কোরআন বিরোধিদের ওপরে কোরআনের প্রভাব কী

        পবিত্র কোরআন যখন অবতীর্ণ হচ্ছিলো, তখন যারা এর বিরোধিতা করেছে, তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল-এই কিতাবকে তারা না পারছিল আল্লাহর বাণী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে, না পারছিল এটাকে মানুষের রচনা করা কিতাব হিসাবে প্রমাণ করতে। এই কিতাবকে যদি তারা আল্লাহর বাণী হিসাবে স্বীকৃতি দান করে তাহলে তাদের নেতৃত্বের অবসান ঘটে এবং সেই সাথে আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বিষয়টি তাদের কাছে ছিল একেবারেই অসহনীয়। অপরদিকে নবীর বিরুদ্ধে তারা যে অপপ্রচার চালাচ্ছিলো, সে অপপ্রচারের ফল হচ্ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত।

        জ্ঞান-বিবেক, বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ-যাদের অন্তরে ছিল সত্যানুসন্ধিৎসা, তারা ক্রমেই আল্লাহর কোরআনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলামী আন্দোলনের পতাকা তলে সমবেত হচ্ছিলো। প্রতিটি যুগে ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই চিরসত্যই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। কোরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অস্ত্র যতই শানিত করা হয়েছে, সাধারণ মানুষ ততই এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।

        সে যুগে যারা কোরআন বিরোধিতার নেতৃত্ব দিচ্ছিলো, তারা এটা স্পষ্ট অনুভব করেছিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআনের যে বাণী প্রচার করছেন, তার প্রভাব অপ্রতিরোধ্য। এ কারণে তারা সাধারণ মানুষকে এই কোরআন শোনা থেকে বিরত থাকতে বলতো। মক্কার ইসলাম বিরোধিদের ইসলাম নির্মূলের অগণিত পরিকল্পনার মধ্যে একটি পরিকল্পনা ছিল এই যে, রাসুল যখনই কোন সমাবেশে মানুষকে কোরআনের কথা শোনাবেন, তখনই সেখানে একটা শোরগোল সৃষ্টি করে কোরআন' শোনানোর পরিবেশ নষ্ট করে দেয়া। নানাভাবে কোরআনের মাহফিলে বাধা সৃষ্টি করা, যেন মানুষের ওপরে এই কোরআন কোন প্রভাব সৃষ্টি করার সুযোগ না পায়।

        ইসলাম বিরোধী শক্তি এই অস্ত্র শুধু সে যুগেই প্রয়োগ করেনি, বর্তমানেও তারা তাদের সেই. পুরনো অস্ত্র প্রয়োগ করে কোরআন শোনা থেকে মানুষকে বিরত রাখার অপচেষ্টা করে। ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা কোরআনের মাহফিল অনুষ্ঠিত হবার পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা করে থাকে। সে যুগে ইসলাম বিরোধিরা সাধারণ মানুষকে কোরআনের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য বলতো-

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لهذا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ 

        এসব কাফেররা বলে, এ কোরআন তোমরা কখনো শুনবে না। আর যখন তা শুনানো হবে তখন শোরগোল সৃষ্টি করবে। হয়তো এভাবে তোমরা বিজয়ী হবে। (হা-মীম সেজদা-২৬)

        কোরআন কী অসাধারণ প্রভাব ক্ষমতার অধিকারী কিতাব, এই কিতাবের দাওয়াত যিনি দিচ্ছেন তিনি কেমন অতুলনীয় সম্মান ও মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি এবং তাঁর এই ব্যক্তিত্বের সাথে উপস্থাপনার ভঙ্গি কেমন বিস্ময়করভাবে কার্যকর হচ্ছে, তা ইসলাম বিরোধী নেতৃবৃন্দ স্পষ্ট অনুভব করতে পারতো। তারা এ কথা বিশ্বাস করতো, এ ধরনের উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির জবান থেকে এমন চিত্তাকর্ষক-হৃদয়গ্রাহী মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে এই দৃষ্টান্তহীন কালাম যার কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে, সে ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত কোরআনের আন্দোলনের প্রতি দুর্বল হবেই হবে। অতএব যে প্রকারেই হোক, কোরআনের মাহফিল অনুষ্ঠিত হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু যারা এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতো, স্বয়ং তারাই নিজেদের অজান্তে আল্লাহর কোরআনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়তো।

        বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থসমূহে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায় যে, সিজদার আয়াত সম্বলিত সূরা আন্ নাজম-ই সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকেই এই হাদীসের যেসব অংশসমূহ হযরত আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ, হযরত আবু ইসহাক ও হযরত জুবাইর ইবনে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে জানা যায়, সূরা আন্ নাজম-ই কোরআনের প্রথম সূরা যা আল্লাহর রাসূল কুরাইশদের এক সমাবেশে (আর ইবনে মারদুইয়ার বর্ণনা মতে হারাম শরীফে) সর্বপ্রথম তেলাওয়াত করে শুনিয়েছিলেন। সমাবেশে কাফির ও মুমিন উভয় শ্রেণীর লোকজনই উপস্থিত ছিল।

        শেষের দিকে আল্লাহর নবী যখন সেজদার আয়াত তেলাওয়াত করলেন, তখন উপস্থিত সবাই তাঁর সাথে সেজদায় চলে গেল। ইসলাম বিরোধিদের বড় বড় নেতারা পর্যন্ত-যারা অন্যদের অপেক্ষা বেশী বিরোধী ছিল-সেজদা না করে পারলো না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, আমি কাফিরদের মধ্যে মাত্র একজন-উমাইয়া ইবনে খালকে দেখলাম, সে সিজদা করার পরিবর্তে কিছুটা মাটি তুলে কপালে লাগিয়ে বললো, . 'আমার জন্য এটাই যথেষ্ট।' আর পরবর্তী সময়ে আমি এ দৃশ্যও দেখতে পেয়েছি যে, লোকটি কুফরি অবস্থায়ই নিহত হলো।

        এ ঘটনার দ্বিতীয় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হচ্ছেন হযরত মুত্তালিব ইবনে আবু ওয়াদা'আ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু, তিনি তখন পর্যন্ত ইসলাম কবুল করেননি। হাদীস গ্রন্থ নাসায়ী ও মুসনাদে আহমাদে তাঁর নিজের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সূরা নাজম তেলাওয়াত করে সিজদা করলেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর সাথে সাথে সেজদায় পড়ে গেল, কিন্তু আমি সেজদা করলাম না। বর্তমানে তার ক্ষতিপূরণ বাবদ আমি এভাবে করি যে, এ সূরা তেলাওয়াত কালে আমি কক্ষণ-ই সেজদা না করে ছাড়ি না।

        নবুয়্যত লাভের পর পাঁচটি বছর পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলমাত্র গোপন বৈঠক-মজলিসে ও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে আল্লাহর কালাম শুনিয়ে লোকদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোন সাধারণ জনসমাবেশে কোরআনুল কারীম তেলাওয়াত করে শোনানোর কেন সুযোগই তাঁর হয়নি। ইসলাম বিরোধিদের প্রবল প্রতিরোধই ছিল এর প্রধান অন্তরায়। নবীর ব্যক্তিত্বে, তাঁর প্রচারমূলক কার্যাবলী ও তৎপরতার কী তীব্র আকর্ষণ ছিল এবং কোরআনের আয়াতসমূহের কী সাংঘাতিক প্রভাব ছিল, সে বিষয়ে তারা ভালোভাবেই অবহিত ছিল। এ কারণেই তারা নিজেরাও এই কালাম না শুনার এবং অন্যরাও যেন শুনতে না পারে সে জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করতো না। নবীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের ভুল ধারণা প্রচার করে তারা ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াতকে অবরুদ্ধ ও দমন করতে চেয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে একদিকে তারা নানা স্থানে এ কথা রটিয়ে দিচ্ছিল যে, মুহাম্মাদ বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছে এবং এখন অন্য লোকদেরকে বিভ্রান্ত-পথভ্রষ্ট করতে চেষ্টা করছে। অপরদিকে তিনি যেখানেই কোরআন শুনানোর জন্য চেষ্টা করতেন সেখানেই হট্টগোল, কোলাহল ও চিৎকার করা তাদের একটা স্থায়ী নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁকে কী কারণে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত বলা হচ্ছে, লোকেরা যাতে তা জানতেই না পারে, এই শোরগোল করার মূলে এটাই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

        এই পরিস্থিতিতে একদিন আল্লাহর রাসূল হারাম শরীফের মধ্যে কোরাইশদের একটি বড় সমাবেশে আকস্মিকভাবে ভাষণ দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। এ সময় আল্লাহর পক্ষ হতে বিশ্বনবীর মুখে যে ভাষণটি পরিবেশিত হয়েছে, তা-ই পবিত্র কোরআনে সূরা আন্ নাজম রূপে বিদ্যমান। এ কালামের প্রভাব এত তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছিল যে, আল্লাহর নবী যখন এ সূরা তেলাওয়াত করছিলেন, তখন তার বিপরীতে ইসলাম বিরোধিগণ এতটাই মোহিত হয়ে পড়েছিল যে, তারা হৈ-চৈ হট্টগোল করবে-এমন কোন চেতনাই তাদের ছিল না। ভাষণ শেষে নবী যখন সেজদায় পড়ে গেলেন, তখন তাঁর সাথে সাথে উপস্থিত ইসলাম বিরোধিগণও সেজদায় পড়ে গেল।

        এটা ছিল কোরআনের প্রতি তাদের একটা বড় দুর্বলতা। তারা এ দুর্বলতা প্রদর্শন করে পরে বিব্রত বোধ করছিল। সাধারণ লোকজন তাদেরকে তিরস্কার করতে লাগলো যে, 'যে কালাম গুনতে তারাই নিষেধ করে আর সে কালাম শুনে স্বয়ং নিষেধকারী নেতাগণই সেজদায় পড়ে যায়। নেতাবৃন্দ মনোযোগ দিয়ে মুহাম্মাদের কোরআনও শুনেছে এবং সেজদাও করেছে।' এই পরিস্থিতিতে ইসলাম বিরোধী নেতাগণ নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

        হযরত ওমরের মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষও কোরআনের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোরআনের প্রভাব তাঁকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। আল্লাহর রাসূলকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে একদিন রাতে তিনি রাসূলকে অনুসরণ করছিলেন। গভীর রাতে আল্লাহর নবী কা'বাঘরে নামাজ আদায় করার জন্য গিয়েছিলেন। আল্লাহর রাসুল নামাজে দাঁড়িয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন।

        হযরত ওমর তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি অন্ধকারে অদূরে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নবীর পবিত্র জবান মোবারক থেকে কোরআন শুনছিলেন। কোরআনের বাণীর অপূর্ব সামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করে তাঁর মনে এ কথার উদয় হলো যে, 'এই মুহাম্মাদ সম্ভবত উচ্চমানের কবি হয়ে গিয়েছেন। তিনি মনে মনে এ কথাগুলো বলছিলেন, আর সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলের মুখ থেকে উচ্চারিত করালেন-

وَمَا هُوَ بِقَولِ شَاعِرٍ - قَلِيْلاً مَّا تُؤْمِنُونَ

        এটা কোন কবির কথা নয়, তোমরা খুব কমই ঈমান এনে থাকো। (সূরা আল-হাক্কাহ্-৪১)

         বিস্ময়ের ধাক্কায় স্তব্ধ অনড় হয়ে গেলেন হযরত ওমর। অবাক দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে রইলেন আল্লাহর রাসূলের দিকে। বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতেই তিনি মনে মনে বললেন, 'এই লোকটি শুধু উচ্চমানের কবিই হননি, সেই সাথে একজন উচ্চ পর্যায়ের গণৎকারও হয়ে গিয়েছেন। তা না হলে তিনি আমার মনের কথা জানলেন কেমন করে?' তাঁর মনে এ কথা উদিত হবার সাথে সাথে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর হাবীবের মুখ থেকে সূরা হাক্কার আয়াত উচ্চারিত করালেন-

ولا يقُول كَاهِن قَلِيْلاً مَّا تَذَكَّرُونَ

        এটা কোন গণৎকারের কথা নয়, তোমরা খুব কমই চিন্তা-বিবেচনা করে থাকো। (হাক্কাহ্-৪২)

হযরত ওমর বিস্ময়ের দ্বিতীয় ধাক্কা খেলেন। তিনি মনে মনে যা বলছেন, আর তার জবাব রাসুল দিয়ে দিচ্ছেন। বিষয়টি তাঁকে সত্য গ্রহণের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিল। তাঁর মনে পুনরায় প্রশ্ন জাগলো, 'মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যা পাঠ করছেন, তা কোন কবির কথা নয়, কোন গণৎকারের কথাও নয়। তাহলে তিনি এ কালাম কোথা থেকে লাভ করলেন?' তাঁর মনের এ প্রশ্নের উত্তরও রাসূলের মুখ থেকে শোনা গেল-

تَنْزِيلٌ مِنْ رَّبِّ الْعَلَمِينَ

        এটা রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। (সূরা আল-হাক্কাহ্-৪৩)

         ঐতিহাসিক বালাযুরী হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, যে সময়ে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নবুয়্যত লাভ করেন সে সময়ে গোটা কুরাইশদের মধ্যে মাত্র সতেরজন লোক লেখা পড়া জানতেন। তাঁদের মধ্যে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ছিলেন একজন। তদানীন্তন যুগের ইতিহাস থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ বীর এবং বিখ্যাত কুস্তিগীর, পাহলোয়ান। উকাযের মেলায় তিনি কুস্তি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। সমকালীন বিখ্যাত কবিদের সমস্ত কবিতা ছিল তাঁর মুখস্থ, এ থেকে ধারণা করা যায় তিনি কতটা ব্যাপক কাব্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আরবী কাব্য সমালোচনার বিজ্ঞান, ভিত্তিক পদ্ধতির আবিষ্কারক ছিলেন তিনি। বংশ তালিকা বিদ্যায় তিনি ছিলেন পারদর্শী।

        ঐতিহাসিকগণ বলেন, তাঁর জ্ঞান বিবেক বুদ্ধির সুনাম চারদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কোন গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তাঁকেই দূত হিসাবে প্রেরণ করা হত। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী এবং সে কারণে তাকে বিদেশ ভ্রমণ করতে হত। ফলে বিদেশের নেতৃবৃন্দ এবং শাসক ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে মেলামেশার কারণে তাঁর জ্ঞান বিবেক বুদ্ধি বিশেষ এক স্তরে উন্নীত হয়েছিল।

        নেতৃত্বের যাবতীয় গুণাবলী ছিল তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। সেই মূর্খতার যুগেও তিনি ছিলেন নেতা। আবার ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তিনিই ছিলেন নেতা। ইসলামী আন্দোলনের জন্য তাঁর মত ব্যক্তিত্বের একান্ত প্রয়োজন ছিল। এ কারণেই বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর মত ব্যক্তিত্বের জন্য দোয়া করেছিলেন, 'হে আল্লাহ! ওমর ইবনে খাত্তাব 'অথবা আমর ইবনে হিশামকে ইসলামে দাখিল করে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী করো।'

        তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা ছিল বড়ই অপূর্ব। তিনি ছিলেন আদী গোত্রের লোক, তাঁর এই গোত্রে তাওহীদের আলো নতুন কিছু ছিল না। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের আগমনের পূর্বেই তাওহীদবাদী ছিলেন হযরত যায়েদ, আর বিশ্বনবীর হাতে হাত দিয়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন ঐ যায়েদেরই সৌভাগ্যবান সন্তান হযরত সাঈদ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এবং তাঁর স্ত্রী হযরত ফাতিমা বিনতে খাত্তাব। হযরত সাঈদ একদিকে ছিলেন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর চাচাত ভাই এবং আরেকদিকে ছিলেন তাঁর আপন বোনের স্বামী। হযরত ওমরের বংশের আরেকজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেছিলেন, তাঁর নাম ছিল হযরত নুয়াইম ইবনে আব্দুল্লাহ। তিনি তখন পর্যন্ত ইসলাম সম্পর্কে তেমন কোন সংবাদ রাখতেন না। কেননা, ইসলামী কার্যক্রমের গোপনীয়তার কারণে অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে জানতেন না। তাছাড়া যারা শুনেছিল, তারা হয়তঃ ভেবেছিল মুহাম্মাদের এই নতুন আদর্শ সমাজে তেমন প্রভাব বিস্তার করবে না। দু'চারজন লোকের কাছেই সে আদর্শ সীমাবদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ নেতৃস্থানীয় কেউ যদি তা শুনেই থাকে ব্যাপারটাকে তাঁরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু হযরত ওমর যে সময় ইসলামের কথা শুনলেন তখন তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়লেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজন যারা ইসলাম কবুল করেছিল, তিনি তাদের প্রাণের শত্রু হয়ে পড়লেন।

        তিনি যখন শুনলেন তাঁর এক দাসীও ইসলাম কবুল করেছে, তখন তিনি সেই দাসীর ওপরে চরম নির্যাতন করলেন। দাসীকে যখন তিনি ইসলাম ত্যাগ করাতে সক্ষম হলেন না, তখন তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, ইসলাম যার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তাকেই তিনি এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিবেন। তারপর শানিত তরবারী কাঁধে ঝুলিয়ে তিনি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে বের হলেন। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, পথে তাঁর সাথে কথা হয়েছিল বনী যুহরার এক নব্য মুসলমানের সাথে, আবার কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল হযরত নুয়াইম ইবনে আব্দুল্লাহর সাথে। ধারণা করা হয় সে পথিক ছিল নও মুসলিম। সে ব্যক্তি হযরত ওমরকে জিজ্ঞাসা করলো, 'হে ওমর! তুমি এমন ক্রোধের সাথে কাঁধে তরবারী ঝুলিয়ে কোথায় যাচ্ছো?'

        লোকটির প্রশ্নের জবাবে হযরত ওমর ক্রোধ কম্পিত কন্ঠে বললেন, 'মুহাম্মাদের সাথে একটা শেষ বোঝাপড়া করতে।' লোকটি তাঁকে সাবধান করে দেয়ার জন্য বললো, 'মুহাম্মাদের কোন ক্ষতি করলে তাঁর গোত্রের লোকজনের হাত থেকে তুমি নিস্তার পাবে কি করে?' লোকটির একথায় হযরত ওমর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, 'তুমি বোধহয় মুহাম্মাদের আদর্শ গ্রহণ করেছো?'

        লোকটি হযরত ওমরের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য দ্রুত কণ্ঠে বললো, 'একটা সংবাদ শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে, তোমার বোন এবং তাঁর স্বামী ইসলাম কবুল করে মুহাম্মাদের দলে শামিল হয়েছে।' এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত ওমর ক্রোধে ফেটে পড়লেন। হিতাহিত জ্ঞান শুন্যের মত তিনি ছুটলেন তাঁর বোনের বাড়ির দিকে। তাঁর বোন-ভগ্নিপতি ঘরের দরোজা বন্ধ করে সে সময়ে হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর কাছে কোরআনের সূরা ত্বা-হা শিক্ষা গ্রহণ করছিলেন। হযরত ওমর বোনের বদ্ধ দরোজার কাছে যেতেই তাঁর কানে কোরআনের মধুর বাণী প্রবেশ করে তাঁর অন্তরের পূঞ্জিভূত বরফ গলানো শুরু করে দিয়েছিল। তিনি গর্জন করে বোনের দরোজায় আঘাত করলেন। হযরত ওমর এসেছেন এ কথা জানার পরে হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আত্মগোপন করলেন। দরোজা খুলে দেয়ার পরে হযরত ওমর ঘরে প্রবেশ করে তাদের কাছে ধমকের স্বরে জানতে চাইলেন, 'তোমরা কি পড়ছিলে? আমি তাঁর শব্দ শুনেছি।' তাঁরা জবাব দিলেন, 'আমরা পরস্পরের মধ্যে কথা বলছিলাম।'

        হযরত ওমর বললেন, 'তোমরা আমাদের আদর্শ ত্যাগ করে মুহাম্মাদের আদর্শ গ্রহণ করেছো।' হযরত ওমরের ভগ্নিপতি বললেন, আমাদের আদর্শের তুলনায় অন্য আদর্শ যদি উত্তম হয় তাহলে তুমি কি করবে ওমর? তাঁর মুখের কথা শেষ না হতেই হযরত ওমর ভগ্নিপতির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে অমানবিকভাবে প্রহার করতে লাগলেন। স্বামীকে বাঁচাতে এসে তাঁর বোনও ভাইয়ের হাতে রক্তাক্ত হলেন। বোনের শরীরে রক্ত দেখে হযরত ওমর যেন চমকে উঠলেন। ইতিপূর্বেই তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, শত নির্যাতনের মুখেও তাঁর দাসী এই ধর্ম ত্যাগ করেনি। তাঁর বোন এবং ভগ্নিপতির অবস্থাও তেমনি। অহলে কি আছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের আদর্শের ভেতরে? প্রশ্নটা তাঁর ভেতরের পৃথিবীটা সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দিল। তিনি কেমন যেন বিহবল হয়ে পড়লেন। অনুশোচনার কণ্ঠে তিনি তাঁর বোন ভগ্নিপতিকে বললেন, 'তোমরা কি পড়ছিলে আমাকে দেখাও!' 

        হযরত ওমরের কন্ঠের পরিবর্তন শুনেই তাঁরা অনুভব করলেন, ওমরের ভেতরে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে। তাঁরা জানালেন, 'আমরা যা পড়ছিলাম তা মহান আল্লাহর বাণী, অপবিত্র অবস্থায় তা স্পর্শ করা যায় না।' সুবোধ বালকের মতই হযরত ওমর পবিত্র হয়ে এসে আল্লাহর কোরআন পড়তে লাগলেন। মূহূর্তে তাঁর হৃদয়ের সমস্ত অন্ধকার দূরীভূত হয়ে সেখানে তাওহীদের জান্নাতি শিখা দেদীপ্যমান হয়ে উঠলো। কিছুটা পড়েই তিনি করুণ কন্ঠে আবেদন জানালেন, 'কোথায় আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চলো।'

        হযরত ওমরের এই কথা শুনে হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু গোপন স্থান থেকে বের হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আনন্দিত কণ্ঠে বললেন, 'হে ওমর! আনন্দের সংবাদ গ্রহণ করো, তোমার জন্য আল্লাহর রাসূল দোয়া করেছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের দোয়া কবুল করেছেন। তিনি এখন সাফা পাহাড়ের ওপরে আরকামের বাড়িতে অবস্থান করছেন।'

        হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু-তখন ভিন্ন এক জগতের মানুষ। তিনি আল্লাহর রাসূলকে এই পৃথিবীতে ইসলাম প্রচার হতে বিরত করতে এসেছিলেন। এসেছিলেন তওহীদের জ্যোতিকে নির্বাপিত করতে, এখন স্বয়ং তিনিই সে জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। দারে আরকামের দিকে। তিনি চলেছেন। আগের মতই তাঁর কাঁধে তরবারী ঝুলানো রয়েছে, তবে সে তরবারী এখন ব্যবহার হবে খোদাদ্রোহী বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের আদর্শের পক্ষে। হযরত হামজা ও হযরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম সে সময়ে দারে আরকামের দরোজায় কিছু সংখ্যক মুসলমানসহ প্রহরা দিচ্ছিলেন। হযরত ওমরকে কাঁধে তরবারী ঝুলিয়ে আসতে দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, 'তাকে আসতে দাও, আল্লাহ যদি ওমরের কল্যাণ করেন তাহলে সে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করবে, আর যদি সে অন্য উদ্দেশ্যে আসে তাহলে তাঁর তরবারী দিয়েই তাকে হত্যা করা হবে।'

        বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সে সময়ে আরকামের বাড়ির ভেতরে অবস্থান। করছিলেন। তাঁকে হযরত ওমরের আগমনের কথা জানালে তিনি প্রশান্ত চিত্তে বলেছিলেন, 'তাকে আসতে দাও।' এরপর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এসে পৌঁছলে আল্লাহর রাসূল বাইরে এসে তাঁর তরবারীর গোড়ার দিক এবং পরনের কাপড় নিজের হাতে ধরে মমতাভরা কন্ঠে বললেন, 'হে ওমর! তুমি কি বিরত হবে না? হে আল্লাহ! ওমর আমার সামনে, হে আল্লাহ ওমরের মাধ্যমে তুমি তোমার ইসলামকে শক্তিশালী করো।' হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আল্লাহর নবীর হাতে হাত রেখে ঘোষনা দিলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনার জন্য আপনার কাছে এসেছি।'

        হযরত ওমরের কন্ঠে এমন ব্যাকুল আবেদন শুনে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ বলেন, 'বিশ্বনবী সে মুহূর্তে উচ্চ কণ্ঠে আল্লাহ আকবার বলে তাকবির দিয়েছিলেন। বর্তমান কালের গবেষকগণ যাকে বিজয়ের শ্লোগান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। উপস্থিত সাহাবাগণও সেদিন নীরব ছিলেন না, তাঁরাও আল্লাহর নবীর কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তাওহীদের বিজয় ঘোষনা করেছিলেন। নবী ও সাহাবাদের সম্মিলিত শ্লোগানে সেদিন পৃথিবীর সমস্ত বাতিল শক্তির ভিত্তি ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়েছিল, যা শুধু ধ্বসে পড়ার অপেক্ষায় ছিল। ইসলামের বিপ্লবী কাফেলায় শামিল হয়েই আল্লাহর সৈনিক ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু ঘোষনা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আর লুকোচুরি নয়, আল্লাহ বিরোধী মিথ্যে শক্তি প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাবে, আল্লাহর ঘরে তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করবে আর আমরা যারা মহান আল্লাহর দাসত্ব করি তারা কা'বায় নামাজ আদায় করতে পারবো না,

        গোপনে নামাজ আদায় করবো তা হতে পারে না। চলুন আমারা প্রকাশ্যে কা'বায় মহান আল্লাহকে সেজদা করবো।' হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুসহ এমন অসংখ্য মানুষের এ ধরনের পরিবর্তন শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছিল পবিত্র কোরআনের প্রভাবের কারণে।

Post a Comment

0 Comments