মক্কার কুরাইশদের দাবী ছিল, এই কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়-স্বয়ং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রচনা করেছেন, এর রচয়িতা স্বয়ং তিনি। পক্ষান্তরে কোরআন যে স্বয়ং আল্লাহর বাণী, এর বাস্তব প্রমাণ ছিলেন স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম। তিনি সেই অবিশ্বাসীদের সামনেই উপস্থিত ছিলেন। নবুয়্যত লাভ করার পূর্বে দীর্ঘ চল্লিশটি বছর তিনি তাদের মধ্যে অতিবাহিত করেছেন। তাদের সম্মুখে তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের বিদায় লগ্নে প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেছেন।
তাঁর জীবনের সমস্ত কিছুর সম্পর্ক ঐ লোকগুলোর সাথেই বিদ্যমান ছিল, যারা দাবী করছিল, এ কোরআন স্বয়ং তিনি রচনা করেছেন। অথচ তাঁর জীবনের কোন একটি দিকও কোরআন অবিশ্বাসীদের কাছে অস্পষ্ট ছিল না। সুতরাং আল্লাহর রাসুল ছিলেন অবিশ্বাসীদের কাছে পরীক্ষিত সত্যবাদী ব্যক্তিত্ব। কোরআনের প্রতি সন্দেহ পোষণকারী লোকগুলো জানতো, তিনি নবুয়্যত দাবি করার পূর্বে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের জীবনে এমন কোন শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ পাননি বা এমন কোন গবেষক-চিন্তাবিদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য লাভ করেননি যে, তিনি তাদের কাছ থেকে কোন নতুন ধরনের জ্ঞান-তথ্য আয়ত্ব করে আজ নবুয়্যত দাবী করে তা প্রয়োগ করছেন।
যিনি কখনো অক্ষর জ্ঞান লাভ করার কোন সুযোগ লাভ করেননি, তাঁর মুখ থেকে কিভাবে হঠাৎ করেই জ্ঞানের সরোবর প্রবাহিত হতে থাকলো। কোরআন যেসব বিষয়বস্তুসহ অবতীর্ণ হচ্ছিলো, সেসব বিষয়ে ইতিপূর্বে মক্কার কোন লোক তাঁকে কোনদিন আলোচনা করতে শুনেনি বা এসব বিষয়ে তাঁর কোন আগ্রহ ছিল বলেও কেউ প্রমাণ দিতে পারেনি। দীর্ঘ চল্লিশ বছরে তাঁর কোন আপনজন, নিকটাত্মীয়, প্রিয় বন্ধু, স্ত্রী তাঁর কোন কাজে কর্মে, কথাবার্তায়, গতি-বিধিতে এমন কোন পূর্বাভাষ পাননি যে, এই লোকটি হঠাৎ করে নিজেকে নবী হিসাবে দাবী করতে পারে বা তাঁর মুখ থেকে এমন জ্ঞান গর্ভ কথা বের হতে থাকে, যে কথা পৃথিবীর নানা ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ। পবিত্র কোরআন যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা কিতাব, এটাই তো তার বাস্তব প্রমাণ। কারণ মানুষের মন-মস্তিষ্ক নিজের জীবন কালের কোন এক অধ্যায়েও এমন কোন জিনিস হঠাৎ করে পেশ করতে সক্ষম নয়, যার উন্মেষ ও বিকাশ লাভের সুস্পষ্ট নিদর্শন জীবনের পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহে পরিলক্ষিত হয় না।
কালক্রমে যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসাবে খ্যাতি লাভ করে, তার জীবনে শুরু থেকেই সে নিদর্শন 'স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং মানুষ অনুমান করতে পারে তার ভবিষ্যৎ জীবনে সে কি ধরনের খ্যাতি অর্জন করবে। যেমন একটি শিশু পরিণত বয়সে পৌঁছে কি ধরনের পান্ডিত্য অর্জন করবে, তা তার শৈশব কালে বিদ্যার্জনের প্রতি আকর্ষণ দেখেই অনুমান করা যায়। তেমন কোন নিদর্শন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রে, স্বভাবে, চলাফেরায়, কথাবার্তায় চল্লিশ বছর বয়স পূর্ণ হবার পূর্বে তাঁর একান্ত আপনজনরাও অনুমান করতে সক্ষম হননি যে, তিনি নবী হচ্ছেন এবং তাঁর মুখ থেকে কোরআন উচ্চারিত হবে। এ কারণেই মক্কার লোকজন ইসলাম বিরোধিতার এক পর্যায়ে অপবাদ উত্থাপন করলো যে, 'কোরআন মুহাম্মদের রচনা করা নয়, কারণ তাঁর ভেতরে আমরা কোরআন রচনা করার মতো কোন যোগ্যতা কখনো দেখিনি। বরং এই কোরআন তাঁকে কেউ শিখিয়ে দেয় আর তিনিস্তা মুখস্থ করে এসে আমাদের সামনে পেশ করে তা আল্লাহর বাণী বলে দাবী করেন।'
ইসলাম গ্রহণ না করার অজুহাতে হতভাগারা এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, এই অপবাদ আরোপ করার পূর্বে সামান্য একটি কথা চিন্তা করার অবকাশ তারা পেলো না, শুধু মক্কা ও আরব সাম্রাজ্যই নয়-সারা পৃথিবীতে এমন যোগ্যতাসম্পন্ন কোন লোকের অস্তিত্ব ছিল না, 'যিনি কোরআনের মতো সর্ববিষয়ে জ্ঞান সম্পন্ন কিতাব রচনা করতে সক্ষম এবং তা অন্য কোন মানুষকে শিক্ষা দিতে পারেন। আর এই ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন কোন লোকের অস্তিত্ব ' পৃথিবীতে থাকলেও তার পক্ষে তো আত্মগোপন করে থাকা ছিল একেবারে অসম্ভব। সুতরাং কোরআন যে, কোন মানুষের রচনা নয় বরং তা আল্লাহর বাণী-এটাই তো অব্যর্থ প্রমাণ। এ কথা তারা অনুভব করেই পরবর্তীতে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
আরেকটি বিষয় ছিল অলংঘনীয়, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়্যত পূর্ববর্তী • জীবনের অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ। তাঁর দীর্ঘ চল্লিশ বছরের জীবনে কোন এক অসতর্ক মুহূর্তেও একান্ত আপনজনও প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, মিথ্যা ও অসততা বা অন্যান্য নৈতিক কদর্যতার কোন চিহ্ন তাঁর চরিত্রে মুহূর্তের জন্যেও প্রকাশ হতে দেখেনি। গোটা আরব সাম্রাজ্যে তাঁর পরিচিত-অপরিচিত এমন একজন লোককেও অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে না, যিনি আল্লাহর রাসূলের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের জীবনে অশোভন কিছু দেখেছে বলে দাবি করতে পারে। বরং যে কোন লোক তাঁর সংস্পর্শে এলেই তাঁকে সত্যবাদী, আমানতদার, সত্যদর্শী, অতিবিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য, দয়ালু, মেহেরবান ইত্যাদি অনুপম গুণাবলী প্রত্যক্ষ করে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাঁর মতো সমস্ত দিক দিয়ে মহৎ ব্যক্তি আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পায়নি।
খোদ মক্কার লোকজন-পরবর্তীতে যারা প্রাণের দুশমনে পরিণত হয়েছিল, তারাও তাঁকে 'এই ব্যক্তি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য' বলে সর্বমহলে প্রচার করেছিল। নবুয়্যত লাভ করার মাত্র পাঁচ বছর পূর্বে, সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। কা'বা ঘরের পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু হলো। তারপর নির্মাণ কাজ ঐ স্থান পর্যন্ত গিয়ে উপনীত হলো, যে স্থানে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম তাঁর সন্তান হযরত ইসমাঈল আলাইহিস্ সালামের সহযোগিতায় কালো পাথর বা হারে আস্তয়াদ স্থাপন করেছিলেন। কথিত আছে, এ পাথর হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম জান্নাত থেকে এনেছিলেন। এই পাথর স্থাপন করা নিয়ে সমস্ত গোত্রের মধ্যে তর্কবিতর্ক শুরু হলো। প্রতিটি গোত্রেরই আকাংখা, এই জান্নাতী পাথর স্থাপন করার দুর্লভ সম্মান তারাই অর্জন করবে। এ তর্কবিতর্ক শেষ পর্যন্ত এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হলো যে, প্রতিটি গোত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। পাঁচদিন পরে তাঁরা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য কা'বার প্রঙ্গণে উপস্থিত হলো।
এ সময়ে বনী মখজুম গোত্রের সব থেকে বয়স্ক ব্যক্তি ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার ভাই আবু উমাইয়া (এ নামের বিষয়ে মতানৈক্য আছে) উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করেলা, 'হে কুরাইশগণ! তোমরা এই একটা বিষয়ে এ ধরণের ঝগড়া না করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হও যে, কাল সকালে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি কা'বার দরোজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তোমরা তা সবাই গ্রহণ করবে।' বয়স্ক ব্যক্তির এ কথা সবাই গ্রহণ করলো। সেদিনের মত তাঁরা বিদায় নিল এবং পরদিন তাঁরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলো যে, তাদের আল আমীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কা'বায় প্রবেশ করছে। সমবেত জনতা আনন্দে চিৎকার করে উঠলো, 'হাযাল আমীন রাদিনা, হাযা মুহাম্মাদ! আতা কুমুল আমীন। অর্থাৎ এ তো আমীন! আমাদের অমত নেই, তোমাদের কাছে আমীন এসেছে!'
বিষয়টা তাঁরা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রকাশ করলো। তিনি জানতে পারলেন, তাকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তখন তিনি বললেন, 'আমাকে তোমরা একটা বড় কাপড় এনে দাও।' একজন একটা বড় কাপড় এনে দিল। তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সে কাপড়টা বিছিয়ে কাপড়ের ওপরে নিজের হাতে পাথরটা রাখলেন। তারপর তিনি সমস্ত গোত্র প্রধানদেরকে বললেন, 'আপনারা সবাই এই পাথরসহ কাপড় ধরে ওঠাতে থাকুন।' তারা সবাই কাপড়ের বিভিন্ন অংশ ধরে উঁচু করতে থাকলো। যে স্থানে পাথর স্থাপন করার সিদ্ধান্ত সে. পর্যন্ত কাপড় পৌছলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাপড় থেকে পাথর উঠিয়ে যথাস্থানে তা স্থাপন করলেন। এভাবে তাঁকে নবী ও রাসূল নির্বাচিত করার পূর্বেই মক্কার কুরাইশদেরকে দিয়ে তাঁকে একজন 'বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি' হিসাবে স্বীকার করিয়ে নিয়েছিলেন।
সুতরাং, যে মানুষটি নিজের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের জীবনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম কোন ব্যাপারেও কখনো অসততা, প্রতারণা, মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেননি, সেই তিনিই হঠাৎ করে এতবড় একটা মিথ্যা ও প্রতারণামূলক দাবীসহকারে দন্ডায়মান হবেন, নিজের রচনা করা অথবা কারো শিখানো কল্পিত জিনিসকে পূর্ণ শক্তিতে ও প্রবলভাবে, দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর নামে প্রচারিত করবেন, এই ধারণা বা অবকাশই কিভাবে থাকতে পারে? সুতরাং পারিপার্শ্বিকতা ও বস্তবতাই প্রমাণ করে দেয় যে, কোরআন মহান আল্লাহর অবতীর্ণ করা কিতাব।
তিনি স্বয়ং নিরক্ষর ছিলেন। তিনি যদি অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি হতেন, কিছু লিখতে ও পড়তে সক্ষম হতেন, তাহলে ধারণা করা যেত যে, তিনি নিজে হয়ত কিছু রচনা করতে পারেন। এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষী দিচ্ছেন-
وَمَا كُنْتَ تَعْلُوا مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلَا تَخْطُهُ بِيَمِنِكَ إِذَا الأَرْتَاب الْمُبْطِلُونَ
(হে রাসূল) ইতিপূর্বে তুমি কোন কিতাব পড়তে না এবং স্বহস্তে লিখতেও না, যদি এমনটি হতো, তাহলে অবিশ্বাসীরা সন্দেহ পোষণ করতে পারতো। (সূরা আল 'আনকাবৃত-৪৮)
আল্লাহর রাসূলের স্বদেশবাসী, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুমহল, পরিচিতজন-যাদের মধ্যে তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর অতিবাহিত করলেন, তারা সবাই এ কথা অত্যন্ত ভালোভাবে অবগত ছিল যে, লোকটি লিখতে জানে না, পড়তে জানে না, জীবনে কোনদিন কোন কিতাব পাঠ করেনি।
অথচ এমন এক ব্যক্তির মুখ থেকে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের সত্য ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অকল্পনীয় তথ্যাবলী, মানব জীবন বিধানের পরিপূর্ণ দিকসমূহ; ধর্মবিশ্বাসের মূলনীতিসমূহ উচ্চারিত হচ্ছে, তা কোন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ থেকে আল্লাহর ওহী ব্যতীত প্রকাশ পেতে পারে না। যদি তিনি অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হতেন, মানুষ যদি তাঁকে কখনো লিখতে-পড়তে এবং অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে দেখতো, তাহলে অবিশ্বাসীদের এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করার অবকাশ থাকতো যে, এসৰ জ্ঞাম ওহীর ভিত্তিতে নয় বরং জাগতিক মেধা নিয়োগ করে অর্জন করা হয়েছে-এসব জ্ঞান সাধনালব্ধ জ্ঞান।
পক্ষান্তরে তাঁর নিরক্ষরতা তাঁর সম্পর্কে এসব বিষয়ে সন্দেহ-সংশয় পোষণ করার কোন অবকাশই রাখেনি। সুতরাং, একজন নিরক্ষর মানুষকে 'কোরআনের রচয়িতা' বলে অপবাদ দিয়ে ঈমান আনা থেকে বিরত থাকা, আর ধ্বংসের অতলে তলিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
একজন সম্পূর্ণ নিরক্ষর মানুষের পক্ষে পবিত্র কোরআনের মতো একটি অতুলনীয় কিতাব মানুষের সামনে পেশ করা এবং এমনসব অভূতপূর্ব বিশ্বয়কর ঘটনাবলী প্রদর্শন করা, যেগুলোর জন্য বহু পূর্ব থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করার কোন উদ্যোগ কারো দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি, এসব বিষয় তো অটল বাস্তবতা।
এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে দেয় যে, তিনি সত্য নবী এবং কোরআন তাঁর ওপরে আল্লাহর অবতীর্ণ করা কিতাব। সারা পৃথিবীতে যারা খ্যাতি অর্জন করেছে, তাদের কারো জীবনী পাঠ করলেই এসব উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায় যে, তার ব্যক্তিত্ব গঠনে ও ক্ষুরণে এবং তার অসাধারণ কৃতিত্ব প্রকাশের জন্য তাকে প্রস্তুত করার ব্যাপারে পরিবেশ সক্রিয় ছিল। তার পরিবেশ ও তার ব্যক্তিত্ব গঠনের উপাদানসমূহের ভেতরে একটি সুস্পষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়।
পক্ষান্তরে নিরক্ষর নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব গঠনের উপদানের সাথে কোন ধরনের ন্যূনতম সম্পর্ক থাকতে পারে, এমন সব উপাদান সে যুগে গোটা পৃথিবীতে কোথাও অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে না। এই অটল বাস্তবতার ভিত্তিতেই এ কথার স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের চিন্তাবিদগণ বাধ্য হয়েছেন যে, বিশ্বনবীর সত্তা শুধুমাত্র একার্ড নিদর্শনের নয়-বরং তা অসংখ্য নিদর্শনের সামষ্টিকরূপ।
এ শ্রেণীর লোক এ দাবী করে যে, রাসূল সাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন এবং রাসূলের সাক্ষর জ্ঞান থাকা তাঁর সম্মান ও মর্যাদার বিষয়। এ কথা যারা বলেন, তারা চরম দুঃসাহস প্রদর্শন করেন। কেননা, পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ই ঘোষণা দিয়েছে, তিনি নিরক্ষর ছিলেন এবং এই নিরক্ষরতাই তাঁর নবুয়্যতের এবং কোরআন আল্লাহর বাণী হওয়ার একটি শক্তিশালী প্রমাণ। রাসূল অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন, এর স্বপক্ষে কিছু সংখ্যক লোক, হাদীস থেকে প্রমাণও পৈশ করে থাকে। অথচ যেসব হাদীসের ভিত্তিতে রাসূলের অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া প্রমাণ করা হয়েছে, সেসব হাদীস-হাদীস হিসাবে যোগ্য হওয়ার প্রথম মানদন্ডেই পরিত্যক্ত বলে গণ্য হয়। কারণ কোরআনের বর্ণনার বিপরীত কথাকে হাদীস বলে গ্রহণ করা যাবে না।
একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, হোদাইবিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হওয়ার পর যখন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করা হবে, তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের সাথে 'রাসূলুল্লাহ' শব্দ সংযোজন করতে প্রতিপক্ষ প্রবলভাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। অবশেষে আল্লাহর নবী চুক্তির লেখক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন, 'রাসূলুল্লাহ' শব্দটি কেটে দেন। তিনি 'রাসূলুল্লাহ' শব্দটি নিজের হাতে কেটে দিতে অস্বীকার করলে আল্লাহর রাসুল স্বয়ং নিজের হাতে কলম নিয়ে 'রাসূলুল্লাহ' শব্দটি কেটে দিয়ে সেস্থলে 'মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ' অর্থাৎ নিজের নামটি লেখেন। এ হাদীসটি বোখারী ও মুসলিম শরীফে ভাষা, বর্ণনা ও শব্দের পার্থক্যসহ বেশ কয়েক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব হাদীস পাঠ করে অনেকে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম লিখা পড়া জানতেন না। তিনি ছিলেন উম্মী নবী। অতএব নিজের নাম তিনি কিভাবে লেখলেন এবং কিভাবে এটা সম্ভব হলো। এ সম্পর্কে আল্লামা শিবলী নোমানী (রাহ) ব্যাখ্যা দান করেছেন যে, 'লেখা পড়ার কাজ কর্ম যখন দৈনন্দিন জীবন ধারার একটা অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তখন লেখা পড়া না জানা একজন মানুষ অন্যের লেখা দেখে নিজের নামের অক্ষর বিন্যাস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, নিজের নাম. কোন কোন অক্ষরে লেখা যায়, এ সম্পর্কে সেই অক্ষরের সাথে পরিচিত হওয়া অসম্ভবের কিছুই নয়।'
প্রকৃত ব্যাপার ছিল এটাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে প্রতি নিয়ত তাঁকে লেখার সাথে পরিচিত হতে হয়েছে। ইতিপূর্বেও তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অনেকের সাথে লিখিত সন্ধি করেছেন, এ সমস্ত লেখার সাথে তাঁকে পরিচিত হতে হয়েছে। প্রতিটি কাজই লিখিতভাবে হয়েছে। সুতরাং লেখালেখির পরিবেশে থেকে বিভিন্ন অক্ষরের সাথে পরিচিত হওয়া একজন নিরক্ষর লোকের পক্ষে অসম্ভব নয়। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হয়ত এভাবেই অক্ষরের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। অথবা সেটা ছিল তাঁর শত সহস্র মু'জিযার একটি।
0 Comments