কোরআনের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ পৃথিবী সৃষ্টি করে মানুষসহ অসংখ্য প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। এসব প্রাণী পৃথিবীতে কিভাবে জীবন পরিচালিত করবে, সে প্রবণতা সৃষ্টিগতভাবেই তাদের ভেতরে দান করা হয়েছে। প্রতিটি প্রাণীর জন্য আল্লাহ তা'য়ালা যে খাদ্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তারা সে খাদ্যই আহার করে জীবন ধারণ করে। মাংসাশী প্রাণীসমূহ বৃক্ষ-তরু-লতা আহার করে না। আবার উদ্ভিদ আহার করে যেসব প্রাণী, তারা রক্ত-মাংস আহার করে না। প্রাণীসমূহকে যেসব নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে দেখা যায়, তা তাদের সৃষ্টিগত প্রবণতা। এ প্রবণতা দিয়েই আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের জন্য পৃথক কোন বিধি-বিধানের প্রয়োজন হয় না। মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকে যে নিয়ম-কানুনের অধীন করে সৃষ্টি করেছেন, তারা সে নিয়মের অধীনেই জীবনকাল অতিবাহিত করে। এ জন্য কখনো এটা দেখা যায়নি যে, মাছ হঠাৎ করে পানি ত্যাগ করে স্থলে এসে বসবাস করছে। আবার বাঘকে এমন দেখা যায়নি যে, তারা বন-জঙ্গল ত্যাগ করে সমুদ্রে গিয়ে বসবাস করছে। তারা সবাই আল্লাহর নিয়মের অধীন। আর আল্লাহর নিয়মের কোন পরিবর্তন কখনো হয় না। আল্লাহ বলেন-

فَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلاً وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَحْوِيلاً 

        তুমি আল্লাহর নিয়মে কোন ধরনের পরিবর্তন হতে, কোন প্রকারের ব্যতিক্রম হতে দেখতে পাবে না। (সূরা ফাতির)

        সুতরাং, আইন-কানুন, বিধি-বিধানের প্রয়োজন হয় মানুষের। মানুষের জন্যই জীবন বিধানের প্রয়োজন। এ প্রয়োজনীয়তা পূরণের লক্ষ্যেই পৃথিবীতে নবী ও রাসূলদের আগমন ঘটেছে এবং তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ তা'য়ালা ওহী যোগে জীবন বিধান প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পবিত্র কোরআন প্রেরণ করা হয়েছে। এ কোরআন দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান জ্ঞানের কোন বিশেষ শাখা নিয়ে শুধু আলোচনা করে না, বরং মানব জাতির জন্য যেখানে যা প্রয়োজন তাই নিয়ে এ কোরআনে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এ কোরআনের সবটুকুই মানুষের জন্যই আলোচনা করা হয়েছে। মানুষই হলো এ কিতাবের মূল আলোচ্য বিষয়। মানুষকে বোঝাতে গিয়ে অন্যান্য বিষয় যতটুকু প্রয়োজন-ঠিক ততটুকুই আলোচনা করা হয়েছে।

        মানুষের যখন কোনই অস্তিত্ব ছিল না, তখন থেকে শুরু করে, তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত এ কিতাব আলোচনা করেছে। আত্মার জগতে মানুষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁর প্রতিপালক সম্পর্কে এবং সে কি জবাব দিয়েছিল, সে কথা এ কোরআন আলোচনা করেছে। আবার সেখান থেকে মাতৃগর্ভে যখন তাকে প্রেরণ করা হলো, তখন সে কি অবস্থায় ছিল, সে বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে। সূরা যুমার-এর ৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَتِكُمْ خَلْقًا مِنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلمت ثلث ذَالِكُمُ اللَّهُ رَبِّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ -

        তিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে তিন তিনটি অন্ধকার পর্দার অভ্যন্তরে একের পর এক আকৃতি দান করে থাকেন। (যিনি এ কাজগুলো সম্পাদন করেন) সেই আল্লাহই তোমাদের রব্ব। তিনিই প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের একচ্ছত্র অধিকারী-তিনি ব্যতিত কোন ইলাহ নেই।

        তিনটি পর্দা বলতে এখানে মায়ের পেট বাচ্চা যে থলির ভেতরে অবস্থান করে সে থলি এবং যে ঝিল্লি দিয়ে বাচ্চা আবৃত থাকে সে ঝিল্লিকে বুঝানো হয়েছে। পৃথিবীতে আগমন পূর্ব মুহূর্তে মানুষের কি অবস্থা ছিল, তা আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আস্ সাজদায় বলেন-

الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَا خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلْلَةٍ مِنْ مَاءٍ مِّهِينٍ ثُمَّ سَوَّهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِنْ رُوحِهِ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيْلاً مَا تَشْكُرُونَ

        যে জিনিস তিনি সৃষ্টি করেছেন তা উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে, তারপর তার বংশ উৎপাদন করেছেন এমন সুত্র থেকে যা তুচ্ছ পানির মতো। তারপর তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন এবং তার মধ্যে নিজের রুহ ফুঁকে দিয়েছেন, আর তোমাদের কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছেন, তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।

        মানুষ সৃষ্টির উপাদান ও প্রক্রিয়া, তারপর একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষ কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করবে, তার শারীরিক কাঠামো, তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য এবং তার দায়িত্ব-কর্তব্য কি, ইত্যাদি বিষয় স্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছি আমি এবং এর ভেতরে যা কিছুই রয়েছে, কোন কিছুই আমি বৃথা সৃষ্টি করিনি। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এসব সৃষ্টি করেছি। পৃথিবীর সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছি তোমাদের কল্যাণের জন্য। এসব কিছুই তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছি। আর তোমাদের ওপরে আদেশ দিয়েছি, তোমরা কেবল আমারই আদেশ পালন করবে। আমার বিধান অনুসরণ করবে। আমার দাসত্ব ব্যতীত আর কারো দাসত্ব করবে না আর আমার দাসত্বের মধ্যেই তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

        অর্থাৎ এ কিতাব মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ নিয়ে আলোচনা করেছে। কোন কাজ করলে, কোন পথে অগ্রসর হলে, কিভাবে জীবন পরিচালিত করলে মানুষ একটি সুখী সমৃদ্ধশালী শান্তিপূর্ণ, ভীতিহীন, বৈষ্যম্যহীন, শোষণমুক্ত, নিরাপত্তপূর্ণ পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতি গঠন করতে সক্ষম হবে এবং পরকালীন জীবনে কিভাবে কল্যাণ লাভ করতে পারবে, সে বিষয়ে এ কোরআনে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ কোন পথে নিজেকে অগ্রসর করালে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিজেকে পৌঁছে দেবে, পৃথিবীর জীবন হবে অস্থিরতা আর শঙ্কা জড়িত, পরকালীন জীবনে তাকে নিক্ষিপ্ত হতে হবে যন্ত্রণাময় জীবনে, তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষকে নির্ভুল কর্মনীতি ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার দিকে মানুষকে অগ্রসর করানোর লক্ষ্যেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং মানুষকে নিয়ে এ জন্যই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

        পবিত্র কোরআনের আলোচনার বিষয়বস্তুর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আরেকটি বড় সত্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। আর সে সত্যটি হলো, কোরআন যে কোন মানুষের রচনা করা কিতাব নয়, তা যে কোন চিন্তাশীল পাঠকই স্পষ্ট অনুভব করতে সক্ষম হয়। কারণ এ কিতাব যাঁর ওপরে এবং যে পরিবেশে অবতীর্ণ করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন নিরক্ষর এবং সে পরিবেশ ছিল মূর্খতায় আচ্ছন্ন। একজন নিরক্ষর মানুষের পক্ষে অজ্ঞানতার পরিবেশে অবস্থান করে এমন বৈজ্ঞানিক আলোচনা সমৃদ্ধ কিতাব রচনা করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়, এ সত্য কোরআনের আলোচিত বিষয়ই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

Post a Comment

0 Comments