ওহীর সূচনা ও অবতীর্ণ হবার পদ্ধতি

        বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরে ওহীর সূচনা পূর্বে প্রায়ই তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতেন। যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তায় অস্থির থাকতেন, এসব সমস্যার সমাধান আল্লাহ তাকে ওহীর মাধ্যমে দান করবেন। সুতরাং ওহী নাজিলের সময় যত এগিয়ে আসতে থাকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নির্জনতা অবলম্বন ততই বৃদ্ধি পেতে থাকলো। তিনি মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে একটা পাহাড়ে চলে যেতেন। সে পর্বতের হেরা নামক গুহায় বিশেষ ইবাদাতে নিমগ্ন হয়ে পড়তেন। এ সময়ে তিনি সত্য এবং সুন্দর স্বপ্ন দেখতেন। তিনি এমন স্বপ্ন দেখতেন তা যেন মনে হত তিনি তা বাস্তবে দেখছেন। পর্বতের গুহায় তিনি ইবাদাতের কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা হাদীস শরীফে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। বোখারী শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে, হেরা গুহায় তিনি যে ইবাদাত করতেন তা ছিল চিন্তা গবেষণা ও উপদেশ গ্রহণ করা।

        তিনি বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যেতেন অথবা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা স্বয়ং গিয়ে দিয়ে আসতেন বা লোক মারফত প্রেরণ করতেন। কোন সময় কয়েকদিনের খাবার তিনি একত্রে নিয়ে যেতেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা বলেছেন, মহান আল্লাহ যে সময়ে তাকে অনুগ্রহ করে মানব জাতির জন্য নবী নির্বাচিত করলেন তখন তিনি নবুয়্যতের একটা অংশ হিসাবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতেন। এ সময়ে মহান আল্লাহ তাঁকে নির্জন বাসের প্রতি গভীর আগ্রহী করে তোলেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা দিনের আলোর মতই বাস্তবে পরিণত হত। একাকী কোন নির্জন স্থান সে সময়ে তাঁর কাছে অধিক প্রিয় ছিল। আরেকটি বর্ণনায় দেখা যায়, নবুয়্যতের সূচনা লগ্নে তিনি বাইরে বের হলেই কোন নির্জন উপত্যকায় বা কোন নির্জন সমভূমিতে চলে যেতেন। সে সময়ে তিনি কোন জড়পদার্থের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেতেন, আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ!

        এ কথা শোনার সাথে সাথে তিনি চমকে উঠে তাঁর চারদিকে তাকিয়ে সালাম দাতার সন্ধান করতেন। কিন্তু তিনি তাঁর আশেপাশে গাছ পাথর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতেন না। এভাবেই সময় তখন অতিবাহিত হচ্ছিল। গবেষকদের ধারণা, তিনি যেন ওহী এবং হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালামকে ধারণ করতে সক্ষম হন, এ কারণেই নবয্যতের পূর্বে কিছুদিন মহান আল্লাহ এ অবস্থা সৃষ্টি করে তাঁর অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি করছিলেন। হাদীস শরীফে দেখা যায়, যে সময়ে তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতেন তখন তিনি প্রচুর দান করতেন। অভাবীদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করতেন। বাড়িতে ফিরে আসার পথে কা'বাঘরে এসে তিনি সাতবার বা ততোধিক বার তাওয়াফ করতেন তারপর বাড়িতে যেতেন। এ সময়ে বিশ্বনবী যে সমস্ত স্বপ্ন দেখতেন তা শুধুমাত্র সে সময়ের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল না। এ ধরণের স্বপ্ন মনুয়্যত লাভের পরেও তিনি তাঁর জীবনে বহুবার দেখেছেন। হাদীসে কুদলী নামে যে হাদীসগুলো রয়েছে, তা অনেকই এ পর্যায়ভূক্ত। নবী ও রাসূলগণ যে স্বপ্ন দেখেন তা যে সম্পূর্ণরূপে সত্যের সাথে সাম স্যপূর্ণ এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

لقد صَدَقَ اللَّهُ رَسُولَهُ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ 

        বস্তুত আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর রাসূলকে প্রকৃতই সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যা সম্পূর্ণরূপে সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। (সূরা আল ফাত-২৭)

        এ ছাড়াও বিশ্বনবীর মনে বিভিন্ন সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নানা কথায় সৃষ্টি করে দেয়া হত। রমজান মাসে তিনি হেরা গুহায় চলে গেলেন। এরপর সেই মহান রাত বিশ্বমানবতার সামনে এসে উপস্থিত হলো, যে রাতে নির্ভুল জীবন বিধান বিশ্বনবীর মাধ্যমে অবতীর্ণ হতে থাকলো। সে সময়ের অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এ সময় হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালাম এসে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তাঁর কাছে ছিল একখন্ড রেশমী কাপড়। সে কাপড়ে কিছু লেখা ছিল। হযরত জিবরাঈল আলাহহিস্ সালাম আমাকে বললেন, 'পড়ুন'। আমি জবাব দিলাম আমি পড়তে পারি না। তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করলেন। তাঁর সে আলিঙ্গন এমন ছিল যে, আমার মনে হলো আমার প্রাণ বায়ু নির্গত হবে। তিনি আমাকে পুনরায় বললেন, 'পড়ুন'। আমি পূর্ববৎ বললাম, আমি পড়তে পারিনা। তিনি সেই আগের মতই আমাকে এমন জোরে জড়িয়ে ধরলেন যে, এবারেও আমার ধারণা হলো আমার প্রাণ বের হয়ে যাবে। আবারও তিনি আমাকে আদেশ করে বললেন, 'পড়ুন'। এবার আমি বললাম, আমি কি পড়বো? তিনি বললেন-

اقرأ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ - خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ

        পড়ুন আপনার রবের নাম সহকারে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। জমাট বাঁধা রক্তের এক পিন্ড হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ুন, আর আপনার রব্ব খুবই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের দ্বারা জ্ঞান শিখিয়েছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যা সে অবগত ছিল না।' (আ'লাক)

        আল্লাহর রাসূল বলেন, 'তিনি যা পড়লেন আমিও তাঁকে তা পড়ে পড়ে শোনালাম। তখন তিনি বিদায় নিলেন। তারপর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি জাগ্রত হলাম। তখন আমার উপলব্ধি হলো সমস্ত ঘটনাটি এবং যা আমাকে পড়ানো হয়েছিল তা আমার স্মরণে জাগরুক হয়ে আছে।' ঐতিহাসিক এবং গবেষকগণ বলেন, বিশ্বনবীর সাথে বাস্তবে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালাম যে আচরণ করবেন সে আচরণ তাঁর ঘুমের ভেতরে করার অর্থ হলো তা ছিল ঘটিতব্য ঘটনার ভূমিকা। ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন, এরপর আল্লাহর নবী সে পাহাড়ের গুহা থেকে বের হয়ে এলেন। পাহাড়ের মাঝামাঝি অবস্থানে আসার পরে তিনি তাঁর মাথার ওপর থেকে এক অশ্রুত কণ্ঠ শুনতে পেলেন। তাকে ডেকে বলা হচ্ছে, 'হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরাঈল!'

        এ কন্ঠ শ্রবণ করে তিনি ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালাম একজন অপূর্ব সুন্দর মানুষের আকৃতি ধারণ করে আছেন, কিন্তু তাঁর দুটো পাখা রয়েছে এবং সে পাখা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি পুনরায় বললেন, 'হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরাঈল!' তিনি হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালামের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর তিনি আকাশের যেদিকেই দৃষ্টি দিলেন সেদিকেই তাকে দেখতে পেলেন। সমস্ত আকাশ জুড়েই জিবরাঈল আলাইহিস্ সালামকে আল্লাহর নবী বিরাজ করতে দেখলেন। তিনি অবিচল থেকে সেই দৃশ্য দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখতে থাকলেন এবং অবস্থায় তিনি তাঁর কদম মোবারক কোন দিকেই নড়াতে পারছিলেন না। 

        তিনি দেখছিলেন তাঁর সন্ধানে তাঁর সহধর্মিনী লোক প্রেরণ করেছে, সে লোক তাঁর সন্ধান করছে কিন্তু তিনি সে লোককে বলতে পারলেন না তাঁর নিজের অবস্থানের কথা। লোকটি ফিরে চলে গেল। এরপর আকাশে আর কোন দৃশ্য দেখলেন না। তিনি ভীত কম্পিত অবস্থায় বাড়িতে ফিরে গেলেন এবং হযরত খাদিজাকে বললেন, 'আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও! আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও!' হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা তাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দিলেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ভীত কম্পিত অবস্থার অবসান হলে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, 'হে খাদিজা! আমার এ কি হলো!' তারপর তিনি সমস্ত ঘটনা তাঁর স্ত্রীকে শুনিয়ে বললেন, 'আমার নিজের জীবনের ভয় হচ্ছে।'

        হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, 'অসম্ভব! বরং আপনি সন্তুষ্ট হোন। আল্লাহর শপথ! আপনাকে আল্লাহ কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি সব সময় সত্য কথা বলেন এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম আচরণ করেন, তাদের হক আদায় করেন। মানুষের আমানত প্রত্যার্পণ করেন। অসহায় মানুষের বোঝা নিজের কাঁধে উঠিয়ে নেন। গরীবদেরকে নিজে উপার্জন করে সাহায্য করেন। মেহমানের হক আদায় করেন এবং উত্তম কাজে সহযোগিতা করেন।' এভাবেই রাসূলের ওপরে প্রত্যক্ষ ওহীর সূচনা হয়েছিল।

        এরপরে হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা আল্লাহর রাসূলকে সাথে করে ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে গেলেন। এ লোক ছিলেন বয়সে বৃদ্ধ ও অন্ধ। তিনি ছিলেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার চাচাত ভাই। তিনি পৌত্তলিকতা সহ্য করতে না পেরে পরবর্তীতে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরবী এবং হিব্রু ভাষায় ইন্জিল লিখতেন। হযরত খাদিজা তাকে সমস্ত ঘটনা জানালেন। তিনিও আল্লাহর রাসুলকে প্রশ্ন করে সমস্ত ঘটন। জেনে নিলেন। সবকিছু শুনে তিনি বলে উঠলেন, 'এ তো সেই ফেরেশতা যাকে মহান আল্লাহ হযরত মুছা আলাইহিস্ সালামের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। আফসোস! আপনার নবুয়্যত যুগে আমি যদি যুবক থাকতাম! আফসোস! আপনার জাতি যখন আপনাকে বহিষ্কৃত করবে! সে সময়ে যদি আমি জীবিত থাকতাম!' তাঁর এ সমস্ত কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম জানতে চাইলেন, 'আমার জাতি আমাকে বের করে দেবে?' ওয়ারাকা ইবনে নওফেল জানালেন, 'অবশ্যই বের করে দেবে। আপনার ওপরে যে দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে, এ দায়িত্ব যার ওপরেই অর্পিত হবে অথচ তাঁর সাথে শত্রুতা করা হবে না, এমন কখনো হয়নি। সে সময় পর্যন্ত আমি যদি জীবিত থাকি তাহলে আমি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবো।' গবেষকগণ বলেছেন, সাধারণতঃ বর্ণনা করা হয়ে থাকে যে, তাঁকে নবুয়্যত দান করা হয়েছিল চল্লিশ বছর বয়সে। কিন্তু গবেষণায় প্রমাণ হয়, তাঁর আগমন ঘটেছিল হস্তী বছর রবিউল আউয়াল মাসে। আর তাঁকে নবুয়্যত দান করা হয়েছিল হস্তী বছর হিসাবে রমজান মাসে। এ হিসাবে প্রথম ওহী অবতীর্ণের সময় তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর ছয় মাস।

         পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে ওহীর মাধ্যমে। মানবীয় মন-মস্তিষ্ক; হৃদয়ের ক্ষেত্র আল্লাহর ওহী ধারণ করার জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। নবী ও রাসূলদের ওপরে ওহী অবতীর্ণ হয়েছে, সেই সাথে আল্লাহ তা'য়ালা ওহী ধারণ করার যোগ্যতা তাঁদের ভেতরে সৃষ্টি করেছেন। তাঁদেরকে সেই শক্তিদান করা হয়েছে, যে শক্তি ওহী ধারণ করার জন্য প্রয়োজন। 'ওহী' আরবী শব্দ, এর অর্থ হলো গোপন ইঙ্গিত। শরিয়তের পরিভাষায় ওহী বলতে বুঝানো হয়, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের অন্তরে প্রবেশ করানো হয় বা ফেরেশতার মাধ্যমে অবতীর্ণ করা হয়। এ কারণে নবীদের অন্তরে বিশ্বাস এমন দৃঢ় হয় যে, সাধারণ মানুষের থেকে সে বিশ্বাসের মর্যাদা পৃথক। তাঁকে মহান আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে যে বাণী প্রেরণ করা হলো এ সম্পর্কে নবীর অন্তরে সামান্যতম দ্বিধা থাকে না। আরেক কথায় বলা যায়, জ্ঞান বৃদ্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যমের নাম হলো ওহী যা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয় এবং তা শুধু মাত্র নবী রাসূলদের জন্য নির্দিষ্ট। এর সম্পর্ক সরাসরি আলমে কুদস্এবং আলমে গায়েবের সাথে।

        ওহী কিভাবে অবতীর্ণ হয় তা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের প্রশ্নের জবাবে দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছেন। আল্লাহর নবী এ সম্পর্কে বলেছেন, 'কখনো তা আমার কাছে মনে হয় যে, ঘন্টার শব্দ অবিরাম গুঞ্জন সৃষ্টি করছে, আবার কখনো মৌমাছীর গুঞ্জনের ন্যায়, আবার কখনো ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে এসে আমাকে শোনায় আমি শুনি আল্লাহ আমার অন্তরে তা সুরক্ষিত করে দেন।' বিশ্বনবীর কথায় ওহী অবতীর্ণের অবস্থাকে যেভাবে উপমার মাধ্যমে বা ফেরেশতার আগমনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তা মানুষের বোধশক্তির কাছাকাছি হলেও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, প্রকৃত অবস্থা মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ব্যতীত অন্য কোন মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে না।

        যতদূর উপলব্ধি করা যায় ওহী অবতীর্ণের সময় প্রকৃত অবস্থা যে কি হয় তা বুঝিয়ে বলা নবীর আয়ত্বের বাইরে। তাই বলে এটা নবীর অক্ষমতাও নয়। যেমন, যে ব্যক্তি সাগরের অতল তলদেশে বিশেষ পোশাক পরিধান করে অবতরণ করে, সেখানে তাঁর প্রকৃত অবস্থা কেমন হয় তা দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সে প্রকাশ করে তাদের কাছে, যারা কোনদিন সাগরের তলদেশে অবতরণ করেনি। কিন্তু পানির নিচে সে যে অবস্থা উপলব্ধি করে, তাঁর সে উপলব্ধি বোধটাকে সে আরেকজনের ভেতরে সংক্রমিত করতে পারে না। তেমনি নবীগণ ওহী অবতীর্ণের সময় কেমন অবস্থার সৃষ্টি হয় তা বর্ণনা করতে পারেন কিন্তু তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি বোধটাকে তো আর শ্রোতার মনে প্রবেশ করাতে পারেন না। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলেছেন যে, 'এবং ওহীর এ অবস্থাটা আমার ওপর ভীষণ কঠিন বোধ হতে থাকে। পুনরায় যখন এই কষ্টকর অবস্থার অবসান ঘটে তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যা বলা হয়ে থাকে তা আমার মনের মধ্যে সংরক্ষিত হয়ে যায়।' ফেরেশতা যখন মানুষের আকৃতি ধারণ করে ওহী নিয়ে আসেন বা পর্দার আড়াল থেকে মহান আল্লাহর সাথে কথা হয় সে সময়ের অবস্থা হয় খুব সহজ। কিন্তু ওহী অবতীর্ণ করার প্রথম অবস্থা অর্থাৎ ওহী যখন মৌমাহীর গু নের মত বা ঘন্টার অবিরাম শব্দের মত আসতে থাকে তখন ভীষণ কষ্ট অনুভব হয়। প্রশ্ন হলো এমন কেন হয়?

        এ সম্পর্কে গবেষকগণ ধারণা করেন, 'মহান আল্লাহ মানুষকে মানুষের আবশ্যকীয় শর্ত ও স্বভাব চরিত্রের সাথে এমনভাবে জড়িত করে দিয়েছেন যে, নবী ও রাসূলদের মত পবিত্র এবং নিষ্পাপ সত্তাও নিজেদের সমস্ত পবিত্রতা থাকার পরেও মানবীয় প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে উপায় থাকে না। এ কারণে তাদের ওপরে যখন ওহী অবতীর্ণ হয় সে সময়ে তাদেরকে সেই উর্ধ্বজগতের প্রভাব আচ্ছন্ন করে রাখে এবং আল্লাহর নূরের ছায়ায় তাঁরা মহান আল্লাহর কথা গ্রহণ করেন।'একদিকে তাঁরা মানবীয় দেহধারী অপরদিকে তাঁরা আল্লাহর নূরের ছায়ায়-এ কারণে তাদের ওপরে উভয় জগতের প্রভাব নিপতিত হয়। সে সময়ে তাদের মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলোকে দমন করে তাঁকে এমন এক জগতের উপযোগী করা হয় যে, তাঁরা যেন ওহী শ্রবণ এবং ধারণ করতে সক্ষম হন।

        মানুষ নবীর মানবীয় বৈশিষ্ট্য অবদমিত করে তাকে যখন আল্লাহর নূরের জগতের উপযোগী করা হয় তখন তাঁর ভেতরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই হলো মানুষের চর্ম চোখে অস্থিরতা, নবীর কাছে তখন সেটাই কষ্টানুভব হয়। সেই কষ্টের অবসান যখন হয় তখন নবীকে সেই জগতের যাবতীয় পবিত্রতা আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তিনি তখন অপূর্ব শান্তি অনুভব করেন। যে সময়ের ভেতরে এ অবস্থার সৃষ্টি হয় সে সমটুকু হয় ক্ষণস্থায়ী।

        ওহী অবতীর্ণের বিশেষ অবস্থায় যখন মানবসুলভ অনুভূতি ও বোধ শক্তির ওপর উর্ধ্বজগতের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে, তখন মানবদেহে এক ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সে সময় নবীর শ্রবণ শক্তির সম্পর্ক স্থাপন হয় ওহী শ্রবণের সাথে, তখন তাঁর কাছে এ জড়জগতের কোন শব্দ স্থান পায় না। প্রথম প্রকারের ওহী অবতীর্ণের সময় নবীর যে অবস্থা হত এই অবস্থাকে ইউরোপিয় গবেষকগণ রোগ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, 'মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেই শিশুকাল হতেই মৃগীরোগী। এ রোগ তাঁর মাঝে মধ্যেই দেখা দিত।' তাদের কথা যে কত বড় মিথ্যা তা তারা জেনে বুঝেই শুধুমাত্র ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য লিখেছেন। হযরত হালিমা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার বাড়িতে অবস্থানকালে শিশু নবীর যে বক্ষবিদারণ করা হয় তখন থেকে নাকি তাঁর এ রোগের সৃষ্টি। আমাদের বক্তব্য হলো, সে সময়ে আল্লাহ নবীর বয়স ছিল পাঁচ বছর। ঐ পাঁচ বছর বয়সেই শুধুমাত্র একবার সে রোগ দেখা দিল আর মাঝের ৩৫ বছর দেখা দিল না, ঠিক যখন তিনি নবুয়্যত লাভ করলেন ৪০ বছর বয়সে, তখন পুনরায় সে রোগ দেখা দিল, এ সমস্ত প্রশ্ন ইসলাম বিদ্বেষী গবেষকদের মনে জাগেনি কেন? প্রকৃতপক্ষে জেনে বুঝেই, বিশ্বনবীর নবুয়্যতকে অস্বীকার এবং ইসলামকে কোন ঐশী বিধান হিসাবে স্বীকৃতি না দেবার লক্ষ্যেই তাঁরা বিশ্বনবীর ওপরে মৃগী রোগের অপবাদ চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী ও রাসুলদের ওপরে ওহী নাযিল করেছেন ফেরেপ্তার' মাধ্যমে। স্বয়ং আল্লাহ কোন নবী বা রাসূলের সাথে দেখা করে ওহী দান করেন না, এটা আল্লাহর নিয়ম নয় এবং কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় তাঁকে দেখা। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَمَا كَانَ لِبَشَرِ أَنْ يُكَلِمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيَا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولاً فَيُوْحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ

        কোন মানুষই এ মর্যাদার অধিকারী নয় যে, আল্লাহ তার সাথে প্রত্যক্ষভাবে কথা বলবেন। তিনি কথা বলেন হয় ওহীর মাধ্যমে, পর্দার আড়াল থেকে অথবা তিনি কোন বার্তাবহক প্রেরণ করেন এবং সে তাঁর আদেশে তিনি যা চান ওহী হিসেবে দেয়। (সূরা আশ্ শুরা-৫১)

        পর্দার আড়াল থেকে কথা বলার অর্থ হলো, বান্দা শব্দ শুনতে সক্ষম কিন্তু শব্দদাতাকে দেখতে সক্ষম নয়। হযরত মুছার সাথেও এ প্রক্রিয়াতেই আল্লাহ কথা বলেছিলেন। তূর পাহাড়ের পাদদেশ অবস্থিত একটি বৃক্ষ থেকে হঠাৎ তিনি আহ্বান শুনতে পেলেন। কিন্তু যিনি কথা বললেন, তিনি তাঁর দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেলেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ তেইশ বছর ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত করে সফলতা অর্জন করেছিলেন। এ সময়ে আল্লাহর বিধান সম্পর্কিত কোন কথা নিজের প্রবৃত্তি থেকে তিনি বলেননি। যা বলেছেন তা ওহীর ভিত্তিতেই বলেছেন। সূরা নাজমে মহান আল্লাহ বলেন-

وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَالاً وَحْيٌ يُوحَى 

        তিনি নিজের প্রবৃত্তি থেকে কথা বলেন না, এ তো একটা ওহী-যা তাঁর ওপরে অবতীর্ণ করা হয়।

        ময়দানে ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত করার ক্ষেত্রে যখন যে নিদের্শের প্রয়োজন তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই ওহীর মাধ্যমে রাসূলের কাছে অবতীর্ণ করা হতো। রাসূলের কাছে যে কোরআন অবতীর্ণ হতো, তার ব্যাখ্যা স্বয়ং রাসূলই করতেন। এ ক্ষেত্রেও রাসূল তাঁর চিন্তাধারা অনুসারে কোরআনের ব্যাখ্যা করেননি। বরং কোরআন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিনিধি। আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও তিনি ওহীর মাধ্যমেই অবগত হতেন। যদিও রাসূলের ব্যাখ্যার প্রতিটি শব্দ কোরআনের মতো ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণককৃত শব্দ নয়। কিন্তু তিনি যে জ্ঞান দিয়ে কোরআনের ব্যাখ্যা দিতেন, সে জ্ঞানও ওহীর উৎস থেকে লাভ করা জ্ঞান ছিল এবং তা ছিল ওহীর উৎসের ওপরই ভিত্তিশীল। রাসূলের এসব ব্যাখ্যা ও আল্লাহর কোরআনের মধ্যে শুধু এতটুকু পার্থক্য যে, কোরআনের শব্দ, ভাষা, অর্থ ও বক্তব্য সমস্ত কিছুই হলো আল্লাহর বাণী এবং তিনিই তা প্রেরণ করেছেন। আর রাসুলের কথার মূল ভাবধারা, বক্তব্য ও বিষয় ছিল মহান আল্লাহরই শিখানো। আল্লাহর শিখানো বক্তব্য তিনি নিজের ভাষায় মানুষের সামনে প্রকাশ করতেন। তাঁর এসব কথা ও বক্তব্য হাদীস নামে পরিচিত। তিনি নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে কোন কথা যদি বলতেন, তাহলে তাঁর সাথে স্বয়ং আল্লাহ কি ধরনের ব্যবহার করতেন এ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন-

وَلَوْ تَقولُ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِيْنَ 

        আমার নবী যদি নিজে রচনা করে কোন কথা আমার নামে চালিয়ে দিত, তাহলে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম এবং তার কণ্ঠ শিরা ছিন্ন করে ফেলতাম। (সূরা-হাক্কাহ্-৪৪-৪৬)

Post a Comment

0 Comments