পৃথিবীতে মানুষ পশুসুলভ জীবন-যাপন করতে পারে না। মানুষের জন্য প্রয়োজন হয় তার ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবন পরিচালনার রীতিনীতি। জীবনের এসব দিক পরিচালিত করার জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া হয় বিশেষ কোন চিন্তাদর্শ বা মতবাদকে। যে মতাদর্শকে মানুষ অনুসরণ করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সে মতবাদ ত্রুটিপূর্ণ হলে মানুষ নিশ্চত ধ্বংস গহ্বরের দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে যেতে থাকে। মানুষের গোটা জীবন থেকে শান্তি ও স্বস্তি তিরোহিত হয়। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জন্য নির্দিষ্ট একটি আদর্শের প্রয়োজন হয়। মানুষ যে কোন কাজের মুখোমুখি হলেই তার সামনে প্রথম যে সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়, তাহলো সে.কোন নিয়মে তার সামনে উপস্থিত কর্মটি সম্পাদন করবে। কে তাকে নিয়ম পদ্ধতি শিখিয়ে দেবে। এ থেকে স্পষ্ট অনুভূত হয় যে, মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই নিয়মের মুখাপেক্ষী। এখন এই নিয়ম বা আদর্শ কে রচনা করবে অথবা কে এই আদর্শ দান করবে-এই প্রশ্ন মানুষের সামনে এসে উপস্থিত হয়।
প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে যখন এই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হলো, তখন তাঁর মনে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নের উদয় হয়েছিল, তিনি কোন আদর্শ অনুসরণ করে এই পৃথিবীতে জীবন-যাপন করবেন। বিষয়টি তাঁকে অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। তাঁর এই সমস্যার সমাধান সূরা বাকারার ৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা দিয়ে দিলেন-
فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنَى هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
আমার পক্ষ থেকে, যে জীবন বিধান তোমাদের কাছে পৌঁছবে, যারা আমার সেই বিধান অনুসরণ করবে, তাদের জন্য ভয়ভীতি এবং চিন্তার কোন কারণ অবশিষ্ট থাকবে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ কথা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মানুষের জন্য যাবতীয় নিয়ম-পদ্ধতি ও আদর্শ' বা জীবন পরিচালনার জন্য যে বিধান প্রয়োজন, তা তিনিই দান করবেন। মানব জীবনের এ জটিল বিষয়টি আল্লাহ তা'য়ালা কোন মানুষের হাতে সোপর্দ করেননি, স্বয়ং তিনিই এ বিষয়টি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। প্রশ্ন আসতে পারে মানুষের জীবন বিধান দেয়ার বিষয়টি কেন তিনি নিজের এখতিয়ারে রাখলেন এবং এ দায়িত্ব স্বয়ং মানুষের ওপরে অর্পণ করলেন না কেন?
এর জবাব হচ্ছে, মানুষ নিজেকে যতই বুদ্ধিমান, যোগ্যতা সম্পন্ন ও যাবতীয় জ্ঞানের অধিকারী বলে ধারণা করুক না কেন-প্রকৃত পক্ষে মানুষ চরম অসহায়, অক্ষম এবং সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী। মানুষের অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধ জ্ঞানকে পুঁজি করে মানুষের পক্ষে ভারসাম্যমূলক ও ইনসাফপূর্ণ কোন জীবন বিধান রচনা করা সম্ভব নয় বিধায় স্বয়ং আল্লাহ এ দায়িত্ব কোন মানুষের ওপর অর্পণ না করে নিজের এখতিয়ারে রেখেছেন। কেননা, এ পৃথিবীতে অসংখ্য বাঁকা পথের অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক নিয়ম-নীতি ও আদর্শের অস্তিত্ব রয়েছে। যা অনুসরণ করলে মানুষ নিশ্চিত ধ্বংস গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংসের অতল তলদেশে তলিয়ে না যায়, এ জন্য আল্লাহ তা'য়ালা মানুষকে পথপ্রদর্শন করেন। সূরা নাহলে-এর ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
وَعَلَى اللهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ
আর আল্লাহরই দায়িত্বে রয়েছে সকল পথপ্রদর্শন, যখন বাঁকা চোরা পথও অনেক রয়েছে। পথপ্রদর্শনের এই দায়িত্ব আল্লাহ তা'য়ালা কোন নবী-রাসূলের ওপরেও অর্পণ করেননি। তিনি নবী ও রাসুল প্রেরণ করে তাঁদেরকে যে পথ ও আদর্শের দিকে মানুষকে আহ্বান জানাতে নির্দেশ দান করেছেন, তাঁরা তাঁদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব সর্বশক্তি নিয়োগ করে পালন করেছেন। সর্বশেষ এ দায়িত্ব পালন করেছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর ওপরে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে এ কোরআনকে মানব জাতির জন্য জীবন বিধান হিসাবে মনোনীত করেছেন। এক কথায় মানব জাতির জীবন বিধান হিসাবে এই কোরআনকে অবতীর্ণ করে বলা হয়েছে-
كتابٌ أُنْزِلَ إِلَيْكَ فَلَا يَكُنْ فِي صَدْرِكَ حَرَجٌ مِّنْهُ لِتُنْذِرَبِهِ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ -
এটা এটা একটি কিতাব, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। (হে রাসূল!) তোমার হৃদয়ে এর জন্য যেন কোন ধরনের কুণ্ঠা না জাগে। এটা অবর্তীর্ণ করার উদ্দেশ্যে এই যে, এর মাধ্যমে তুমি (অমান্যকারীদেরকে) ভীতি প্রদর্শন করবে এবং বিশ্বাসীদের জন্য এটা হবে স্মরণ ও স্মারক। (হে মানবমন্ডলী) তোমাদের রব্ব-এর পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা-ই অনুসরণ করো এবং তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোন পৃষ্ঠপোষকদের অনুসরণ ও অনুগমন করো না।
(সূরা আল-আ'রাফ-২-৩)
অর্থাৎ কোরআন যাঁর ওপরে অবতীর্ণ করা হলো, তাঁকে এটা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হলো, এটা মানব জাতির জীবন বিধান এবং উদ্দেশ্যেই এটা অবতীর্ণ করা হয়েছে। কোন ধরনের ভীতি ও কুণ্ঠা ব্যতীতই এই বিধান প্রচার ও প্রসার করতে থাকো। যারা এটা অস্বীকার করবে, তারা তোমার সাথে কি ধরনের ব্যবহার করবে, এ চিন্তা কারার কোন প্রয়োজন নেই। এটা অবতীর্ণ করার কারণ হলো, ভীতি প্রদর্শন করা। অর্থাৎ রাসুল যেদিকে মানবজাতিকে আহ্বান জানাচ্ছেন, সে আহ্বানকে উপেক্ষা করার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সজাগ করে দেয়া এবং অচেতন ও উদাসীন লোকদেরকে সচকিত ও সতর্ক করা। আর অবিশ্বাসীদেরকে যখন সতর্ক করা হয়, তখন বিশ্বাসীগণ স্বাভাবিকভাবেই অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করেন।
অমানিশার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল মানব জাতি। এই অন্ধকার থেকে মানব মন্ডলীকে আলোর দিকে আনার লক্ষ্যেই আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে রাসুল প্রেরণ করে তাঁকে কিতাব দান করেছেন এবং কিতাব কেন অবতীর্ণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে ঘোষণা দেয়া হয়েছে-
كِتَابٌ أَنْزَلْنَهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَتِ إِلَى النُّورِ
(হে রাসূল!) এটা একটি কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যেন তুমি মানুষদেরকে অমানিশার নিচ্ছিদ্র অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসো।
অর্থাৎ মানুষকে বাঁকাচোরা, ক্ষতিকর, শয়তানি পথ থেকে কল্যাণের পথের দিকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। মানুষ জানে না তাঁর প্রকৃত মালিক কে। কে তার প্রতিপালক। কোন শক্তির দাসত্ব তাকে করতে হবে এবং কেন করতে হবে। কার আইন-কানুন সে পৃথিবীতে অনুসরণ করবে এবং কেন করবে। এসব বিষয় পরিপূর্ণরূপে অবগত করানোর লক্ষ্যেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
هذا بلغ لِلنَّاسِ وَلِيُنْذَرُوا بِهِ وَلِيَعْلَمُوا أَنَّمَا هُوَ إِلَهُ وَاحِدٌ وَلِيَدٌ كَرَ أُولُوا الْأَلْبَابِ
প্রকৃত পক্ষে এটা (কোরআন) একটি পয়গাম সমস্ত মানুষের জন্য আর এটা প্রেরণ করা হয়েছে এ জন্য যে, এই কিতাবের মাধ্যমে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হবে এবং তারা এ কথা অবগত হবে যে, প্রকৃতপক্ষে ইলাহ শুধু একজন আর জ্ঞানী ব্যক্তিগণ এ ব্যাপারে সচেতন হবে। (সূরা ইবরাহীম-৫২)
মানুষ কার দাসত্ব করবে এবং কে মানুষের জন্য জীবন বিধান রচনা করে দেবে, এ বিষয় নিয়ে মানুষের ভেতরে চরম মতপার্থক্য অতীতে যেমন চলেছে, বর্তমান কালেও চলছে। এক শ্রেণীর মানুষ নিজের মন-মস্তিষ্ক প্রসূত আইন-কানুন মানব গোষ্ঠীকে অনুসরণ করার কথা বলছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে কিছু সংখ্যক মানুষ আল্লাহর দেয়া বিধানের বিপরীত আইন-কানুন দিয়ে দেশ ও জাতিকে পরিচালিত করছে। আইন প্রণয়নের অধিকার কে সংরক্ষণ করেন এবং কেন করেন, এ বিতর্কের সমাধানের লক্ষ্যেই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং এ কথা সুস্পষ্টরূপে জানিয়ে দিয়েছে যে, আইন রচনা করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালা সংরক্ষণ করেন। আল্লাহ বলেন-
وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ الاّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيْهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
আমি তোমার প্রতি এ কিতাব এ জন্য অবতীর্ণ করেছি যেন তুমি এ মতভেদের তাৎপর্য এদের কাছে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরো। যার মধ্যে এরা ডুবে রয়েছে। এ কিতাব পথনির্দেশ ও রহমত হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে তাদের জন্য যারা একে মেনে নেবে। (সূরা আন্ নাহল-৬৪)
কল্পনা, ভাব-বিলাস, অন্ধানুকরণ ও কুসংস্কারের এবং জড়বাদ আর বস্তুবাদের ভিত্তিতে যে অসংখ্য মতবাদ, ধর্মমত রচনা করা হয়েছে এবং মানুষকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা হয়েছে, এসবের অবসান কল্পে একটি মহাসত্যের স্থায়ী বুনিয়াদের ওপরে যেন মানব গোষ্ঠী দাঁড়াতে সক্ষম হয়, এ জন্য এই কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। যারা এ কোরআনকে স্বীকৃতি দিয়ে অনুসরণ করবে এবং আনুগত্যের পথ অবলম্বন করবে, এ কিতাব জীবনের প্রতিটি বিভাগ ও ক্ষেত্রে তাদেরকে পথপ্রদর্শন করবে। একে অনুসরণ করে চলার কারণে তাদের ওপরে মহান আল্লাহ রহমত অবতীর্ণ করবেন। এই কোরআন তাদেরকে এ সুসংবাদ প্রদান করে যে, আদালতে আখিরাতে তারা সফলতা অর্জন করবে। আর যারা এ কিতাব অনুসরণ করবে না, তারা সমস্ত দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ কিতাব আল্লাহর অনুগত বান্দাদেরকে সুসংবাদ ও রহমতের সংবাদ এবং সমস্ত বিষয় সম্পর্কিত স্পষ্ট জ্ঞান দেয়ার জন্য অবর্তীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
আমি এ কিতাব তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যা সব জিনিস পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে এবং যা সঠিক পথনির্দেশনা, রহমত ও সুসংবাদ বহন করে তাদের জন্য যারা আনুগত্যের মস্তক নত করে দিয়েছে। (সূরা আন্ নাহল-৮৯)
অজ্ঞ, নির্বোধ, অসচেতন, উদাসীন, অমনোযোগী, অসতর্ক, বিদ্রোহী মানুষদেরকে সজাগ সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে এ কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
وَلَقَدْ صَرَّفْنَا فِي هَذَا الْقُرْآنِ لِيَذْكُرُوا -
আমি এ কোরআনে নানাভাবে মানুষদেরকে বুঝিয়েছি যেন তারা সজাগ হয়। (বনী ইসরাঈল) এই কোরআনে এমন কোন কথা নেই যা বুঝতে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। আবার সত্য ও ন্যায়ের সরল রেখা থেকে বিচ্যুত হতে পারে এমন কোন কথাও এ কোরআনে নেই। এ কোরআন স্পষ্ট এবং সোজা কথা বলার জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا -
প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এ কিতাব অবর্তীর্ণ করেছেন এবং এর মধ্যে কোন বক্রতা রাখেননি। একেবারে সোজা কথা বলার কিতাব। (সূরা আল কাহ্ফ-১)
যারা আল্লাহর বিধান অনুসারে পৃথিবীতে জীবন পরিচালিত করে তাদের জন্য সুসংবাদ এবং যারা মানুষের বানানো বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে, তাদের ঘৃণ্য পরিণতি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করার লক্ষ্যে এ কোরআন অবর্তীণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
فَإِنَّمَا يَسْرْتُهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَبِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنْذِرَبِهِ قَوْمًا لدا -
(হে রাসূল!) এই বাণীকে আমি সহজ করে তোমার ভাষায় এ জন্য অবতীর্ণ করেছি যেন তুমি মুত্তাকীদেরকে সুসংবাদ দিতে পারো এবং হঠকারীদেরকে ভীতি প্রদর্শন করতে পারো।
রাসুল এবং তাঁর অনুসরণকারীদের ওপরে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি যে, যারা আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়-তাদের ওপরে শক্তি প্রয়োগ করে তা অনুসরণ করাতে হবে। যারা ঈমান আনবে না, শক্তির মাধ্যমে তাদের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করাতে হবে। এ দায়িত্ব রাসুলের বা তাঁর অনুসারীদের নয়। কোন অসাধ্য সাধন করার জন্য রাসুলকে প্রেরণ করা হয়নি অথবা এমন কোন দায়িত্ব তাঁর ওপরে অর্পণ করে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করা হয়নি। যারা ঈমান আনতে আগ্রহী নয়, ইসলামী আন্দোলন যারা জেনে বুঝে পছন্দ করে না, তাদেরকে সত্য পথে নিয়ে আসার জন্য অযথা সময় নষ্ট করার দায়িত্ব আল্লাহ তা'য়ালা কারো ওপরে অর্পণ করেননি। আবার এ কোরআন এ জন্যও প্রেরণ করেননি যে, এই কিতাব যাঁর ওপরে অবতীর্ণ করা হলো তিনি এবং এ কিতাবের অনুসারীগণ পৃথিবীতে অবহেলিত ও লাঞ্ছনাময় জীবন-যাপন করবে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
طهُ مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى
আমি এ কোরআন তোমার প্রতি এ জন্য অবতীর্ণ করিনি যে, তুমি লাঞ্ছিত থাকবে। (ত্ব-হা-১) ভুল করা মানুষের স্বভাব-মানুষ ভুল করবেই। সে ভুল করে ভ্রান্ত পথ ও মত অনুসরণ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আবার অসচেতনতার কারণে মানুষ ধ্বংস গহ্বরের দিকে এগিয়ে যায়। মানষের এ অবস্থা থেকে তাকে সচেতন করার লক্ষ্যে এ কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
وكذالِكَ أَنْزَلْتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا وَصَرَفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا -
(আর হে রাসূল!) এভাবে আমি একে আরবী কোরআন বানিয়ে অবতীর্ণ করেছি এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সতর্কবাণী করেছি হয়তো এরা বক্রতা থেকে নিরাপদ থাকবে এবং তাদের মধ্যে সচেতনতার নিদর্শন দেখা দেবে। (আল কোরআন, সূরা ত্বা-হা-১১৩)
মানুষকে সতর্ক করা এবং সৎপথে পরিচালিত করার লক্ষ্যে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এ সম্পর্কে সূরা সাজদাহ্-এর ২-৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
تَنْزِيلُ الْكِتَابِ الأَرَيْبَ فِيهِ مِنْ رَبِّ الْعَلَمِينَ أَمْ يَقُولُونَ فتَرُهُ بَلْ هُوَ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ لِتُنْذِرَ قَوْمًا مَّا أَنَّهُمْ مِّنْ نَذِيرَ مَنْ قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَهْتَدُونَ
এ কিতাবটি রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, এতে কোন সন্দেহ নেই। এরা কি বলে, এ ব্যক্তি নিজেই এটি রচনা করে নিয়েছে? না, বরং এটি সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে, যাতে তুমি সতর্ক করতে পারো এমন একটি জাতিকে যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আগমন করেনি, হয়তো তারা নিজেদেরকে সৎপথে পরিচালিত করবে।
যারা আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করে; পরকালীন জীবনকে যারা খেল-তামাসার বিষয় বলে মনে করে; আল্লাহর ফেরেস্তা, জান্নাত-জাহান্নম ও আদালতে আখিরাতে হিসাব গ্রহণের বিষয়কে যারা রূপকথার গল্প এবং কবিদের কল্পনা বলে হেসে উড়য়ে দেয়, তাদের এসব
ধারণা খন্ডন করে মহাসত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-
وَمَا عَلَّمْنَهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ ط إِنْ هُوَ إِلا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُّبِينٌ - لَيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيَّا وَيُحِقُّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَفِرِينَ -
আমি (নবী)-কে কাব্য কথা শিক্ষা দেইনি এবং কাব্য চর্চা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়। এ তো একটি উপদেশ এবং পরিষ্কার পঠনযোগ্য কিতাব, যাতে সে প্রত্যেক জীবিত ব্যক্তিকে সতর্ক করে দিতে পারে এবং অস্বীকারকারীদের ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। (সূরা ইয়াছিন)
মহান আল্লাহ তা'য়ালা হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সৃষ্টি করে তাঁর সামনে পৃথিবীর সমস্ত বস্তু একত্রিত করে সেসব বস্তু নিচয়ের নামসমূহ তাঁকে শিক্ষা দিয়োছলেন। তারপর সেসব বস্তুর নাম ফেরেস্তাদেরকে বলতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে আল্লাহকে বলেছিলেন-
قَالُوا سُبْحَانَكَ لَأَعِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا -
সমস্ত দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত একমাত্র আপনিই, আমরা তো শুধু ততটুকুই অবগত আছি যতটুকু আপনি আমাদের স্বগত করেছেন। (সূরা বাকারা-৩২)
কিন্তু আল্লাহর প্রথম নবী হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম ঠিকই সমস্ত বস্তুর নাম ও তার গুণাগুণসহ বর্ণনা করেছিলেন। বিষয়টি কেমন ছিল তা একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যাক। ধরা যাক, সে সময় ফেরেশতার সংখ্যা ছিল পাঁচ শত কোটি। তাদের শরীরের আয়তন যদি বর্তমান মানুষের শরীরের আয়তনের মত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের সহজভাবে বসার জন্য যদি একবর্গ গজ করে স্থানেরও প্রয়োজন হতো, তবে তাদের বসার জন্য পাঁচশত কোটি বর্গ গজ স্থানের প্রয়োজন হতো। অর্থাৎ ফেরেশতাদের বসার জন্য প্রায় দশলক্ষ একরেরও বেশী জমির প্রয়োজন হতো। তার মানে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির মত বিরাট একটি মাঠের প্রয়োজন হতো। আমরা পৃথিবীতে যদি এই ধরনের কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করি, তাহলে আমাদেরকে কি করতে হবে? প্রথমে সাহারা মরুভূমিতে বিরাট একটি মঞ্চ প্রস্তুত করতে হবে। তারপর তার ভেতরে বিশাল আকৃতির একটি গ্যালারী প্রস্তুত করতে হবে। এরপর সেই গ্ল্যালারীতে পৃথিবীর সমস্ত বস্তুর অংশ সাজিয়ে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে সেখানে উপস্থিত করে যদি প্রশ্ন করা হয়, কে পারবে এই সমস্ত বস্তুর নাম গুণাগুণ ও ব্যবহার পদ্ধতি বলতে। তাহলে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে কল্পনা করা যায়?
সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে সমস্ত বন্ধুর নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁরা তা বলতে পারেনি এবং আদম আলায়হিস্ সালাম সেসব বস্তুর নাম, গুণাগুণ ও ব্যবহার পদ্ধতি বলেছিলেন। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি, এই ধরনের একটি বিশাল কিছুর আয়োজন মহান আল্লাহ তাঁর কুদরতি ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পন্ন করেছিলেন। এবার ধারণা করা যাক, পৃথিবীতে যদি এই ধরনের কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাহলে তায় নাম কি দেয়া হবে। ধরে নেয়া যাক, পদার্থ বিজ্ঞান মেলা বা মহাপদার্থ বিজ্ঞান মেলা একটা কিছু নাম দেয়া হলো।
এখন কোন মানুষকে যদি সেখানের সমস্ত বস্তুর নাম, ব্যবহার পদ্ধতি ও গুণাগুণ বলতে বলা হয়, কোন মানুষ তা বলতে পারবে? মানুষের ব্যবস্থায় এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরতের কাছে এটা কোন বিষয়ই নয়। তিনি তা মুহুর্তের ভেতরেই সম্পন্ন করেছিলেন। আবার মনে করা যাক, মানুষের পক্ষে এমন একটি বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হলো। তারপর সেখানে কোন মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এ সমস্ত জিনিষের নাম, ব্যবহার পদ্ধতি ও গুণাগুণ বর্ণনা করতে হবে। কোন মানুষের পক্ষে কি তা বর্ণনা করা সম্ভব? পদার্থ বিজ্ঞানে যারা একাধিক নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন, তারাও কি বলতে পারবেন? কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরতে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম তা পেরেছিলেন।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে যদি আমরা বলি, বস্তু বিজ্ঞানী, প্রাণী বিজ্ঞানী, রসায়ন বিজ্ঞানী পদার্থ বিজ্ঞানী এক কথায় সমস্ত বিষয়ে তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন, তাহলে কি তা ভুল হবে? সে বিজ্ঞানীর শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। অর্থাৎ বিজ্ঞানের প্রথম ছাত্র ছিলেন হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম এবং আল্লাহ তায়ালা হলেন তাঁর শিক্ষক। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁকে বিজ্ঞান শিক্ষা দান করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ। সৃষ্টির শুরুতেই বিজ্ঞান, সৃষ্টির প্রথম মানুষ একজন বিজ্ঞানী। কি ধরনের বিজ্ঞানী তা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম নবী ছিলেন, রাসূল ছিলেন, পৃথিবীতে আসার পূর্বে তাঁকে নবুয়্যত দান করা হয়েছিল না পরে দান করা হয়েছিল, সাপ ময়ুরের অস্তিত্ব সেখানে ছিল কিনা, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ গবেষণা করেন, বিতর্ক করেন। কিন্তু আফসোস, তিনি যে বিজ্ঞানী ছিলেন, তা নিয়ে গবেষণা করেন না। এ সম্পর্কে গবেষণা তো করেনই না, যারা বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চা করেন তাদেরকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত করেন এবং তাদের প্রতি নির্দয় মন্তব্য করেন।
এই পৃথিবীতে আল্লাহ যা কিছুই সৃষ্টি করেছেন তা সবই মানুষের জন্য মানুষের কল্যাণের জন্য। পৃথিবীর বস্তু নিয়ে মানুষ গবেষণা করে তা মানব জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করবে। এসব বিষয়ে মানুষ যেন চিন্তা-গবেষণা করে সে লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কোরআনে উৎসাহাতি করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
كِتَابٌ أَنْزَلْنَهُ إِلَيْكَ مُبْرَكَ لِيَدَبَّرُوا البَيتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُوا الْأَلْبَابِ
এটি একটি অত্যন্ত বরকতপূর্ণ কিতাব, যা (হে রাসূল।) আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যেন এরা তার আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। (সূরা সা-দ-২৯)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআনকে মানব জাতির জন্য বরকতপূর্ণ কিতাব বলেছেন। বরকতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, কল্যাণ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি। এই কিতাবকে বরকতপূর্ণ কিতাব বলার কারণ হলো, এ কিতাব অসংখ্য বাঁকা পথের ভেতর থেকে সত্য-সহজ-সরল পথ কোনটি তা মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসে। এ কিতাব যারা সঠিকভাবে অনুসরণ করে, তাদেরকে সারা পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে আসীন করে দেয়। মানুষের জীবন থেকে অশান্তির শেষ চিহ্নটুকুও দূরীভূত করে দেয়। মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বোত্তম বিধান দান করে। এ কিতাবে আলোচিত বিষয়সমূহ নিয়ে গবেষণা করে মানুষ চরম উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে সক্ষম হয়। এ জন্য এ কিতাবকে বরকতপূর্ণ বলা হয়েছে এবং চিন্তা ও গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য এ কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে।
এই কোরআন অবতীর্ণ করার উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন একমাত্র আল্লাহর গোলাম হয়ে যায়, তারা যেন তাঁরই গোলামী করে এবং গোলামী যেন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে যায়। মানুষ নামাজ, রোজা ও হজ্জ পালনের সময়টুকু আল্লাহর গোলামী করবে, আর জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে অন্য মানুষের রচিত বিধান অনুসারে নিজেকে পরিচালিত করবে, এ ধরনের দ্বৈত গোলামী করার অবকাশ ইসলামে নেই। মানুষকে এ উদ্দেশ্যেই প্রস্তুত করার জন্য পৃথিবীতে কোরআন এসেছে। আল্লাহ বলেন-
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
(হে রাসূল!) আমি তোমার কাছে হকসহ এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি। তাই তুমি একনিষ্ঠভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করো। (সূরা আয যুমার-২) "
মূলতঃ মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মহান আল্লাহর দাসত্ব করার লক্ষ্যে। এ পৃথিবীতে যা কিছুই সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সবই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করা হয়েছে আর মানুষকে সৃষ্টি কর। হয়েছে, তারা কেবলমাত্র রাব্বুল আলামীনের গোলামী করবে। মানুষকে এ অবকাশ দেয়া হয়নি যে, সে আল্লাহর সৃষ্টি যাবতীয় নিয়ামত ভোগ করবে আর জীবন পরিচালিত করবে নিজের অথবা অন্যের খেয়াল-খুশী মতো।
0 Comments