, 'তোমরা আমার সাথে যে ওয়াদা করলে, তা যদি পালন করো তাহলে তোমাদের জন্য আল্লাহর জান্নাত রয়েছে। আর যদি এই ওয়াদার মধ্যে কোনো একটিও অমান্য করো তাহলে তোমাদের পরিণতি আল্লাহ তা'য়ালার হাতেই অর্পিত থাকবে। তিনি ইচ্ছে করলে শাস্তি ও দিতে পারেন এবং ক্ষমাও করতে পারেন'।

        'বাইয়াত' আরবী শব্দ, এর অর্থ হলো বিক্রি করে দেয়া। একজন মুসলমান তাঁর জীবনের সকল কিছুই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে বিক্রি করে দেয়। মুসলমানদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এ কারণে তাঁরা তাদের জীবন, ধন-সম্পদ সকল কিছুই মহান আল্লাহর কাছে জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। মহান আল্লাহও পবিত্র কুরআনে বলেছেন, আমি তাদের প্রাণ এবং ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছি। সুতরাং বাইয়াত করার অর্থ হলো, মহান আল্লাহর কাছে নিজের সমগ্র সত্তাকে বিক্রি করে দেয়া।

        মদীনায় এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সেখানে এমন একজন প্রশিক্ষকের প্রয়োজন ছিল যিনি মানুষকে ইসলামী শিক্ষার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দিবেন। নবী করীম (সা:) এই অভাব উপলব্ধি করে হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের (রা:) কে প্রশিক্ষক হিসাবে মনোনীত করে মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর এ মহান সাহাবীই ছিলেন ইসলামের প্রথম মুবাল্লিগ। তিনি ছিলেন প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরের যুদ্ধে পতাকা বহনকারী। তিনি মদীনায় আগমন করে হযরত আসয়াদ ইবনে জুরারাহ (রা:) এর বাড়িতে অবস্থান করেন। হযরত আসয়াদ (রা:) মদীনার একজন সম্মানিত ব্যক্তি এবং তাঁর আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।

        হযরত মুসআব (রা:) একজন দক্ষ সংগঠক এবং ভারসাম্যমূলক মেজাজের অধিকারী ছিলেন। সাবলীল ভাষায় তিনি ইসলামী আদর্শ মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারতেন এবং তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলীর কারণে নবী করীম (সা:) তাকেই মদীনায় ইসলামী কার্যক্রম শুরু ও আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য মনোনয়ন দান করেছিলেন। হযরত মুসআব (রা:) মদীনায় গিয়ে ব্যাপকভাবে ইসলামের পক্ষে জনমত গঠন করেন এবং মদীনার মানুষকে ইসলামী বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মদীনার ঘরে ঘরে ইসলামের বিজয় কেতন উড়তে থাকে। তিনি কতটা দক্ষ সংগঠক এবং তাঁর মেজাজ কতটা ভারসাম্যমূলক ছিল, তা একটি ঘটনা দ্বারা প্রমাণ হয়। এক জনসমাবেশে তিনি মানুষের কাছে ইসলামের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করছিলেন। এমন সময় বনী আবদিল আশহালের নেতা উসাইদ ইবনে হুদাইর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উত্তেজিতভাবে তাঁর কাছে এলো।

        সমবেত মুসলমানগণ লোকটির রণমূর্তি দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। হযরত মুসআব (রা:) তাঁর দিকে মুখে হাসি টেনে তাকিয়ে রইলেন। তিনি নির্ভীকভাবে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনলেন। উসাইদ ক্রোধ কম্পিত কন্ঠে বলতে লাগলো, 'তুমি আমার দেশের লোককে বিভ্রান্ত করছো। তোমার যদি জীবিত থাকার সাধ থাকে তাহলে এই মুহূর্তে মদীনা ত্যাগ করো'।

        মুখে মধুর হাসি টেনে হযরত মুসআব (রা:) তাকে বললেন, 'আপনি আমার কথা একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। যদি আপনার ভালো না লাগে তাহলে আমি চলে যাবো। আপনি দয়া করে একটু বসুন'।

        তাঁর কথা যাদুর মতই ক্রিয়া করলো। উসাইদ নীরবে সে বৈঠকে উপবেশন করলো। হযরত মুসআব (রা:) প্রথমে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে কুরআনের ব্যাখ্যা পেশ করলেন। উসাইদ তখন মনোযোগ দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালার কুরআন শুনছেন। তাঁর চেহারায় আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেলো। তিনি বললেন, 'তুমি যা বলছো তা অত্যন্ত সুন্দর এবং যুক্তির কথা। তোমার এই আদর্শ গ্রহণ করতে হলে কি করতে হবে?' হযরত মুসআব (রা:) প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার পর তিনি ইসলাম কবুল করলেন।

        আউস গোত্রের নেতার নাম ছিল সাদ ইবনে মায়াজ। সমগ্র গোত্রে তাঁর মতো প্রভাবশালী অন্য কোনো নেতা ছিল না। গোত্রের প্রতিটি মানুষ তাঁর ইশারায় প্রাণদান করার জন্য প্রস্তুত থাকতো। নবী করীম (সা:) এর প্রেরিত দূত হযরত মুসআব (রা:) তাঁর কাছে গেলেন ইসলামের আদর্শ নিয়ে। সাদ তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো। হযরত মুসআব (রা:) পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করলেন। কুরআনের প্রভাবে সাদের ভেতরের জগৎ ইসলাম গ্রহণের জন্য উর্বর হয়ে উঠলো। মুহূর্তকাল অপেক্ষা না করে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে গোত্রের প্রতিটি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করার জন্য প্রতিযোগিতা আরম্ভ করে দিয়েছিল। (আল্বিন্দায়াতু ওয়ানেহায়াহ্, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা নং-১৪৯)

        হযরত মুসআব (রা:) মদীনায় ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী জনমত গঠন করলেন। ইসলাম এবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ পরিচালনা করবে, সে মুহূর্ত প্রায় সমাগত। ক্ষণিক পরেই যেন বিজয়ের সিংহদ্বার উন্মুক্ত হবে। সে লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন প্রায়। হযরত মুসআব (রা:) তাঁর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে নবী করীম (সা:) কে অবগত করার লক্ষ্যে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। পুনরায় হজ্জের মৌসুম সমাগত হলো। মদীনা থেকে লোকজন হজ্জ আদায়ের লক্ষ্যে মক্কার দিকে রওয়ানা দিল। তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করে মদীনাতেই মুসলমান হয়েছিল। হজ্জ আদায় কালে তাঁরা নবী করীম (সা:) এর সাথে কথা বলে জানিয়ে দিলেন আকাবায় পুনরায় সাক্ষাৎ হবে।

        আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী হযরত কা'ব ইবনে মালিক (রা:) বলেন, 'মদীনা থেকে আমরা আমাদের গোত্রের অমুসলিমদের সাথে হজ্জ আদায়ের জন্য মক্কায় যাত্রা করলাম। সে সময় আমরা নামায আদায় করি এবং ইসলাম সম্পর্কে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছি। আমাদের গোত্রপতি বয়সে প্রবীণ বারা ইবনে মারুর আমাদের বললো, 'আমি তোমাদেরকে একটি বিষয় জানাবো। তোমরা আমার সাথে একমত হবে কিনা জানি না। আমি এখন থেকে কা'বার দিকে পেছন ফিরে নামাজ আদায় করবো না, কা'বার দিকে মুখ করেই নামাজ আদায় করবো'।

        আমরা তাকে জানালাম, 'আমাদের নবী বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরে নামায আদায় করে থাকেন। আমরাও তাঁর অনুসরণ করি'।

        গোত্রপতি জানালেন, 'তাহলে আমি কা'বা এবং বাইতুল মাকদিস এই উভয় দিকেই মুখ করে নামাজ আদায় করবো'।

        আমরা তাকে জানালাম, 'আমরা তোমার মত করবো না। আমাদের নবী যেমন করেন আমরাও তেমন করে নামায আদায় করবো'।

        পথে আমরা নবী করীম (সা:) এর অনুকরণে নামায আদায় করতাম আর তিনি তাঁর মত অনুযায়ী নামায আদায় করতেন। মক্কায় আসার পরে তিনি আমাদেরকে বললেন, 'তোমরা আমাকে নবীর কাছে নিয়ে চলো। তোমাদের কথায় আমার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করবো আমি ভুল না ঠিক করেছি'।

        হযরত কা'ব (রা:) বলেন, 'আমরা নবী করীম (সা:) এর সন্ধানে বের হলাম। তাঁকে আমরা চিনতাম না। কারণ ইতোপূর্বে আমরা কেউ তাঁকে দেখিনি। মক্কার একজন লোককে আমরা জানালাম, 'মুহাম্মাদ (সা:) কে আমরা চিনি না কিন্তু তাঁর সাথে আমরা সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছুক'। লোকটি আমাদেরকে প্রশ্ন করলো, আমরা মুহাম্মাদ (সা:) এর চাচা আব্বাসকে চিনি কিনা। আমরা তাকে জানালাম, তাঁকে আমরা চিনি। কারণ সে আমাদের গোত্রের পাশ দিয়ে অনেক বার আসা যাওয়া করেছে। লোকটি আমাদেরকে জানালো, মক্কার ঘরে হযরত আব্বাসের পাশে যাকে বসে থাকতে দেখবে সেই হলো তোমাদের কাঙ্খিত ব্যক্তি।

        আমরা কা'বাঘরে প্রবেশ করে হযরত আব্বাসকে দেখলাম এবং তাঁর পাশে অপূর্ব সুন্দর একজন মানুষকে বসে থাকতে দেখলাম। আমরা সালাম দিয়ে তাঁর পাশে বসলাম। নবী করীম (সা:) তাঁর চাচাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'চাচা, আপনি কি এদেরকে চিনেন?'

        হযরত আব্বাস বললেন, 'আমি এদেরকে চিনি। এদের একজন হলেন কা'ব ইবনে মালিক আরেকজন হলেন গোত্রপতি বারা ইবনে মারুর'।

        হযরত কা'ব (রা:) বলেন, এবার আমার অবাক হবার পালা। নবী করীম (সা:) আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, 'আপনি সেই বিখ্যাত কবি কা'ব ইবনে মালিক!'

         আমি কুণ্ঠিত কণ্ঠে জবাব দিলাম, 'আমিই সেই ব্যক্তি'।

        এ সময় গোত্রপতি বারা বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি মক্কায় যাত্রা করার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছি। তারপর আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম আমি মক্কাকে পিছনে করে নামায আদায় করবো না। মক্কাকে সামনে করে নামায আদায় করবো। কিন্তু আমার সাথীরা আমার সাথে একমত নন। আমি সন্দেহের মধ্যে আছি। আপনি বলে দিন আমি ঠিক করেছি কিনা'।

        নবী করীম (সা:) বললেন, 'তুমি একদিকে মুখ দিয়ে নামায আদায় করতে, ধৈর্যের সাথে সেদিকেই মুখ করে নামায আদায় করলে উত্তম হতো'।

        এরপর গোত্রপতি বারা আমাদেরকে অনুসরণ করে বাইতুল মাকদিসের দিকে মুখ করে নামায আদায় করতে থাকলেন। আমরা হজ্জের অনুষ্ঠান আদায় করে পরবর্তী রাতে নবী করীম (সা:) এর সাথে আকাবায় মিলিত হবার জন্য প্রস্তুত হলাম। এ সময় আমাদের সাথে মদীনার প্রভাবশালী ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ছিলেন। আমরা তাঁকেও আমাদের সাথে নিলাম। জাবির নামে আরেকজন সম্মানিত ব্যক্তি আমাদের সাথে ছিল। আমারা কোথায় কি করতে যাচ্ছি তা কাউকে জানালাম না।

        পরে আমি জাবিরকে বললাম, 'আপনি আমাদের মধ্যে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আপনি যে জীবন ব্যবস্থা মেনে চলেন তা ঠিক না। আপনি মৃত্যুর পরে জাহান্নামে যান এটা আমরা চাই না। আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন'।

        তিনি তখনই ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং তাকে আমরা জানালাম, আজ রাতে আমরা নবী করীম (সা:) এর সাথে আকাবায় সাক্ষাৎ করবো। পরে তিনি আমাদের পথ প্রদর্শনকারী হয়েছিলেন। সেই রাতে আমরা আমাদের সাথীদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকলাম এবং গভীর রাতে উঠে আমরা আকাবার দিকে গোপনে যাত্রা করলাম। সে সময় আমাদের সংখ্যা দুইজন নারীসহ মোট ৭৩ জন ছিল। আমরা সেখানে সমবেত হয়ে নবী করীম (সা:) এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে সাথে নিয়ে এলেন। হযরত আব্বাস সে সময় পর্যন্তও ইসলাম গ্রহণ করেননি কিন্তু তিনি রাসূল (সা:) এর নিরাপত্তার জন্য তাঁর সাথে থেকে তাঁর কাজে সহায়তা করতেন।

        এরপর হযরত আব্বাস সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, 'হে সমবেত মদীনাবাসী! আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমাদের কাছে মুহাম্মাদ (সা:) এর মর্যাদা কতটা উচ্চে। তাঁকে আমরা বিভিন্ন ধরনের বিপদ থেকে এ পর্যন্ত নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করেছি। তিনি তাঁর এলাকাবাসীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব কর্ম সম্পাদন করেছেন। এ কারণে তিনি আমাদের মধ্যে সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকারী। তবুও তিনি আপনাদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করছেন এবং আপনাদের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ। এখন আপনারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, আপনারা যে ওয়াদা তাঁকে দিচ্ছেন সে ওয়াদা শেষ পর্যন্ত পালন করতে পারবেন কিনা। তাঁর নিরাপত্তাদান করতে পারবেন কিনা। তাঁর সব ধরণের দায়িত্ব আপনারা গ্রহণ করতে পারবেন কিনা। কারণ তিনি আমাদের মধ্যে নিরাপত্তা এবং সম্মানের সাথেই অবস্থান করছেন'।

        হযরত আব্বাস (রা:) এর কথা শেষ হতেই আমরা বললাম, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আমরা সকল কিছুতেই রাজি আছি, আপনি আমাদের বাইয়াত গ্রহণ করুন'।

        নবী করীম (সা:) পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে উপস্থিত সবাইকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য দাওয়াত দিয়ে বললেন, 'আমি তোমাদের কাছ থেকে একটি অঙ্গীকার চাই, তোমরা তোমাদেও পরিবার-পরিজনের যেভাবে দেখাশোনা করো, যেভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করো, আমার ক্ষেত্রে তেমনই করবে কিনা'।

        আমাদের গোত্রপতি বারা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে নবী করীম (সা:) এর হাত ধরে বললেন, 'যে মহান আল্লাহ তা'য়ালা আপনাকে সত্য জীবন ব্যবস্থাসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর নামে শপথ করে ওয়াদা করছি, আমরা আমাদের পরিবার-পরিজনের যেভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি সেই একইভাবে আপনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবো। আপনি আমাদের যেদিকে পরিচালিত করবেন সেদিকেই আমরা যাবো। আমরা যোদ্ধা জাতি, তরবারীর ছায়ায় আমরা লালিত পালিত। আমরা অস্ত্র এবং যুদ্ধের মধ্যেই জীবিত থাকি। আমরা আপনার অনুগত্য করবো'।

        এরপর আরেকজন নেতা আবুল হাইসাম বললো, 'আমরা ইয়াহুদীদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করেছিলাম এবং সে সম্পর্ক শেষ করে দিতে যাচ্ছি। (অর্থাৎ আপনাকে গ্রহণ করার অর্থই হলো ইয়াহুদীদের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়া) আপনার জন্য আমরা ত্যাগ স্বীকার করবো, এরপর আপনি যখন বিজয়ী হবেন তখন আমাদেরকে ছেড়ে যাবেন না তো?'

        তাঁর কথা শুনে নবী করীম (সা:) মৃদু হেসে বললেন, 'আমি তোমাদের জীবন এবং মৃত্যু, সুখ এবং দুঃখের চিরদিনের সাথী হয়েই তোমাদের সাথে অবস্থান করবো। তোমাদের রক্তকে আমি আমার নিজের রক্ত বলে মনে করবো। আমি চিরকালের- জন্য তোমাদের আর তোমরা আমার। তোমরা যার সাথে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করবো এবং তোমরা যার সাথে আপোষ করবে আমিও তার সাথে আপোষ করবো। যারা তোমাদের শত্রু তারা আমারও শত্রু, আর যারা আমার শত্রু তারা তোমাদেরও শত্রু'।

        এরপর নবী নবী করীম (সা:) সমবেত লোকদের বললেন, 'তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে ১২ জন লোককে প্রতিনিধি করে আমার কাছে প্রেরণ করো। তাঁরা তাদের লোকদের কাছ থেকে আমার পক্ষ থেকে ওয়াদা গ্রহণ করবে'। এরপর তিনি আমাদের প্রতি আদেশ দিলেন, আমরা যেন নিজেদের অবস্থানে চলে যাই। আমাদের মধ্যে থেকে আব্বাস ইবনে উবাদা বললো, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি আমাদেরকে আদেশ করলে আমরা ইসলামের শত্রুদের ওপরে আক্রমণ করতে পারি'।

        নবী করীম (সা:) তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমাকে এ ধরনের কাজের জন্য প্রেরণ করা হয়নি। তোমরা নিজেদের অবস্থানে চলে যাও'।

        নবী করীম (সা:) এর কাছে মদীনার লোকজন যখন বাইয়াত গ্রহণ করছিল, তখন তাদের মধ্য থেকে হযরত সা'দ (রা:) উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেছিলেন, 'তোমরা কি জানো তোমরা কোন্ কথার ওপর বাইয়াত করছো? নবীর কাছে বাইয়াত করার অর্থ হলো সমগ্র পৃথিবীর মানুষ এবং জ্বীনকে নিজের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। গোটা দুনিয়াকে নিজের শত্রুতে পরিণত করা'।

        সমবেত লোকগুলো সমস্বরে বলে উঠেছিল, 'আমরা জেনে বুঝেই বাইয়াত করছি। এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো শক্তিকে আমরা ভয় করি না। আমরা তরবারীর ছায়ায় লালিত পালিত'।

        যে ১২ জনকে নবী করীম (সা:) আহ্বায়ক নিযুক্ত করেছিলেন, তাঁরা সবাই ছিল বিভিন্ন গোত্রের গোত্রপতি। নিজের সমাজে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাদের মতো ব্যক্তিত্ব ইসলামের সহযোগী হওয়ার অর্থই ছিল গোত্রের সকল জনশক্তি ইসলামের পক্ষাবলম্বন করা। পৃথিবীতে মহাসত্য প্রাথমিক অবস্থায় নিঃসঙ্গ থাকে এ কথা সত্য, কিন্তু এ নিঃসঙ্গতার অবসান ঘটতে খুব একটা সময়ের প্রয়োজনও হয় না। একটি আদর্শের ক্ষেত্রে দশ বিশ বছর তেমন একটা সময় না। এই পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, একটি আন্দোলন বিজয়ী হতে কয়েক যুগ সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। আন্দোলনের নেতা-কর্মীগণ চরম প্রতিকুল অবস্থা পাড়ি দিয়ে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মুকাবিলা করে তারপর সাফল্যের • সিংহদ্বারে উপনীত হয়েছেন।

        ইসলামী আদর্শকে বিজয়ী আদর্শ হিসাবে দেখতে হলে দু'টো শর্ত পূরণের প্রয়োজন হয়। প্রথম শর্ত হলো, ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত একদল নিষ্ঠাবান সুশৃংখল কর্মী বাহিনী প্রয়োজন। যারা আদর্শের জন্য যে কোনো ত্যাগ হাসি মুখে স্বীকার করতে পারে। যে কোনো ধরনের নির্যাতন থেকে শুরু করে অর্থ-সম্পদের শেষ তলানিটুকুও নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে প্রাণদানও করতে পারে। যে কর্মী বাহিনী প্রশ্নাতীতভাবে নেতৃ আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারে।

        দ্বিতীয় যে শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন তাহলো, আদর্শের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন থাকতে হবে। কারণ ইসলামী আদর্শ কোনো জাতির ওপরে চাপিয়ে দেয়ার আদর্শ নয় এবং ইসলাম কোনো জাতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের ঘাড়ের ওপরে বসতে মোটেও আগ্রহী নয়। এ কারণে জনসমর্থন যোগাড় বা জনমত গঠনের জন্য এ আদর্শের কর্মীদের প্রতিটি মুহূর্তে তৎপর থাকতে হয়। মক্কা এবং মদীনার ইতিহাসে আমরা এ কথার বাস্তব প্রমাণ দেখতে পাই। নবী করীম (সা:) মক্কায় কর্মী গঠন করেছেন। ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নে যে গুণ এবং মানসম্পন্ন কর্মী প্রয়োজন সে ধরনের কর্মী মক্কাতেই তৈরী হয়েছিল। কিন্তু মক্কায় ইসলামের পক্ষে জনমত গঠিত হয়নি। মদীনায় ইসলামের পক্ষে ক্রমশঃ জনমত গঠন হয়। ফলে যে বিপ্লব হবার কথা মক্কায় তা হয়েছিল মদীনায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ প্রক্রিয়াতেই ইসলামকে বিজয়ী করে থাকেন এবং এটিই নবী করীম (সা:) এর সীরাত।

Post a Comment

0 Comments