মক্কা থেকে ইসলাম গ্রহণ করার পরে অত্যাচারিত হয়ে যারা মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তাদের সমস্ত সম্পত্তি মক্কার ইসলাম বিরোধী লোকজন দখল করেছিল। সাহাবায়ে কেরাম ইচ্ছে করলে তাদের কষ্টার্জিত সে সব বাড়ি ঘর সহায় সম্পদ অধিকার করতে পারতেন। বিশ্বনবী সাহাবায়ে কেরামকে আদেশ দিলেন, 'তোমরা কোন কিছুতেই হাত দেবে না।'
সাহাবায়ে কেরাম তাদের সম্পত্তির দিকে ফিরেও তাকালেন না। ইতোমধ্যে হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কা'বা ঘরের ছাদে আরোহণ করে আযান দিলেন। সে সময় এমন কিছু লোকজন উপস্থিত ছিল, যারা ছিল একেবারে মূর্খ শ্রেণীর এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এদের অন্তরে তাওহীদের আলো প্রবেশ করে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সময়ের প্রয়োজন ছিল। হযরত বিলালের কণ্ঠে তাওহীদের ঘোষনা শুনে আত্তাব ইবনে উসাইদ বললো, 'খোদা আমার পিতার সম্মান রক্ষা করেছে, সে এই আযানের শব্দ শোনার আগেই পৃথিবী ত্যাগ করেছে।'
কোন এক মূর্খ বলেছিল, 'কা'বা ঘরের ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিচ্ছে! এখন তো আমাদের জীবিত থাকাই উচিত না।'
মক্কার জনগণ যা ভেবেছিল, তার সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবহার লাভ করেছিল মুসলমানদের কাছ থেকে। ইসলামের প্রতি তাদের এতদিনের বিদ্বেষ অন্তর থেকে দূর হয়ে গেল। ইসলাম গ্রহণ করার জন্য কারো প্রতি সামান্য শক্তিও প্রয়োগ করা হয়নি। তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করার জন্য পাগল পারা হয়ে উঠেছিল। আল্লাহর নবী সাফা পর্বতের একটা উঁচ্চ স্থানে উপবেশন করলেন। মানুষের জোয়ার সৃষ্টি হলো বিশ্বনবীর সামনে। ঘোষনা করে দেয়া হলো, প্রথমে পুরুষদের ইসলাম গ্রহণ শেষ হলে মহিলাগণ আগমন করবে।
পুরুষগণ আগমন করে আল্লাহর নবীর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করতেন। আর মহিলাদের জন্য এমন ব্যবস্থা করা হলো, আল্লাহর নবী একটা পানির পাত্রে নিজের পবিত্র হাত মোবারক ডুবিয়ে উঠিয়ে নিতেন। তারপর মহিলাগণ সে পানির পাত্রে তাদের হাত ডুবাতেন। এভাবে নারীদের বাইয়াত গ্রহণ করলেন। নারীগণ ইসলামের আদেশ নিষেধ পালন করবে, তাদের চরিত্র ভালো রাখবে, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, এ সমস্ত কথার ওপরে তাদের বাইয়াত গ্রহণ করা হয়েছিল।'
ইতিহাসে যে মহিলাকে কলিজা ভক্ষণকারিণী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, সে মহিলার নাম হিন্দা। মক্কার নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী সে। পৰ্দ্দা আবৃতা হয়ে এই নারী আল্লাহর নবীর সামনে এসেছিল। কারণ সে যে অপরাধ করেছিল তার গুরুত্ব সে অনুধাবন করতে পেরেছিল। এ কারণে তাঁর ভয় ছিল, কেউ তাকে চিনে ফেললে কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সামনে সে যখন বাইয়াত গ্রহণ করতে এসেছিল, তখন তাঁর ভেতরে কোন নমনীয়তা ছিল না। তারা যে আজ পরাজ্জিত, এ ধরণের কোন মনোভাব তার ভেতরে ছিল না। রাসূলের সাথে তাঁর কথাবার্তাও ভদ্রজনোচিত ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, 'বলো, আল্লাহর সাথে কাউকে অংশী স্থাপন করবে না।'
জবাবে হিন্দা বলেছিল, 'আপনি এ ধরণের অঙ্গীকার পুরুষদের কাছ থেকে আদায় করেননি। কিন্তু আমি সে অঙ্গীকার আপনার কাছে করছি।'
আল্লাহর নবী তাকে বললেন, 'অঙ্গীকার করো, কোনদিন চুরি করবে না।' আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বলেছিল, 'আমি আমার স্বামীর অর্থ সম্পদ থেকে মাঝে মধ্যে কিছু এদিক-ওদিক করে থাকি। আমার জানা নেই এগুলো হারাম না হালাল।' আল্লাহর রাসূল বলেছিলেন, 'বলো, সন্তানদের হত্যা করবে না।' হিন্দা বলেছিল, 'আমরা বহু কষ্ট করে বাচ্চাদের লালন-পালন করে বড় করেছিলাম। আপনি বদরের প্রান্তরে তাদেরকে হত্যা করেছিলেন। এখন আপনি এবং তারা যা উত্তম তাই বুঝবেন।'
প্রিয় চাচা হামজাকে হত্যা করেছিল ওয়াহ্শী। আর তাঁর বুক চিরে যে নারী কলিজা চিবিয়েছিল, দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে মালা বানিয়ে গলায় পরিধান করেছিল যে নারী, সেই নারী আল্লাহর নবীর সামনে। শুধু সামনেই নয়, নবীকে অভিযুক্ত করে গর্বভরে কথা বলছে সেই নারী। ধৈর্যের পাহাড় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কিছুই বললেন না। ইসলাম হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রসারিত হয়নি, ক্ষমা আর প্রেম দিয়েই ইসলাম দিকদিগন্তে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
মক্কায় এমন দশজন লোক ছিল, যারা ছিল কুরাইশদের বিখ্যাত নেতা। ইসলামের বিরোধীতার ক্ষেত্রে তাদের নাম স্মরণীয় হয়েছিল। তারা মক্কা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। হযরত ওমায়ের ইবনে ওহাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু রাসূলের সামনে এসে নিবেদন করলেন, 'আরবের নেতৃবৃন্দ নিরাপত্তার অভাবে মক্কা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র পাগড়ী মোবারক দিয়ে দিলেন। যা ছিল নিরাপত্তার প্রতীক। অভয় দান করলেন, তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই।
0 Comments