প্রথম ওহীর তাৎপর্য

        বিশ্বনবীর প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম যে ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল, তা ছিল-

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ - خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَى اقْرَأْ وَرَبُّكَ الأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ

        পড়ো তোমার রব-এর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। জমাটবাঁধা এক রক্তপিন্ড হতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, এবং তোমার রব অত্যন্ত অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের দ্বারা জ্ঞান শিক্ষাদান করেছেন। মানুষকে এমন জ্ঞানদান করেছেন যা সে অবগত ছিল না।'

        এ সূরার নাম হলো 'আল্ আলাক', পবিত্র কোরআনের ত্রিশ পারার ৯৬ নং সূরা। এই সূরার ১ থেকে ৫ নং আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল। এই আয়াতগুলোয় স্পষ্ট করে ঘোষনা করা হয়েছে, মহান আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির ভেতরে মানুষ হলো সর্বোত্তম সৃষ্টি এবং পৃথিবীর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উন্নত সৃষ্টি এবং এ কারণে মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। মানুষের সৃষ্টিগত দুর্বলতা এটাই যে, তাঁর আগমনের সূচনা হলো অপবিত্র পানি এবং জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ যখন তাকে উচ্চ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং সর্ব 'নিম্ন পর্যায়ের' সৃষ্টিকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা করলেন, তখন তাকে এমন গুণ দান করলেন যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দান করা শ্রেষ্ঠগুণ। তাকে জ্ঞান নামক গুণের প্রকাশ ক্ষেত্র হিসাবে প্রস্তুত করলেন। তাকে কলমের মাধ্যমে লেখা শিক্ষা দান করলেন। সব ধরনের জ্ঞান ও আবিষ্কারের ক্ষমতা দান করলেন। আবার মানুষকে এটাও উপলব্ধি করালেন যে, উপায় ও উপকরণগত ধারায় জ্ঞান অর্জনের তিনটি মাত্র নিয়ম বিদ্যমান।

        জ্ঞানার্জনের প্রথম প্রকারের মাধ্যম হলো, অন্তর জগৎ ও মেধার জগতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জন্মগতভাবে যে জ্ঞান প্রদান করা হয়, তা শব্দ, অক্ষর এবং চিত্র বা লেখনীর মুখাপেক্ষী নয়। ইলহামের মাধ্যমেই এভাবে মানুষ জ্ঞানার্জন করে। জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় মাধ্যম হলো কোন কিছু শুনে মুখে আবৃত্তি করে তা স্মরণে রাখা। জ্ঞানার্জনের এ পথ হলো জিহ্বার মুখাপেক্ষী, অক্ষর ও লেখনীর মুখাপেক্ষী নয়। জ্ঞানার্জনের তৃতীয় মাধ্যম হলো, অক্ষর ও লেখনীর দ্বারা। কিন্তু এটা এমন একটি মাধ্যম যে, এই মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের উল্লেখিত দুটো মাধ্যম ছাড়া এই তৃতীয় মাধ্যমকে জ্ঞানার্জনের একমাত্র মাধ্যম হিসাবে অবলম্বন করা যায় না। এ কারণে বলা হয়েছে, তিনি তোমাদেরকে কলমের মাধ্যমে জ্ঞান শিক্ষা দান করেছেন। কলমের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে হলে যেমন অন্তর জগৎ ও মেধার জগৎ প্রসারিত হতে হয়, তেমনি প্রয়োজন হয় জিহ্বা দ্বারা আবৃত্তি করে তা স্মরণে রাখা।

        ফেরেশতা বিশ্বনবীর সামনে আবির্ভূত হয়ে বলেছিলেন, 'আপনি পড়ুন। জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমি পড়তে জানিনা।' ফেরেশতার কথা এটা ছিল না যে, আমি যা আবৃত্তি করছি, আমার সাথে অনুরূপ আপনিও করুন। এই বচন ভঙ্গী বা কথোপকথন থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় হযরত জিবরাঈল প্রথম ওহীর শব্দগুলো লিখিত আকারে তাঁর সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। প্রথম ওহী যে তাঁর সামনে লিখিত আকারে ছিল তা বিশ্বনবীর কথার ভঙ্গীতেও প্রকাশ পায়। তিনি বলেছিলেন, আমি পড়তে জানি না। ওহী লিখিত না হলে তিনি এ কথা বলতেন না। ব্যাপারটা যদি শুধুমাত্র মুখের সাথে সম্পর্কিত হতো তাহলে তিনি হযরত জিবরাঈলের সাথে সাথে প্রথমেই আবৃত্তি করে যেতেন, কোন আপত্তি উত্থাপন করতেন না। মহান আল্লাহর প্রথম বাণী থেকে এ সত্য উপলব্ধি করা যায় যে, তাঁকে নবুয়্যত দান করার পূর্বেই বিশেষ কোন প্রক্রিয়ায় তাঁর জ্ঞানের জগতে এ সত্য প্রবেশ করানো হয়েছিল, একমাত্র আল্লাহই হলেন রব বা প্রতিপালক। আল্লাহর এই রবুবিয়াত ছিল বিশ্বনবীর কাছে প্রকাশিত। 

        এ কারণেই দেখা যায় তিনি কোনদিন কোন মূর্তির কাছে সামান্য কোন প্রার্থনা করেননি। তিনি জানতেন যে, এই মূর্তিগুলো মানুষের রব্ব নয়, রব্ব হলেন একমাত্র আল্লাহ। এ সত্য তাকে অবগত করানো হয়েছিল বলেই তিনি মূর্তিকে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। তিনি ওহী আসার পূর্বেই একমাত্র আল্লাহকে রব্ব বলে জানতেন এবং তাঁকেই একমাত্র রব্ব হিসাবে মেনে চলতেন। এই রব্ব কি, এটা তাঁর কাছে পরিচিত ছিল ফলে প্রথম ওহীর ভেতরে নবীকে রব্ব-এর পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে হয়নি। সরাসরি তাকে বলা হয়েছিল, আপনি আপনার রব্ব-এর নামে পড়ুন বা বিসমিল্লাহ বলে শুরু করুন। ঐ রব্ব-এর নামেই পড়ুন, যিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি কাকে কিভাবে সৃষ্টি করেছেন এ কথা তাঁর নবীকে বলা প্রয়োজন হয়নি এ কারণে যে, নবীর জ্ঞানের জগতে এ কথাগুলো পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া হয়েছিল, দৃষ্টির আড়ালে এবং দৃষ্টির সামনে পরিদৃশ্যমান আলোকিত সমস্ত পৃথিবীটা এবং এর ভেতরে বা কিছু আছে, এ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। জমাটবাঁধা রক্ত যা ইতিপূর্বে ছিল তোমাদের দেহ নির্গত এক ফোটা অপবিত্র পানি। যাকে বিশেষ এক সময়ে জমাটবাঁধা রক্তে পরিণত করা হয়েছে, মাংস পিন্ডে পরিণত করে তার ভেতর অস্থি সংযোজন করে মানুষের আকৃতিদান করা হয়েছে। মানুষের প্রথম অবস্থা ছিল এক ফোটা অপবিত্র পানি, সেখান হতে সুন্দর মানুষ সৃষ্টি করে তাকে জ্ঞানের সঞ্জিবনী সূধা ঢেলে জ্ঞানের অলংকারে সজ্জিতকরণ সেই মহান আল্লাহর অসীম অনুগ্রহের প্রকাশ।

        তাকে শুধু জ্ঞানই দান করা হয়নি, কলমের মাধ্যমে তাকে এমন এক জ্ঞান দান করা হয়েছে যে, অর্জিত জ্ঞানের বিস্তৃতি এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তা সংরক্ষণের কৌশল ঐ মহান আল্লাহই তোমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন। তিনি যদি তোমাদেরকে অলক্ষ্যে থেকে কলমের ব্যবহার শিক্ষাদান না করতেন, তাহলে তোমাদের জ্ঞানের জগতে বন্ধ্যাত্ব নেমে আসতো। তোমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারতে না। তোমরা ছিলে জ্ঞানহীন অচেতন, কিছুই তোমরা অবগত ছিলে না। তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে যখন তোমাদের নিয়ে আসা হয় সে সময়ে তোমাদের কোন চেতনাই ছিল না। তারপর তোমাদেরকে তিনটি জিনিষ দান করা হয়েছে। চোখ কান এবং মস্তিষ্ক। একটা দিয়ে দেখবে আরেকটা দিয়ে শুনবে এবং মাথা দিয়ে চিন্তা করবে। তোমার চিন্তার জগতে আমিই আবিষ্কারের সূত্রদান করি। যা তোমার কাছে আবৃত, অজানা-অজ্ঞাত ছিল, তা তোমাকে জানানোর ব্যবস্থা আমি করেছি। তোমরা একটা নতুন কিছু উদ্ভাবন করে এ ধারণা করো যে, এটা তোমারই কৃতিত্ব। প্রকৃত ব্যাপার তা নয়, আমিই তোমার চিন্তার জগতে আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা এবং সুত্রদান করি। তুমি তোমার জ্ঞান দ্বারা কোন কিছুই করতে পারোনা। যতক্ষণ আমি তোমাকে সহযোগিতা না করি। তোমার এ জ্ঞান নেই, তুমি অনুভব করতে পারো না কিভাবে আমি তোমাকে জ্ঞানদান করি।

        মহান আল্লাহ তাঁর প্রথম বাণীতেই তাঁর রাসূলের ওপর কোন বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দেননি। তাঁর সামনে কাজের বিশাল তালিকাও পেশ করেননি। ওহী সম্পর্কে বিশ্বনবী ছিলেন অনভিজ্ঞ, প্রথম বার এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ করে মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে ওহী সম্পর্কে অভিজ্ঞ করলেন যেন আগামী বার তিনি ওহী ধারণ করতে পারেন। মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির জন্যও কিছুদিন তাঁকে সময় প্রদান করা হয়েছিল। প্রথমবার তাঁর পবিত্র স্বভাব প্রকৃতির ওপর যে প্রভাব নিপতিত হয়েছিল, তা যেন সহজ হয়ে যায়, এ কারণেও ওহীর বিরতি দেয়া হয়েছিল। প্রথম অবতীর্ণকৃত বাণীর তাৎপর্য হলো, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবুয়্যত সম্পর্কে অর্থাৎ তিনি যে নবী হবেন এ সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না। তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবগত করা হলো, আপনাকে নবী হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে, সুতরাং আপনি সাধারণের থেকে ভিন্ন। আপনার জীবন এবং সাধারণ মানুষের জীবনে আকাশ-পাতাল ব্যবধান বিদ্যমান। একজন রাসূলের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আপনাকে তা পালন করতে হবে। অর্থাৎ নবুয়্যত সম্পর্কে বিশ্বনবীকে সজাগ করে তোলা হয়েছিল প্রথম ওহী অবতীর্ণ করে। বিশ্বনবীর ওপরে মহান আল্লাহ তাঁর প্রথম ওহীতেই তাঁকে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ময়দানে এগিয়ে দেননি। যে দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল, সে দায়িত্ব সম্পর্কে প্রথম ওহীতে কোন নির্দেশ দান করা হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন তাঁর ওপরে ওহী অবতীর্ণ করা হলো, তখন তাঁর প্রতি নবুয়্যতের দায়িত্বের সাথে রেসালাতের দায়িত্বও অর্পণ করা হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁর ওপর অবতীর্ণ করা হলো পবিত্র কোরআনের ৭৪ নং সূরার প্রাথমিক সাতটি আয়াত। এই সূরার নাম হলো সূরায়ে আল্ মুদ্দাস্স্সির।

        বিশ্বনবীর আরেকটি নামও হলো মুদ্দাস্স্সির। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মুদ্দাস্স্সির নামটি হলো গুণবাচক বা উপাধি বিশেষ। হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালামকে দ্বিতীয় বার দেখে তিনি অস্থির হয়ে বাড়িতে এসে শয্যায় শুয়ে তাঁকে কম্বল দিয়ে আবৃত করে দিতে বলেছিলেন। এই সময় তাঁর ওপরে সূরা মুদ্দাস্স্সিরের প্রথম সাতটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। রাসূলকে আহ্বান করা হলো-

يأَيُّهَا الْمُدَّثَرَ - قُمْ فَانْذِرْ - وَرَبِّكَ فَكَبِّرْ - وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ - وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ - وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ - وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ -

        হে কম্বল আবৃত শয্যা গ্রহণকারী! ওঠো এবং সাবধান করো। এবং তোমার রব্ব-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশালত্বের ঘোষনা দাও। এবং নিজের পরিধেয় পোষাক পবিত্র রাখো। আর মলিনতা অপরিচ্ছন্নতা থেকে দূরে অবস্থান করো। আর অনুগ্রহ করো না অধিক লাভের আকাংখায়। এবং নিজের রব্ব-এর জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো।' (সূরা আল্ মুদ্দাসির-১-৭)

        এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, রাসূলকে এভাবে সম্মোধন করা হলো না, হে মুহাম্মাদ ওঠো! মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বনবীকে আহ্বান করা এখান থেকেই শুরু হয়েছে। গোটা কোরআন পাঠ করলে দেখা যায়, এভাবে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে নানা ধরনের মধুর নামেই আহ্বান করেছেন। কিন্তু বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের যে ব্যক্তিবাচক দুটো নাম রয়েছে, মুহাম্মাদ এবং আহমাদ, এ দুটো নামে আল্লাহ তাঁকে কখনো আহ্বান করেননি।

        মুহাম্মদ শব্দটা পবিত্র কোরআনে চারটি সূরায় মোট চারস্থানে উল্লেখ করা হলেও সেটা প্রাসঙ্গিকভাবে, তাঁকে আহ্বান করে নয়। আর আহমাদ শব্দটা একটি সূরায় মাত্র একস্থানে উল্লেখ করা হয়েছে হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামের কথা থেকে, তাঁকে আহ্বান করে নয়। অথচ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর প্রথম মানুষ, প্রথম নবী ও রাসূল, প্রথম বিজ্ঞানী হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সৃষ্টি করেই তাঁর নাম ধরে আহ্বান করে বলেছিলেন-

يادَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ

        হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী এই বেহেস্তের মধ্যে বসবাস করো।' (সূরা বাকারা)

        মহান আল্লাহ কর্তৃক নবীদেরকে আহবানের এই ধারা অব্যাহত থাকলো হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম পর্যন্ত। এই পৃথিবীতে যত নবী এবং রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে, তাদের সবাইকে মহান আল্লাহ সরাসরি নাম ধরে সম্মোধন করেছেন। প্রয়োজনের মুহুর্তে আহ্বান করা হয়েছে, হে আদম, হে নূহ, হে মুসা, হে ইবরাহীম, হে দূত অর্থাৎ নাম ধরে আহ্বান করা হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন বিশ্বনবী এবং তাঁকে কখনো তাঁর ব্যক্তিবাচক নামে আহ্বান করা হয়নি। তাঁর গুণবাচক নাম বা উপাধি দিয়েছেন আল্লাহ এবং সেই উপাধি ধরে বা গুণবাচক নামেই আল্লাহ তাঁকে আহবান করেছেন।

        এর কারণ হলো বিশ্বনবীর বিশাল মর্যাদা এবং সম্মান। আল্লাহ তাঁকে যে কত সম্মান এবং মর্যাদা প্রদান করেছেন, তাঁকে যে ভাষায় এবং ভঙ্গীতে আহ্বান করা হত, সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে অবাক হতে হয়। কম্বল দিয়ে নিজের শরীর আবৃত করে তিনি শয্যায় শায়িত, তাঁকে কি সুন্দর বিশেষণে-কি মধুর ভঙ্গিতে আহ্বান করা হলো, হে কম্বল গায়ে দেয়া শয্যায় শায়িত ব্যক্তি, ওঠো!

        দ্বিতীয় পর্যায়ের ওহী অবতীর্ণ করে তাঁকে বলা হচ্ছে, হে আমার প্রিয় বন্ধু! আপনি এমন করে কম্বলে আবৃত হয়ে শুয়ে আছেন কেন! এভাবে শুয়ে থাকা তো আপনার কাজ নয়। মানুষ পশুস্তরে নেমে গেছে, অসহায় মানুষ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আর্তনাদ করছে, মিথ্যে রব্ব-এর কাছে মানুষ নিজের কামনা বাসনা পেশ করছে, এসব দেখে আপনার মনে যে যন্ত্রণার ঝড় শুরু হতো, সে যন্ত্রণার অবসানের জন্যই আপনি কাজ শুরু করে দিন। আপনার ওপরে যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, সে দায়িত্ব পালন করুন। এ জন্য আপনি সংকল্পের দৃঢ়তা নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হোন। আপনি মানব এবং জ্বিন জাতিকে আদেশ করুন, তোমরা আল্লাহর সৃষ্টি করা পৃথিবীতে বাস করছো, তাঁর নেয়ামত ভোগ করছো, তাঁর অনুগ্রহ ব্যতীত এক মুহুর্ত জীবিত থাকতে সক্ষম হবেনা। অতএব তাঁরই বিধান অনুসরণ করে তাঁর দাস হয়ে যাও। একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করো, আর কারো দাসত্ব করো না। কেননা, তারা দাসত্ব লাভের উপযোগী নয়। তারা যদি তাদের রবের বিধান অনুসরণ না করে, তাহলে তাদেরকে সতর্ক করে দিন, তাদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এবং তাদের পরিণাম শুভ হবেনা।

        এ কথা মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে বলার পরেই আদেশ করলেন, আপনি যাকে রব্ব বলে জানেন, তিনিই প্রকৃত রব্ব। আয়াতটিতে 'ওয়া রাব্বাকা' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। রব্ব আরবি শব্দ। এই শব্দের অর্থ বড় ব্যাপক। রব শব্দের ব্যাখ্যা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ। এখানে শুধু এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন, যত আইন-কানুনের প্রয়োজন এ সমস্ত যিনি পূরণ করেন তিনিই হলেন রব্ব।

        পৃথিবীতে যত নবী রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে, তাদের সাথে যাদের সংঘর্ষ বেধেছে, তাঁরা আল্লাহকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু আল্লাহকে রব্ব হিসাবে গ্রহণ করতে আপত্তি করেছে। ফেরআউন ঘোষনা করেছিল, আমিই তোমাদের বড় রব। সে নিজেকে আল্লাহ হিসাবে ঘোষনা দেয়নি, দিয়েছিল রব হিসাবে। আজ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে এই রব্ব নিয়েই সত্যপন্থীদের সাথে বাতিল শক্তির সংঘর্ষ চলছে। সত্যপন্থীগণ দাবী করছে, এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ; তিনিই আমাদের রব্ব-তিনিই আমাদের জীবন বিধানদাতা। আর বাতিল শক্তি দাবী করছে, আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করলে করতেও পারেন। কিন্তু আইন-কানুন তৈরী এবং জীবন বিধান তৈরী করবো আমরা, এ ব্যাপারে আমরা স্বাধীন। আমাদের যে আদর্শ, আমাদের যে মতবাদ, সে অনুসারেই দেশ চলবে এবং দেশের মানুষকে তা অনুসরণ করে চলতে হবে।

        আল্লাহর নবীগণ তাদের এ কথা যখন গ্রহণ করেননি, তখনই সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তাদের কারো নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছে, কাউকে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়েছে, কাউকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, শুধুমাত্র এই রব্ব-এর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনা করার কারণে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহ আদেশ করলেন, 'আপনি শুয়ে থাকবেন না, উঠুন এবং আপনার রব্ব-এর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনা করুন। পৃথিবীতে নিজেদেরকে যারা রব্ব বানিয়ে বসেছে, তাদেরকে সতর্ক করে দিন, তোমরা রব্ব নও। রব্ব হলেন একমাত্র মহান আল্লাহ। কোন আইন-কানুন বিধান রচনা করার এখতিয়ার তোমাদের নেই। রব্ব সেজে যে গদিতে তোমরা বসে আছো, সে গদি ছেড়ে দাও। আল্লাহর বিধান ঐ গদিতে বসে দেশের বুকে, আল্লাহর বান্দাদের ওপরে আইন জারি করবে। পৃথিবীব্যাপী উচ্চকণ্ঠে ঘোষনা করে দাও, আল্লাহ আমাদের রব্ব এবং আল্লাহর সৃষ্টি এই পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বই চলবে, আল্লাহর রবুবিয়াত প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন। এই পৃথিবীতে নবী হিসাবে নির্বাচিত হয়ে একজন নবীর হলো এটাই সর্বপ্রথম কাজ এবং দায়িত্ব। এই পৃথিবীতে যারা নিজেদেরকে রব্ব বলে ধারণা করছে, মূর্খ মানুষ যে সমস্ত দুর্বল অথর্ব বস্তুকে নিজেদের রব্ব, বানিয়েছে, তাদেরকে বলে দাও, রব্ব হলেন একমাত্র আল্লাহ।

        রব্ব কি, রব্ব কাফে বলে এবং রব্ব-এর প্রয়োজনীয়তা কি, একমাত্র আল্লাহকে কেন রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মক্কী সূরাসমূহ এই রব্ব-এর আলোচনা এবং রিসালাত ও আখেরাতের আলোচনায় পরিপূর্ণ। তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত এ তিন বিষয়ে মক্কী সূরায় বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। বলা হয়েছে, তোমরা যাকে রব্ব হিসাবে পূজা করছো, সেও ঐ আল্লাহর দাস এবং ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ঐ আল্লাহরই মুখাপেক্ষী। সুতরাং, তাদেরকে রব্ব হিসাবে গ্রহণ করার কোনই প্রয়োজন নেই, রব্ব হিসাবে গ্রহণ করো তাঁকেই যিনি তোমাদেরকে জমাটবাঁধা রক্ত থেকে সৃষ্টি করেছেন; জ্ঞান দান করেছেন এবং তোমাদের যাবতীয় প্রয়োজন যিনি পূরণ করছেন। তোমাদের সমস্ত কাজে তাকেই রব্ব হিসাবে ঘোষনা করবে, একমাত্র দাসত্ব লাভের যোগ্য বলে বিবেচনা করবে এবং একমাত্র আইনদাতা হিসাবে গ্রহণ করবে। মহান আল্লাহ প্রথম অবতীর্ণকৃত বাণীতে তাঁর নবীকে আদেশ দিলেন, আমিই যে শ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র রব্ব-এ কথার ঘোষনা করে দাও। তুমি কোন দ্বিধা করোনা। তোমার রব্ব-এর শ্রেষ্ঠত্বের কথা ঘোষনা করো এবং কোন শক্তিকে দেখে ভয় করো না। কেননা, সমস্ত শক্তির শ্রেষ্ঠ শক্তি তোমার সাথে রয়েছে। তোমার রব্ব-এর শক্তির সামনে কোন শক্তিই শ্রেষ্ঠ নয়। তুমি তাদের সামনে এ কথা স্পষ্ট করে বলে দাও, তুমি যে কাজ শুরু করছো, এ কাজের গতি কেউ রুদ্ধ করতে পারবে না। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে কোথায় কি কাজ করতে আদেশ করলেন, তা বিশ্লেষণ করলে আমাদের সামনে একটা দিক পরিষ্কার হয়ে যায় যে, গোটা পৃথিবীও যদি সত্যের বাহকের বিরুদ্ধে চলে যায় তবুও সত্যের ঘোষনা দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা যাবে না। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যে ঘোষনা দিতে আদেশ করলেন, সেই ঘোষনার বিপরীত অবস্থা বিরাজ করছিল তদানীন্তন পৃথিবীতে। রাসূল যে সমাজে উপস্থিত ছিলেন সে সমাজ এই ঘোষনা শুনতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।

        এই ঘোষনা দেয়ার সাথে সাথে রাসূলকে তাঁর আপনজনেরাই যে বন্য হায়েনার মত ঘীরে ধরবে এতেও কোন সন্দেহ ছিল না। যারা রব্ব-এর দাবী নিয়ে সে সমাজে দীর্ঘকাল ব্যাপী নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত রেখেছিল, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছিল, কা'বাঘরসহ নিজেদের ঘরে ঘরে মূর্তিকে রব্ব বানিয়ে তাদের পূজা অর্চনা করছিল, তারা রাসূলের এ ঘোষনা শুনেই রাসূল একজন সৎ এবং সুন্দর চরিত্রের লোক হবার কারণে তাঁর ঘোষনাকে তারা স্বাগত জানাবে অবস্থা এমন ছিল না। বরং এ ঘোষনা দেয়ার সাথে সাথেই বিপদ মসিবতের পাহাড় নিজের ওপরে আপতিত হবে, আপন আত্মীয়-স্বজন প্রাণের শত্রুতে পরিণত হবে, তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে, তাঁকে হত্যা করার জন্য সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠবে-এটাই ছিল প্রকৃত পরিস্থিতি।

        মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে কোন কথা ঘোষনা করতে আদেশ করলেন, সে কথার যে কি তাৎপর্য এ কথা উপলব্ধি করার মত জ্ঞান রাসূলকে দেয়া হয়েছিল, রাসূল মহান আল্লাহর আদেশের তাৎপর্য অনুধাবন করবেন, তিনি ভীতিগ্রস্থ হতে পারেন, চিন্তিত হতে পারেন, এ কারণে ঐ আয়াতের মধ্যে রাসূলকে এ কথাও বুঝিয়ে দেয়া হলো, ভয় বা চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা তোমার রব্ব-ই শ্রেষ্ঠ, তোমার রব্ব-এর শ্রেষ্ঠত্বের সামনে অন্য সমস্ত শক্তি ধূলিকণার মতই উড়ে যাবে। তোমার রব্ব রয়েছেন তোমার সাথে, তোমাকে ইসলামী আন্দোলনের উত্তপ্ত ময়দানে এগিয়ে দিয়ে তোমার রব্ব নীরব থাকবেন না। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন শুরু করে দাও, তোমাকে সহযোগিতা করার দায়িত্ব আমার।

        এই সুক্ষ্ম কথাগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপলব্ধি করেছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে যে উৎসাহ উদ্দীপনা দান করেছিলেন ঐ আয়াতে তা রাসূল অনুভব করেছিলেন বলেই তিনি তাঁর আন্দোলনের গতি পথে কোন শক্তিকে সামান্যতম দেননি। মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব রাসূল উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তিনি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম একাকী গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।

        রাসূলের আদর্শ নিয়ে আজো যারা ময়দানে কাজ করতে অগ্রসর হবেন প্রথমে তাদেরকে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা অর্জন করতে হবে, তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের চিত্র নিজের মনে অঙ্কন করতে হবে। তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তিকেই আর শক্তি বলে মনে হবে না। এরপরে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বললেন, 'আপনি নিজের পোষাক-পরিচ্ছদ পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখুন।' বিজ্ঞ তাফসীর কারগণ পবিত্র কোরআনের এই আয়াতের ব্যাপক তাফসীর করেছেন। প্রকৃতপক্ষে উক্ত আয়াতের মর্মও বড় ব্যাপক। ছোট একটি কথা দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালা ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে একটা অর্থ হলো, পরিধেয় পোষাক পাক-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখা।

        পোষাক মানুষের মনের ওপরে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে এতে কোন সন্দেহ নেই। এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর বিশেষ পোষাক নির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষকগণ বলেছেন, পোষাক-পরিচ্ছেদের পবিত্রতা এবং আত্মার পবিত্রতা অবিচ্ছিন্ন। একটার সাথে আরেকটা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পবিত্র রুচি সম্পন্ন কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয় সে পুঁতিগন্ধময় কোন খাদ্য তাঁর মুখ গহ্বর দিয়ে দেহে প্রবেশ করাবে। সুতরাং, কোন পবিত্র আত্মার পক্ষেও সম্ভব নয় সে কোন অপবিত্র দেহের ভেতরে বাস করবে। কোন পবিত্র দেহের পক্ষেও সম্ভব নয় সে নিজেকে অপবিত্র অপরিচ্ছন্ন পোষাকে আবৃত রাখবে। মহান আল্লাহ পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন। তিনি অপবিত্রতা প্রশ্রয় দেননা। এ কারণে তিনি তাঁর রাসূলকে আদেশ করলেন, তোমার পোষাক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখবে। মহান আল্লাহর এ কথা থেকে এটা ধারণা করার কোন অবকাশ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বোধহয় ইতিপূর্বে অপবিত্র অপরিচ্ছন্ন পোষাকে থাকতেন। পবিত্রতা সম্পর্কে তাঁর কোন জ্ঞান ছিল না।

        প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন জন্মগতভাবেই পবিত্র। মহান আল্লাহ তাঁকে পবিত্র রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তাঁর জ্ঞানের জগতে পবিত্রতা সম্পর্কে জ্ঞানদান করেছিলেন। আরবী 'তাহহের বা তাহারাত' শব্দের অর্থ শুধু বাহ্যিক পবিত্রতা নয়। অন্তরের কলুষতা দূর করাকেও বোঝায়। পবিত্রতা বা তাহারাতকে কোরআন যে অর্থে উপস্থাপন করেছে, পৃথিবীর এমন কোন ভাষা নেই যে, সে ভাষার একটি শব্দ তাহারাতের সমার্থক হতে পারে বা পবিত্রতার ব্যাপক ধারণা পেশ করতে পারে।

        পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করাও পবিত্রতা এবং পাপের ভেতরে নিজেকে জড়িত করাকে অপবিত্রতা বলা হয়েছে। কোন অন্যায় কাজ বা মিথ্যা কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখার অর্থও হলো পবিত্রতা। মিথ্যা কথা বলা অপবিত্রতা। এভাবে যাবতীয় অন্যায় অনাচার, পাপাচার, অত্যাচার, অপরিচ্ছন্নতা, মিথ্যা, চিন্তার জগতে অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকাকেই পবিত্রতা বলা হয়েছে। দেহ এবং দেহের পোষাক পবিত্র-এটা কোন পবিত্রতাই নয়। চিন্তার জগৎ হতে যাবতীয় অপরিচ্ছন্নতা এবং অপবিত্রতা দূর করতে হবে। অজ্ঞানতা তথা মূর্খতাও এক ধরণের অপবিত্রতা। এ সমস্ত অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকার নামই হলো পবিত্র কোরআনের ভাষায় তাহারাত।

        ইসলাম আত্মা এবং দেহের পবিত্রতার দাবী করে। সে সময়ে মানুষ জ্ঞানের দিক থেকে, চিন্তার দিক থেকে, চরিত্রের দিক থেকে; স্বভাবের দিক থেকে, নেতৃত্বের দিক থেকে, কথার দিক থেকে তথা সর্বস্তরে অপবিত্রতায় নিমজ্জিত ছিল। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে আদেশ করলেন, মানব সমাজ থেকে এ সমস্ত অপবিত্রতা দূর করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা গ্রহণ করো। তুমি এই মহান কাজ করছো, এ জন্য যেন তুমি ধারণা করোনা, তুমি তাদের ওপরে দয়া করছো। বরং এটাই তোমার দায়িত্ব, এই দায়িত্ব দিয়েই তোমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। আবার এ ধারণাও করো না যে, এ কাজ করে তুমি তোমার রব্ব-এর কল্যাণ করছো। বরং তুমি তোমার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করছো। যে দায়িত্ব তুমি পালন করছো এ কাজ সহজ নয়। তুমি তোমার প্রতিটি পদক্ষেপে বাধাগ্রস্থ হবে। তোমার সাথে অহেতুক শত্রুতা করা হবে। তোমাকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়া হবে; হত্যা করার প্রচেষ্টা করা হবে। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তোমার বিরুদ্ধে চলে যাবে। তুমি নানা ধরণের মিথ্যা অপবাদের, ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হবে।

        তোমার বাড়ি-ঘর, সহায় সম্পদ বিনষ্ট হবে; আহার নিদ্রায় কষ্ট পাবে। তোমার উপার্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তোমার নামে কুৎসা ছড়িয়ে দেয়া হবে। বিরোধী শক্তি তোমাকে অবরোধ করবে; দেহের রক্ত ঝরবে। তোমার সামনে নানা ধরণের লোভ-লালসা দেখানো হবে। বিভিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করা থেকে তোমাকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু তোমার কাজে তুমি থাকবে অটল অবিচল। তোমাকে এমন ধৈর্য ধারণ করতে হবে, যে ধৈর্যের শেষ সীমা-শেষ পর্যায় বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

        ওহীর সূচনাতেই মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে এ কথা স্পষ্ট করে দিলেন যে, কি কাজের জন্য তোমাকে বিশ্বনবী হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে এবং কেন করা হয়েছে। এই কাজের সূচনা কিভাবে করা হবে। এই কাজের কারণে কোন মানুষের কাছে এ কথা বলা যাবে না যে, আমি তোমাদের হেদায়াতের জন্য এসেছি; তোমাদের কল্যাণ করছি, তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে ঈমান যখন আনলে তাহলে এবার আমাকে আমার বিনিময় প্রদান করো।

        এ ধরনের কোন আশা মনে পোষন করা যাবেনা, এ কথা সত্যের প্রচারকদেরকে বলে দেয়া হলো। এ কাজ করতে গেলে কি ধরনের বাধা আসবে তাও স্পষ্ট করে বলে দিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে বলা হলো। এভাবে আল্লাহ তাঁর নবীকে দায়িত্ব দিলেন এবং কিভাবে তিনি কাজ করবেন, কার্য ক্ষেত্রে যে সব অসুবিধা দেখা দিত তা দূর করার পথের সন্ধান দিতে থাকলেন। অর্থাৎ ক্রমাগতভাবে ওহী অবতীর্ণ হতে থাকলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওহী ধারণ করার ক্ষমতা ক্রমশঃ অর্জন করলেন। হযরত জিবরাঈল আলাইহিস্ সালাম যে সময়ে ওহী তাঁর কাছে আবৃত্তি করতেন তিনিও তাঁর সাথে দ্রুত আবৃত্তি করতে থাকেন। প্রিয় বন্ধুর এই অস্থিরতা-ব্যস্ততা মহান আল্লাহর কাছে সহ্য হলো না। তিনি তাঁর রাসূলকে বললেন-

وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَى إِلَيْكَ وَحْيُهِ وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا -

        কোরআন পড়ার ব্যাপারে দ্রুততা অবলম্বন করো না যতক্ষণ না তোমার প্রতি তার ওহী পূর্ণ হয়ে যায় এবং দোয়া করো, হে আমার রব্ব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। (সূরা ত্বা-হা)

        আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে জানিয়ে দিলেন, আমার ওহী তোমার স্মৃতিতে অম্লান রাখা আমার * দায়িত্ব। তুমি শুধু তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকো। আল্লাহ বলেন-

لا تُحَرِكَ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْنَهُ فَإِذَا قرآنَهُ فَاتَّبِعْ قُرَأْنَهُ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ

এই ওহী অত্যন্ত দ্রুত মুখস্থ করে নেয়ার জন্য তোমার জিহ্বা দ্রুত সঞ্চালন করো না। তা মুখস্থ করিয়ে দেয়া ও পড়িয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং, আমি যখন (আমার পক্ষ থেকে আমার ফেরেস্তা) পড়তে থাকি, তখন তুমি তার পাঠকে মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে। তারপর এর তাৎপর্য বুঝিয়ে দেয়াও আমারই দায়িত্ব। (সূরা কিয়ামাহ্-১৬-১৯)

Post a Comment

0 Comments