কোরআন শয়তান কর্তৃক অবতীর্ণ হতে পারে না

 

        পবিত্র কোরআন যে যুগে অবতীর্ণ হচ্ছিলো, সে যুগে মানুষের মধ্যে একটি বিরাট গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, যারা ছিল অশুভ শক্তির সাধক। এদের ভেতরে ছিল যাদুকর, গণৎকার, ভবিষ্যৎবক্তা ইত্যাদি। এরা ছিল শয়তানের পূজারী। মহান আল্লাহ সূরা নাসের শেষ আয়াতে তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে শয়তান শুধু ইবলিসই নয়, মানুষের দেহসত্তার মধ্যে শয়তানি শক্তি নিহিত রয়েছে। আবার মানুষের ভেতরেও শয়তান রয়েছে এবং জ্বিনদের মধ্যেও শয়তান রয়েছে।

        এই শয়তান জ্বিনদেরকে নিজেদের প্রভু বানিয়ে এক শ্রেণীর লোক মানব সমাজে একটা উদ্ভট কিছু প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদেরকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। সাধারণ মানুষ যখন কোন ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়তো, তখন তারা এসব গণৎকার আর জ্বিনের পূজারীদের কাছে গিয়ে সমস্যা মুক্ত হবার লক্ষ্যে ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ জানার আগ্রহ ব্যক্ত করতো। এসব অশুভ শক্তির সাধক শয়তানের সহযোগিতায় এমন ধরনের আকর্ষণীয় কথা শুনায় যে, হতাশাগ্রস্ত মানুষ তাদেরকেই শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গণ্য করে। এসব সাধকগণ অজ্ঞ মানুষদের কাছে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল। 

        সে যুগে এ ধরনের শয়তানি শক্তির পুজারীদের সমাজে প্রভাব ছিল ব্যাপক। কোরআনের প্রতি অবিশ্বাসী লোকজন তখন ধারণা করেছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোধহয় নিজেকে সমাজে একজন বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে প্রচার করছেন যে, তাঁর কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কালাম অবতীর্ণ হচ্ছে; আসলে তাঁর সাথে জ্বিনদের যোগাযোগ হয়েছে ও শয়তানের যোগসূত্র স্থাপন হয়েছে; আর তাদের কাছ থেকে তিনি যা শুনছেন-তাই আল্লাহর বাণী বলে দাবী করছেন। তাদের এ ধারণা ও কথার প্রতিবাদ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্পষ্ট ঘোষণা করলেন-

وَمَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّيطِينُ - وَمَا يَنْبَغِى لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيعُونَ إِنَّهُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُولُونَ

        এ (সুস্পষ্ট কিতাবটি) নিয়ে শয়তানরা অবতীর্ণ হয়নি। (কিতাব অবতীর্ণের) এ কাজটি তাদের শোভাও পায় না এবং তারা এমনটি করতেও সক্ষম নয়। তাদেরকে (শয়তানদেরকে) তো এ (কিতাব) শোনা থেকেও দূরে রাখা হয়েছে। (সুরা আশ্ শু'আরা-২১০-২১২)

         কে এই কোরআন বিশ্বনবীর কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করেছেন, সে কথাও মানুষকে স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা সূরা আশ্ শু'আরায় জানিয়ে দিয়েছেন-

وَإِنَّهُ لَتَنْزِيلُ رَبِّ الْعَلَمِينَ نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ

        এটি রাব্বুল আলামীনের নাযিল করা জিনিস। একে নিয়ে আমানতদার রুহ অবতরণ করেছে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দাওয়াতী কার্যক্রম ও আন্দোলন পরিচালিত করছিলেন, তখন মক্কার কুরাইশদের ভেতরে ইসলাম বিরোধী শক্তি এ আন্দোলনের বিস্তৃতি রোধ করার লক্ষ্যে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একজন জ্বিন প্রভাবিত ব্যক্তি হিসেবে সর্বত্র প্রচার ও প্রসার করে যাচ্ছিলো। এই ভোঁতা অস্ত্র ব্যতীত তাদের কাছে ইসলামকে প্রতিহত করার দ্বিতীয় কোন কার্যকরী অস্ত্র মওজুদও ছিল না। এ জন্য তারা প্রথমে আল্লাহর রাসুলকে সাধারণ মানুষের কাছে অগ্রহণীয় করে তোলার জন্য অপপ্রচারের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর পশ্চাতে যে কারণসমূহ বিদ্যমান ছিল, তার ভেতরে কা'বা ঘরের নেতৃত্বের আসন হারানোর ভয় ছিল অন্যতম। কেননা, সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পবিত্র কা'বাঘরের সম্মান ও মর্যাদা ছিল পৃথিবীব্যাপী।

        সুতরাং যারা কা'বাঘরের তত্ত্বাবধায়ক ছিল, কা'বাঘরের কারণেই অন্যান্য মানুষের কাছে তাদের সম্মান ও মর্যাদা ছিল অনেক বেশী। কা'বার খাদেমদেরকে কেউ বলতো আল্লাহর প্রতিবেশী, কেউ বলতো আল্লাহর পরিবার, কেউ বলতো খোদার বংশধর। অর্থাৎ তারা ছিল পুরোহিত শ্রেণী। এ কারণে তারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মধ্যে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করতো। অন্যান্য মানুষদেরকে তারা হীনতার দৃষ্টিতে দেখতো। ধর্মকর্মের বিভিন্ন দিক তারা কাটছাট করে নিজেদের জন্য অনেক বিধান পরিবর্তন করে সহজ করে নিয়েছিল। কা'বার খাদেম হবার কারণে সমস্ত দিক দিয়ে তারা নানা ধরণের সুবিধা ভোগ করতো। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমাজের অন্য মানুষকে যে সব সমস্যার মোকাবেলা করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হত, কুরাইশরা ছিল এর ব্যতিক্রম। কা'বাঘরকে কেন্দ্র করে তাঁরা নানাবিধ সুযোগ আদায় করতো। কা'বার সেবক ও পুরোহিত হবার কারণে গোটা সমাজে তাদের নেতৃত্ব ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত।

        কুরাইশদের লোকজনই কা'বা এবং সমাজের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিল। অর্থ সংক্রান্ত দায়িত্ব ছিল হারেস ইবনে কায়েসের ওপর। পরামর্শ দানের দায়িত্ব ছিল ইয়াজিদ ইবনে রাবিয়া আসাদীর ওপর। কেউ নিহত হলে তাঁর রক্তপণের মীমাংসা করার দায়িত্ব ছিল হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর ওপর। পতাকা বহন করার দায়িত্ব ছিল আবু সুফিয়ানের ওপর। মানুষের ভাগ্য গুনে দেখার দায়িত্ব ছিল মাকওয়ান ইবনে উমাইয়ার ওপর। মক্কার গরীবদের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল হারেছ ইবনে আমেরের ওপর। কা'বার চাবির এবং মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব ছিল উসমান ইবনে তালহার ওপর। হাজীদেরকে পানি পান করানোর দায়িত্ব ছিল হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর ওপরে। কারো সাথে কোন বিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসা করার দায়িত্ব ছিল হযরত ওমরের ওপর। তাঁবু এবং যান-বাহনের দায়িত্ব ছিল ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার ওপর।

            ওতবা ইবনে রাবিয়া, আবু সুফিয়ান ইবনে হরব, আস ইবনে ওয়ায়েল সাহমী, আবু লাহাব, আবু জেহেল, আসওয়াদ ইবনে মুতালিব, ওতবা ইবনে আবু মুয়িত, উবাই ইবনে খালফ, নজর ইবনে হারেস, আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুস ও আখনাস ইবনে শুরাইক সাকাফী-এ সমস্ত লোকগুলোর প্রভাব ছিল গোটা মক্কায় সর্বাধিক। এদের নেতৃত্বও ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই সমস্ত লোকগুলোর সবাই কোন না কোন দিক দিয়ে আল্লাহ রাসূলের সাথে আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা ছিল। কেউ কেউ ছিলেন রাসূলের আপন চাচা। সে সময়ে কুরাইশরাও জানতো একজন নবীর আগমন ঘটবে। তাদের ধারণা ছিল কুরাইশ গোত্রের কোন নেতাকেই নবী হিসাবে নির্বাচিত করা হবে। তদানীন্তন সমাজে যে ব্যক্তির প্রচুর অর্থ সম্পদ এবং সেই সাথে সবচেয়ে বেশী পুত্র সন্তান থাকতো, তাকেই শাসক হিসাবে বরণ করে নেয়া হত।

        এটা ছিল সে সমাজের প্রথা এবং অধিক সন্তান থাকা ছিল সমাজে গর্ব ও মর্যাদার বিষয়। নানা ধরণের কুসংস্কারের মধ্যে এটাও প্রচলিত ছিল যে, যার পুত্র সন্তান যত বেশী সে ব্যক্তি মৃত্যুর পরের জগতে ততবেশী মর্যাদা লাভ করবে। আর যার পুত্র সন্তান থাকবে না বা পুত্র সন্তানের সংখ্যা অল্প থাকবে, পরকালে তার কোন সম্মান নেই। পক্ষান্তরে আল্লাহর নবীর কোন পুত্র সন্তান জীবিত ছিল না বা তাঁর তেমন ধন ঐশ্বর্য ছিল না। সুতরাং, তাঁর মত মানুষ কী করে নবী হতে পারে বিষয়টি ছিল তাদের কাছে বোধের অগম্য ও অবিশ্বাসের বিষয়। তাদের কল্পনায় যে ধরনের লোক নবী হবার উপযুক্ত, সে ধরনের লোকের অভাব তাদের ভেতরে ছিল না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্র ছিল তাদের কল্পনা ও চিন্তা-চেতনার বিপরীত।

        সুতরাং, আল্লাহর রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ না করে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিস্তৃতি ঘটানোর এটাও একটা কারন। সে সময় পর্যন্ত মুসলমানগণ নামাজ আদায় করতো বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে। এ কারণে কুরাইশরা ধারণা করতো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম খৃষ্টানদের মত বাইতুল মুকাদ্দাসকে যখন নিজের আদর্শের কেবলা হিসাবে মনোনীত করেছে, তখন নিশ্চয়ই সে খৃষ্টানদের মতবাদ মক্কায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায়-এই ধরনের ভ্রান্তিতেও তারা নিমজ্জিত ছিল।

        কুরাইশদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপগোত্র'ছিল। তাদের মধ্যে দুটো গোত্র ছিল এমন যে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। একে অপরকে মূহূর্তের জন্য সহ্য করতে রাজী ছিল না। তাঁর মধ্যে একটা গোত্র ছিল বনী হাশেম অপরটি ছিল বনী উমাইয়া। আব্দুল মুত্তালিব তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বনী হাশেমকে সম্মান ও মর্যাদার অতি উচ্চ স্থানে আসীন করেছিলেন। তাঁর ভেতরে যেমন ছিল নেতৃত্বের গুনাবলী তেমন ছিল তাঁর অর্থ বিত্ত। ফলে সমাজে বনী হাশেমের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিল না। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সন্তানদের মধ্যে কেউ নেতৃত্বের সে আসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। আব্দুল মুত্তালিবের মত নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন তাঁর কোন সন্তানই ছিল না। তাঁর এক সন্তান আবু তালিব যিনি ছিলেন দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত। আরেক সন্তান আব্বাস যদিও সম্পদশালী ছিলেন কিন্তু পিতার ন্যায় তিনি দানবীর ছিলেন না, পিতার মত ব্যক্তিত্বও তাঁর ছিল না। আরেক সন্তান আবু লাহাব ছিল সমাজে চরিত্রহীন নামে পরিচিত। সুতরাং, পিতার মত কোন সন্তানই নেতৃত্বের আসন ধরে রাখতে পারেনি।

        ফলে বনী উমাইয়া গোষ্ঠী আব্দুল মুত্তালিব জীবিত থাকতেই অন্তরে যে আশা পোষণ করতো, তাঁর অবর্তমানে তাদের সে দীর্ঘকালের আশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা সামনে এগিয়ে এলো। সমস্ত দিক থেকে বনী হাশেমকে কোণঠাসা করে নেতৃত্বের পদ দখল করলো। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বনী হাশেমের সন্তান। সুতরাং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসাবে স্বীকৃতি দিলে বনী হাশেমের নেতৃত্ব মেনে চলতে হবে, এ কারণে তারা তাঁর আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি করেছে, অপপ্রচার করেছে। আর ইতিহাসে দেখা যায় এই বনী উমাইয়াগণই ইসলামের ইতিহাসে কলঙ্কজনক ঘটনার জন্মদান করেছে সবচেয়ে বেশী। এই উমাইয়া গোত্রের নেতা আবু সুফিয়ান ইসলামের বিরুদ্ধে একমাত্র বদর যুদ্ধ ব্যতীত সমস্ত যুদ্ধে নেতৃত্বদান করেছে। তাঁর স্ত্রী হিন্দা হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর কলিজা বের করে চিবিয়ে ছিল। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার জন্মদাতাও এই বনী উমাইয়াগণ। তিনজন খলীফার হত্যাকান্ড এবং ইসলামী শাসন অবসানে বনী উমাইয়াদেরই ষড়যন্ত্র অধিক কার্যকর ছিল।

        আবু জেহেলের গোত্র ছিল বনী মাখজুম গোত্র। এই গোত্রের গোত্রপতি ছিল ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা। এরাও বনী হাশেম গোত্রের শত্রু ছিল। সুতরাং, হাশেম গোত্র থেকে কেউ নবীর দাবী করলে তারা তা গ্রহণ করবে না, এমন ঘোষনা স্বয়ং আবু জেহেল দিয়েছিল। বনী উমাইয়া গোত্রের ওতবা ইবনে আবু মুয়িত ছিল আল্লাহর নবীর প্রাণের শত্রু। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাজ আদায় করছিলেন আর ওতবা নবীর পবিত্র শরীর মোবারকের ওপর উটের পচা নাড়ি ভূড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল। সমস্ত কুরাইশদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি ছিলেন সৎ এবং ভদ্র। তাঁরা কোন ধরনের দাঙ্গা পছন্দ করতেন না। যে কোন সমস্যাকেই তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে আগ্রহী ছিলেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কেন্দ্র করে তারা যে সমস্যা সৃষ্টি করেছিল, এ সমস্যাকে অন্যরা যেমন শক্তি প্রয়োগ করে সমাধান করতে আগ্রহী ছিল, ভদ্র ব্যক্তিগণ তাতে বাধাদান করতেন।

        কুরাইশ দাঙ্গাবাজ নেতৃত্বের মধ্যে চরিত্র বলতে কিছু ছিল না। স্বয়ং আবু লাহাব ছিল চোর, কা'বাঘরের স্বর্ণের পাত্র সে চুরি করেছিল। কেউ ছিল মিথ্যাবাদী, কেউ ছিল কুমন্ত্রণাদানকারী। নৈতিক দিক দিয়ে তারা সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। আল্লাহর রাসূল একদিকে শিরক্ তথা অংশীদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কঠোর সমালোচনা করতেন অপর দিকে চারিত্রিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে বলতেন। ফলে নেতাদের প্রকৃত চরিত্র সাধারণ মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়ে যেত। নেতাদের নেতৃত্ব সাধারণ মানুষ গ্রহণ করবে না, এ কারণে তারা বিশ্বনবীর বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে লেগেছিল। সে সমাজে যারা ছিল নেতা, নেতৃত্বের আসনে বসে যারা প্রভূত অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছিল ও সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার মাধ্যমে যারা গোটা জাতিকে শোষণ করছিল, নেতৃত্বের আসনে বসে যারা নিজেদেরকে সব ধরনের আইন-কানুনের উর্ধ্বে মনে করতো, তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন জ্বালাময়ী ভাষণ পেশ করতো ও ক্ষেত্র বিশেষে তাদের নাম ঠিকানা আকারে ইঙ্গিতে সাধারণ মানুষের সামনে স্পষ্ট করে দিচ্ছিল। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কঠোর বক্তব্য রাখতেন, ফলে স্বার্থান্বেষী নেতাগণ রাসূলের কার্যক্রমের মধ্যে নিজেদের মৃত্যু দেখে ছুটে গেল আবু তালিবের কাছে।

        চাচা আবু তালিব সে সব নেতাদেরকে নানা ধরনের কথা বলে কোন রকমে শান্ত করে বিদায় করেছিলেন। আল্লাহর রাসূল তাঁর আন্দোলনকে আরো গতিদান করলেন। এবারে আস ইবনে ওয়াইল, আবু সুফিয়ান, ওলীদ ইবনে মুগীরা, ওতবা ইবনে রাবিয়া, আবু জেহেল, আস ইবনে হিশাম প্রমুখ কাফের নেতৃবৃন্দ আবু তালিবের কাছে এলো। তারা হুমকির ভাষায় তাঁকে জানালো, 'তোমার আশ্রয় প্রশ্রয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের উপাস্য দেবতাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করে, আমাদেরকে বলে আমরা নাকি জ্ঞানহীন মূর্খ। সে আমাদেরকে ভুল পথের পথিক বলে এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিল পথভ্রষ্ট এ কথাও বলে। তুমি তাকে বিরত করতে পারোনি। এখন তুমি তাঁর পেছন থেকে সরে যাও আর না হয় তুমিও তাঁর পক্ষাবলম্বন করে আমাদের সাথে লড়াইতে চলে এসো।'

        আবু তালিব পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। তিনি অনুভব করলেন বিশ্বনবীর জন্য ময়দান কতটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। যে কোন মুহুর্তে পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সমস্ত দিক চিন্তা করে তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ডেকে বললেন, 'বাবা! এমন কোন ভারী বোঝা আমার কাঁধে আরোপ করো না, যা আমি বহন করতে পারবো না।'

        ময়দানের প্রকৃত অবস্থা রাসূলের অজানা ছিল না। চাচার কথার যে কি তাৎপর্য তাও তিনি অনুভব করলেন। তাঁর কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, পরিস্থিতি চাচা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। পরম শ্রদ্ধাভরে তিনি তাঁর চাচাকে জানালেন, 'মহান আল্লাহর কসম করে আপনাকে জানাচ্ছি চাচাজান! যারা আমার বিরুদ্ধে আপনার কাছে অভিযোগ করছে, তারা যদি আমার এক হাতে আকাশের চন্দ্র আর আরেক হাতে আকাশের সূর্য ধরিয়ে দেয় তবুও আমি যে দায়িত্ব পালন করার লক্ষ্যে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি তা থেকে বিরত হবো না। মহান আল্লাহ এ কাজের পূর্ণতা দান করবেন আর না হয় আমি এ পথে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দেব।'

        এই কথাগুলো বলার সময় আল্লাহর নবীর পবিত্র চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। তিনি চাচার কাছ থেকে উঠে চলে যেতে লাগলেন। কিছু দূর অগ্রসর হবার পরে আবু তালিব তাঁকে পুনরায় ডাক দিলেন। প্রাণপ্রিয় ভাতিজার কথাগুলো চাচা আবু তালিবের মর্মে স্পর্শ করেছিল। তিনি প্রিয় ভাতিজার দিকে মমতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, 'বাবা! তুমি তোমার দায়িত্ব পলন করতে থাকো। এমন কোন শক্তি নেই যে তোমার ওপরে আঘাত করবে। তোমাকে আমি কারো হাতেই তুলে দেব না।'

        আবু তালিব তাঁর ভাতিজাকে সহযোগিতা করা হতে বিরত হবেন না, এ কথা শুনে তারা এক অদ্ভূত পদ্ধতি আবিষ্কার করে পুনরায় আবু তালিবের কাছে গেল। তাদের সাথে ছিল উমারাহ ইবনে ওয়ালিদ নামক এক সুদর্শন যুবক। তারা আবু তালিবের কাছে ঐ ছেলেটিকে দেখিয়ে প্রস্তাব দিল, 'এই ছেলেটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি সাহসী। আপনি একে গ্রহণ করে মুহাম্মাদকে আমাদের হাতে তুলে দিন, তাকে আমরা হত্যা করি। একজনের বিনিময়ে আপনি আরেকজনকে লাভ করছেন।' আবু তালিব ক্রোধ কম্পিত কণ্ঠে তাদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, 'খোদার শপথ! তোমরা একটা নোংরা প্রস্তাব আমার কাছে পেশ করছো। আমি কখনো শেমাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি না। তোমরা তোমাদের সন্তানকে আমার কাছে দেবে আমি তাকে ভরণপোষণ করতে থাকবো, আর আমার সন্তানকে আমি তোমাদের হাতে তুলে দেব তোমরা তাকে হত্যা করবে। খোদার শপথ! তোমরা মনে রেখো, কোনদিন তা সম্ভব নয়।' তাঁর স্পষ্ট কথা শুনে কাফের নেতা মুতয়িম ইবনে আদী পুনরায় বললো, 'আবু তালিব! আপনার গোষ্ঠীর লোকজন আপনার কাছে যথাযথ প্রস্তাব দান করেছে। যে বিষয়ে আপনি নিজেও চরম অসুবিধার মধ্যে আছেন, এরা আপনাকে সেই অসুবিধা থেকেই মুক্তি দিতে এসেছে অথচ আপনি তা গ্রহণ করছেন না।' আবু তালিব জবাব দিলেন, 'খোদার শপথ! তোমরা আমার সাথে ন্যায় বিচার করোনি। তোমরা এসেছো আমাকে অপমান করতে। এ কারণে সমস্ত মানুষকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিয়েছো। তোমরা যাও, তোমাদের যা ইচ্ছা তা করতে পারো।'

        বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথায় অটল থাকলেন। তাঁর শত্রু পক্ষ অনেক চিন্তা ভাবনা করে তাঁকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকলো। কেননা, গৃহযুদ্ধে তাদের সমস্ত শক্তি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তারপর মুহাম্মাদকে হত্যা করলে গোত্রে গোত্রে যে পুনরায় যুদ্ধ সৃষ্টি হবে এবং তার পরিণাম যে সমূলে ধ্বংস, এসব দিক তারা ভেবেছিল। সুতরাং, তারা নির্যাতনের পথ গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত মনে করলো। আল্লাহর রাসূলের নামাজ আদায়ের সময় গলিত আবর্জনা তাঁর পবিত্র শরীরে নিক্ষেপ করা, তাকে দেখে হৈ চৈ করা, বিদ্রূপ করা, তাঁর চলার পথে কাঁটা, আবর্জনা বিছিয়ে রাখা, তিনি নামাজে দাঁড়ালে তাঁর গলায় কাপড় জড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা, ইত্যাদি অত্যাচার শুরু করলো। যে সব গোত্রের দু'চার জন মুসলমান হয়েছিল তাদের ওপরে নির্যাতন আরম্ভ করলো।

        কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, অবস্থা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন আবু তালিব বনী হাশিম ও বনী মুত্তালিব গোত্রে গমন করে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ওপরে কোন অত্যাচার হতে দেয়া যাবে না এবং তা প্রতিরোধ করা হবে ও তাঁকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা হবে। বনী হাশিম এবং বনী মুত্তালিব গোত্র আবু তালিবের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানালো। কিন্তু অভিশপ্ত আবু লাহাব সমর্থন দিলনা। সে এবং তাঁর স্ত্রী আল্লাহর রাসূলের সাথে বিরোধিতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলো।

        রাসূল এবং তাঁর অনুসারীদের ওপর এত নির্যাতন সত্বেও তাঁকে এ পথ থেকে বিরত করা গেল না, এ সম্পর্কে কাফের নেতাদের মনে ধারণা হলো নিশ্চয়ই মুহাম্মদ একটা কিছু অর্জন করতে চায়, এ কারণে সে এবং তাঁর অনুসারীরা এত নির্যাতন সহ্য করেও তাদের কার্যক্রমে বিরতি দিচ্ছে না এবং আদর্শ ত্যাগ করছে না। এই অমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে কাফের নেতা ওতবা ইবনে রাবিয়া নবীর কাছে এসে প্রশ্ন করলো, 'হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম! বলো তো, প্রকৃত পক্ষে তোমার মনের ইচ্ছাটা কি? যদি মক্কার নেতৃত্ব কামনা করো তাহলে তা গ্রহণ করতো পারো। যদি আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়ে কামনা করো তাহলে আমরা ব্যবস্থা করে দেব। গোটা মক্কার ধন রত্ন চাও আমরা তোমার সামনে এনে দিচ্ছি। তবুও তুমি যা বলছো তা থেকে বিরত হও।'

        বিশ্বমানবতার মহান মুক্তির দূত নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা না বলে পবিত্র কোরআনের একটা আয়াত কাফের নেতাকে শুনিয়ে দিলেন। বিশ্বনবীর মুখে পবিত্র কোরআন শুনে কাফের নেতা ওতবা থরথর করে সেদিন কেঁপে উঠেছিল। তাঁর মুখ দিয়ে আর একটি কথাও বের হয়নি। দ্রুত সে বিশ্বনবীর সামনে থেকে সরে পড়েছিল। পবিত্র কোরআন শুনে ওতবা ইবনে রাবিয়ার ভেতরের জগৎ কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল। সে কুরাইশদের অন্যান্য নেতাদের বলেছিল, 'আমি নিজের কানে শুনে এসেছি, মুহাম্মাদ যা পড়েছে তা কোন কবির কবিতা নয়। সে যে কি পড়লো তা আমার বুঝে আসছে না। তোমাদের কাছে আমার পরামর্শ হলো, সে যা করছে তাতে তোমরা তাকে বাধা দিওনা। যদি সে তাঁর কাজে সফল হয়ে গোটা আরবের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বিজয়ী হয় তাহলে তোমাদেরই সম্মান বৃদ্ধি পাবে। আর তা করতে না পারলে সে নিজেই একদিন শেষ হয়ে যাবে।'

        কিন্তু ওতবার পরামর্শ কোন নেতা গ্রহণ না করে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ইতিমধ্যে হজ্জের সময় উপস্থিত হলো। কুরাইশ নেতারা প্রবীণ ব্যক্তি ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার কাছে এলো পরামর্শের জন্য। সে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্য করে বললো, 'হজ্জের সময় এসেছে। চারদিক থেকে লোকজন এখানে আসবে। তাদের কানে এর মধ্যেই মুহাম্মাদের কথা পৌঁছেছে। এখন তোমরা মুহাম্মাদ সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে একমত হও। তাঁর সম্পর্কে সবাইকে একই কথা বলতে হবে। আমাদের পরস্পরের কথা যেন মানুষের কাছে দু'ধরনের হয়ে না যায়। তাহলে মানুষ আমাদের কথা মিথ্যা মনে করবে। আমরা সবাই তাঁর সম্পর্কে একই কথা বলবো।'

        সমবেত লোকজন ওয়ালিদকে জানালো, 'কী কথা মুহাম্মাদ সম্পর্কে বলতে হবে তা আপনিই আমাদেরকে বলে দিন। আপনার শেখানো কথাই আমরা সবার সামনে বলবো।' কিন্তু রাসূলের সম্পর্কে কি কথা যে বলতে হবে দীর্ঘক্ষণের চেষ্টাতেও ওয়ালিদের মাথা থেকে বের হলো না। অবশেষে সে উপস্থিত নেতাদেবকে জানালো, 'তোমরাই পরামর্শ দাও তাঁর সম্পর্কে কী কথা বলা যায়?' কয়েকজন বললো, 'আমরা মানুষদের কাছে মুহাম্মাদ সম্পর্কে জানাবো সে একজন গণক।' ওয়ালিদ এ কথায় একমত না হয়ে বললো, 'মানুষ বহু গণককে দেখেছে, গণকদের কথা থাকে ইশারা ইঙ্গিতে পরিপূর্ণ। মুহাম্মাদের কোন একটি কথাও গণকের মত নয়।' এবার কয়েকজন পরামর্শ দিল, 'তাঁকে পাগল হিসাবে পরিচিত করা হোক।' ওয়ালিদ প্রতিবাদ করে বললো, 'অসম্ভব! তাঁকে পাগল বললে কেউ তা বিশ্বাস করবে না, বরং আমাদেরকেই মানুষ পাগল বলবে। মানুষ বহু পাগল দেখেছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কোন একটি কথাও পাগলের মত নয়। পাগলদের একটা কথার সাথে আরেকটি কথার কো- সামঞ্জস্য থাকে না, কিন্তু তাঁর প্রতিটি কথা একটার সাথে আরেকটার এক অদ্ভূত সামঞ্জস্য রয়েছে।'

        এবার কয়েকজন পরামর্শ দিল, 'তাঁকে কবি হিসাবে পরিচিত করা যায়।' ওয়ালিদ পুনরায় অস্বীকার করে বললো, 'না, তাকে কবি বলা যায় না। এদেশের মানুষ কবিদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী অভিজ্ঞ। নানা ধরনের কবিতার সাথে তারা পরিচিত। মুহাম্মাদের কোন একটি কথাও কোন কবির মত নয়।' এবার অনেকে পরামর্শ দিল, 'তাঁকে যাদুকর হিসাবে সবার কাছে পরিচিত করা হোক।' ওয়ালিদ বললো, 'মানুষ নানা ধরনের যাদুকরের সাথে পরিচিত, যাদুর সাথে পরিচিত। যাদুকরেরা যেমন সুতার গিরায় ফুঁক দেয়, ঝাড়ফুঁক করে, তাবিজ কবজ দেয় মুহাম্মাদ সে ধরনের কোন কাজ করে না।' এবার সবাই বললো, 'তাহলে আপনি যা বলতে চান তাই বলুন।'

        ওয়ালিদ বললো, 'মুহাম্মাদের কথার ভেতরে যে মাধুর্যতা আছে এ সম্পর্কে কারো মনে কোন দ্বিধা নেই। তাঁর কথার ভিত্তি অত্যন্ত দৃঢ় এবং তাঁর মর্মার্থ অতি গভীরে প্রথিত। তোমরা তাঁর সম্পর্কে মানুষকে যা বলবে মানুষ তার কোনটাই বিশ্বাস করবে না। আমার মতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যাদুকর কথাটা বেশী উপযুক্ত। যদিও তিনি যাদুকর নন কিন্তু তাঁর কথার ভেতরে যাদুর থেকেও বেশী প্রভাব রয়েছে। তাঁর কথায় সংসারে বিভেদ সৃষ্টি হয়। স্বামীর কাছে থেকে স্ত্রী পৃথক হয়ে যায়, পিতার কাছে থেকে সন্তান পৃথক হয়ে যায়। সুতরাং, তাঁর কথা যাদুর থেকে অধিক কার্যকরী। তাঁর কথার কারণেই আজ আমাদের গোটা জাতির ভেতরে বিভেদের রেখা সৃষ্টি হয়েছে।'

        মক্কার কাফের নেতৃবৃন্দ এই কথাই সর্বত্র প্রচার করতে থাকে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম একজন যাদুকর। এ ধরণের নানা প্রলাপ উক্তি তারা আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে করেছিল। সে যুগে যদি বর্তমান যুগের মত প্রচার মাধ্যম থাকতো, রেডিও, টেলিভিশন, ডিস এ্যান্টেনা, ইন্টারনেট, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি থাকলে এ সমস্ত প্রচার মাধ্যমে নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে মানুষ কত অর্থহীন, ভিত্তিহীন কথাই না শোনার দুর্ভাগ্য লাভ করতো। কার্টুনিষ্টগণ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কত বিকৃত ছবি এঁকে গোটা দেশ ছেয়ে দিত। কোন ব্যক্তি সম্পর্কে যখন ভিত্তিহীন প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো হয় তখন ঐ ব্যক্তির নগদ লাভ যেটা হয় তাহলো, তার সম্পর্কে যাদের সামান্যতম কৌতূহল ছিল না তারাও কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তার সম্পর্কে যারা কিছুই জানতো না, তারাও তার সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। তার নামটা সর্বস্তরের মানুষের কার্ণকুহরে পৌঁছে যায়, ঘরে ঘরে তার সম্পর্কে আলোচনা হতে থাকে। তাদের এই অপপ্রচারের কারণে ব্যক্তি সম্যক পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বনবীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। মুহাম্মাদ নামটা এতদিন যারা শোনেনি, এবার তারাও নামটা শুনলো। সর্বত্র তাঁর সম্পর্কে একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। অন্ধানুকরণপিয়াসী যারা, তারা হয়তঃ অর্থহীন মন্তব্য করলো। কিন্তু যাদের হৃদয় জীবিত, যুক্তিতে যারা বিশ্বাসী, সত্য উদ্ঘাটনে যারা আগ্রহী তাঁরা নীরবে প্রকৃত সত্য অবগত হবার লক্ষ্যে রাসূলের দরবারে এগিয়ে এলো। প্রকৃত সত্য অবগত হলো এবং যারা সৌভাগ্যবান ছিল তাঁরা মহাসত্য ইসলাম কবুল করে আল্লাহর বান্দায় পরিণত হলো। আর যারা ছিল হতভাগা তাঁরা প্রকৃত সত্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হলো। ইতিহাসে দেখা যায় প্রতিটি যুগেই সমস্ত নবীদের সাথে, ইসলামের বাহকদের সাথে একই আচরণ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার করা হয়েছে। কোন একজন নবীও বিরোধী শক্তির অপপ্রচারের কবল থেকে মুক্ত ছিলেন না। বর্তমানেও যারা ইমলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে তাঁরাও অপবাদ মুক্ত নন। তাদেরকেও বিভিন্ন ধরণের অপপ্রচারের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। মহান আল্লাহ তাঁর নবীর ওপরে কাফের নেতৃবৃন্দ যে সমস্ত অপবাদ দিয়েছিল, সে সবের জবাব অখন্ডনীয় যুক্তির মাধ্যমে দিয়েছেন।

        রাসূলের দাওয়াতকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে যে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছিল সেখানে তাদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছিল, তাহলো রাসূল কোরআনের বাণী হিসেবে যা মানুষকে শোনাচ্ছেন তা মানুষের হৃদয় গভীরে প্রবেশ করছিল, সাধারণ মানুষের কাছে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে তারা সম্পূর্ণ অক্ষম ছিল, আল্লাহর কোরআনের বাণী মানুষের কাছে পৌছানোর পথ বন্ধ করার মতো শক্তি তাদের ছিল না। কোরআনের প্রভাব থেকে মানুষকে কিভাবে দূরে রাখা যায়, এ চিন্তায় তারা গলদঘর্ম হচ্ছিলো। অবশেষে তারা লোক সমাজে রাসূলকে যাদুকর, গণৎকার হিসাবে পরিচিত করার অপপ্রয়াস গ্রহণ করেছিল যেন লোকজন এ ধারণা করে যে, গণৎকারদের মনে যেমন জ্বিন শয়তানরা নানা ধরনের কথার সৃষ্টি করে দেয়, তেমনি মুহাম্মাদের মনেও শয়তান এসব কথার সঞ্চার করে দিচ্ছে আর তিনি তা আল্লাহর বাণী বলে প্রচার করছেন। ইসলাম বিরোধী শক্তির এই অপবাদের জবাবে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন, এ কিতাব শয়তান অবতীর্ণ করতে সক্ষম নয় এবং শয়তানের মুখে কোরআনের বাণী শোভা পায় না।

        কেননা কোরআন যে শিক্ষাদর্শ উপস্থাপন করছে, শয়তানের চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষা তো সম্পূর্ণ এর বিপরীত। সুতরাং, কোরআন উপস্থাপিত শিক্ষা কি করে শয়তান পেশ করতে পারে?. আল্লাহর কালামকে গণৎকারের কথা বলে তোমরা যারা প্রচার করছো, তোমরা যে দেশে, সমাজে বাস করছো, সেখানে যথেষ্ট গণৎকার অবস্থান করছে এবং তোমরা বহু গণৎকারের সঙ্গ লাভ করেছো, তাদের কথা শুনেছো। গণৎকারের বক্তব্য কি ধরনের হতে পারে এ ব্যাপারে তোমরা অভিজ্ঞ। আমার নবীর মুখ থেকে যে কোরআন তোমরা শুনছো, সে কোরআন আর গণৎকারের কথার মধ্যে সামান্যতম কোন সামঞ্জস্য রয়েছে কি? শয়তান কর্তৃক সঞ্চারিত কথার ভিত্তিতে এতকাল যাবৎ গণৎকারগণ তোমাদের মধ্যে যে শিক্ষাদর্শ প্রচার করে এসেছে, কোরআন তার ঠিক বিপরীত শিক্ষাদর্শ প্রচার করে, তাহলে এ কোরআন কি করে শয়তান কর্তৃক সঞ্চারিত কথামালা হতে পারে? তোমরা এবং তোমাদের কোন পূর্ব পুরুষ কি এ কথা কখনো শুনেছে যে, কোন শয়তান গণৎকারের মাধ্যমে মূর্তিপূজা ও সমস্ত ইলাহকে ত্যাগ করে এক আল্লাহর দাসত্ব করার শিক্ষা মানুষের সামনে পেশ করেছে? পৃথিবীতে মানুষ যা করছে, এসব কাজের জবাবদিহি আদালতে আখিরাতে আল্লাহর দরবারে করতে হবে-এ কথা কি শয়তান বলেছে? যাবতীয় অন্যায় ও গর্হিত কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার কথা কি শয়তান কোনদিন বলেছে? ভ্রান্ত ও অসৎ পথ ত্যাগ করার কথা কি শয়তান * বলেছে? শয়তানরা এসব সৎপ্রবৃত্তি লাভ করবে কিভাবে? কেননা শয়তানের মূল স্বভাবই • হলো, মানুষকে অসৎ পথপ্রদর্শন করা, তাদেরকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করা। সুতরাং শয়তান কি করে কোরআনের শিক্ষার ন্যায় অতুলনীয় আদর্শ প্রচার করতে পারে? কোরআনের আদর্শের প্রতি লক্ষ্য করেও কি তোমরা অনুধাবন করো না, এসব কথা শয়তান কর্তৃক অবতীর্ণ হতে পারে না?

        শয়তানের সাধক ও তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী গণৎকারদের কাছে তোমরা তো এসব প্রশ্ন করতে যাও যে, আমার অমুক জিনিসটা হারিয়ে গিয়েছে, তার সন্ধান করে দিন। আমি অমুক একটি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি, তাকে আমার জীবন সাথী করার ব্যবস্থা করে দিন। আমি অমুক দিন অমুক কাজ শুরু করছি, তাতে সফল হবো কিনা বলে দিন। আমি অমুক ব্যাপারে বাজি ধরেছি, তাতে বিজয়ী হবো কিনা বলে দিন। আমার এই ক্ষতি হয়েছে, কে ক্ষতি করেছে তার সন্ধান বলে দিন। গণৎকারগণ তো চিরদিন তোমাদের এসব কাজ সফল করে দিতে পারে বলে তোমাদেরকে ধারণা দিয়ে এসেছে। তারা তো কোনদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দাসত্ব করার বিষয় শিক্ষা দেয়নি বা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কোন নীতিমালা পেশ করেনি। আর আমার রাসূলের মুখ দিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বাণী প্রকাশিত হচ্ছে এবং তোমরা তা শুনছো, সেসব বাণী তো মানুষের জন্য কল্যাণকর নীতিমালায় পরিপূর্ণ। সুতরাং, এ বাণী কি করে শয়তান কর্তৃক সঞ্চারিত হতে পারে? 

        আর শয়তান যদি মানব জাতিকে কল্যাণের পথে নিয়ে আসার জন্য কোন শিক্ষামূলক আদর্শ পেশ করতে চায়-ও, তবুও তো সে তা পারবে না। কেননা, আল্লাহর কোরআনের তুলনায় কোন কল্যাণকর আদর্শ শয়তানের পক্ষে পেশ করা সম্ভব নয়। শয়তান যদি ক্ষণিকের জন্য কৃত্রিম শিক্ষকের আসনে আসীন হয়ে মানুষকে শিক্ষা প্রদান করতে চায়, তবুও তো সে শিক্ষা কোরআনের নির্ভেজাল মহাসত্য ও নৈতিকতার উচ্চতর সর্বব্যাপী বিপ্লবাত্মক নীতিমালার সাথে কোন দিক থেকেই তুলনীয় হতে পারে না।

        প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা করার লক্ষ্যেও শয়তান যদি সৎকাজের আহ্বায়ক হিসাবে অভিনয় করে, তবুও তো তার কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে তার স্বভাবজাত শয়তানী প্রকাশ পাবেই। যে ব্যক্তি শয়তানের অনুপ্রেরণায় নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়ে বসে, তার নিজের জীবনে ও তার শিক্ষার মধ্যে অনিবার্যরূপে উদ্দেশ্যের অবিশুদ্ধতা, ইচ্ছাশক্তির অপবিত্রতা প্রকাশিত হবেই। নির্ভেজাল সততা ও নির্ভুল সৎকর্মশীলতা কোন শয়তান মানুষের হৃদয় জগতে সঞ্চারিত করতে সক্ষম নয়। আর শয়তানের সাথে যারা সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তারা কখনো মহাসত্যের। ধারক-বাহক হতে পারে না। তদুপরি পবিত্র কোরআনের শিক্ষার উচ্চতর সম্মান ও মর্যাদা, পবিত্রতা, কোরআনের সুনিপুন বাগধারা, সাহিত্যালঙ্কার এবং সুগভীর তত্ত্বজ্ঞান, সৃষ্টিজগৎ ও প্রাণীজগৎ সম্পর্কে স্পষ্ট মৌলিক ধারণা যা গোটা কোরআনে বিস্তৃত রয়েছে যার ভিত্তিতে কোরআন বার বার চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছে যে, এ কোরআনের অনুরূপ কোন আয়াত শয়তান, জ্বিন ও সমস্ত মানুষ তাদের সমস্ত শক্তি একত্রিত করেও রচনা করতে সক্ষম নয়। শুধু তাই নয়, যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত জিরাইল আলাইহিস্ সালাম রাসূলের কাছে কোরআন নিয়ে আগমন করেন, তখন তাঁর আগমন পথের কোন একটি স্থানে শয়তান অবস্থান করা তো দূরের কথা, দূরে-বহুদূরে সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমনটি কখনো ঘটেনি যে, ওহী নিয়ে আসা হচ্ছে আর শয়তান সেই পথে গোয়েন্দাগিরি করছিল এবং ওহীর বিষয়বস্তু কিছুটা সে জেনে নিয়ে তার পূজারীদের কাছে সে এ কথা জানিয়ে দিয়েছে, আজ মুহাম্মাদের ওপরে অমুক বিষয়বস্তু সম্বলিত আয়াত অবতীর্ণ হবে। এটা যদি ঘটতো তাহলে তোমরা তোমাদের গণৎকারদের মাধ্যমে নিশ্চয়ই এতদিন শুনতে সক্ষম হতে।

        সেই প্রাচীন কাল থেকেই কিছু সংখ্যক মানুষের ধারণা যে, উর্ধ্বজগতে মহান আল্লাহ যেসব সিদ্ধান্তের কথা তাঁর ফেরেশতাদেরকে অবগত করে থাকেন, ফেরেশতারা তা নিয়ে যখন আলোচনা করে, তখন জ্বিন ও শয়তান উর্ধ্বজগতে আড়ি পেতে তা শ্রবণ করে এসে তার পূজারীদেরকে জানিয়ে দেয়। এভাবেই গণৎকারগণ ভবিষ্যৎবাণী করে থাকে। পবিত্র কোরআন বলছে, মানুষের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল যে, শয়তান উর্ধ্বজগতে গমন করার ক্ষমতা সম্পন্ন। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, শয়তান অবশ্যই ঊর্ধ্বজগতে প্রবেশ করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তা'য়ালা সে জগতের ব্যবস্থাপনা এমনভাবে সুসম্পন্ন করেছেন যে, শয়তানের পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য। আল্লাহ উর্ধ্বজগতে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ নিমার্ণ করেছেন। সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে সে জগত থেকে উত্তপ্ত উল্কাপিন্ড নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। শয়তান সে জগতের আশেপাশে ঘুরঘুর করার চেষ্টা করলেই একটি মহাশক্তিশালী অগ্নিপিন্ড তাকে ধাওয়া করে। সুতরাং রাসূলের মুখ থেকে যে কোরআন প্রকাশিত হচ্ছে, তা পরিপূর্ণভাবে শয়তানের হস্তক্ষেপ বা প্রভাব মুক্ত।

        এরপরেও বলা হয়েছে, এই কিতাব এমন এক সত্তার মাধ্যমে নবীর কাছে প্রেরণ করা হয়, যিনি যাবতীয় মানবীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত। এ কোরআন নিয়ে কোন বস্তুগত শক্তি আগমন করেনি, যার মধ্যে পরিবর্তন ও অবক্ষয়ের সামান্যতম কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে। সেই সত্তা যাকে বলা হয়েছে 'রুহুল আমিন' তাঁর ভেতরে বস্তুবাদিতার কোন চিহ্ন নেই। মানব জাতির মধ্যে যেমন অবিশ্বস্ততার প্রবণতা বিদ্যমান, রুহুল আমিন বা জিবরাইল আলাইহিস্ সালাম এসব প্রবণতা থেকে মুক্ত। তিনি সম্পূর্ণরূপে আমানতদার। পৃথিবীর অতিবিশ্বস্ত মানুষও প্রলোভনে পড়ে ক্ষেত্র বিশেষে বিশ্বস্ততা হারিয়ে বসে। কারণ মানুষের মধ্যে প্রলোভিত হওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু রুহুল আমিন সে প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত-তাঁকে সৃষ্টিই করা হয়েছে সেভাবে। এ কারণে তিনি যখন কোরআন নিয়ে আসেন, তখন শয়তান এর ভেতরে কোন মিশ্রণ ঘটাবে, এ সুযোগ শয়তান লাভ করা তো অনেক পরের ব্যাপার, রুহুল আমিনের আগমন পথ থেকে শয়তানকে শতকোটি যোজন দূরে অবস্থান করতে হয়। সুতরাং কোরআন শয়তান কর্তৃক সঞ্চারিত কোন বাণী নয়-এ বাণী অবতীর্ণ হয়েছে গোটা জগতের প্রতিপালক, স্রষ্টা ও পরিচালক, নিয়ন্ত্রক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে।

Post a Comment

0 Comments