কোরআন দুর্বোধ্য ভাষায় অবতীর্ণ হয়নি

        পৃথিবীতে মানব জাতির হেদায়াতের জন্য যত নবী ও রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে, তাঁকে সেই জাতির মধ্য থেকেই নির্বাচিত করা হয়েছে। নবী ও রাসূলদের ইতিহাসে কখনো এমনটি দেখা যায়নি যে, নবী এক ভাষায় কথা বলেন আর তিনি যে জাতিকে হেদায়াতের জন্য আগমন করেছেন, সে জাতি ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। এমন যদি হতো তাহলে সে জাতি এই অজুহাত সৃষ্টি করতো যে, 'এমন একজন ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের হেদায়াতকারী রূপে প্রেরণ করেছেন, যাঁর ভাষ্যর সাথে আমরা পরিচিত নই।' জাতি যে ভাষায় কথা বলেছে, তাঁদের জন্য প্রেরিত নবী ও রাসূলও সেই একই ভাষায় কথা বলেছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ

        আমি আমার বাণী পৌঁছানোর জন্য যখনই কোন রাসূল প্রেরণ করেছি, সে নিজ জাতির জনগণের ভাষায়ই পয়গাম পৌছিয়েছে, যেন তিনি তাদেরকে অত্যন্ত ভালোভাবে স্পষ্টরূপে বুঝাতে সক্ষম হয়। (সূরা ইবরাহীম-৪)

        বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে এ পৃথিবীতে যত নবী ও রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল, তাঁরা ছিলেন জাতি ভিত্তিক বা দেশ ভিত্তিক নবী। আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলেন বিশ্বনবী। তিনি সমস্ত যুগের, কালের সমস্ত দেশের তথা গোটা মানবতার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর আদর্শ বিশেষ কোন জাতি গোষ্ঠী বা দেশের জন্য নয়-তাঁর আদর্শ গোটা পৃথিবীবাসীর জন্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। রাসুল ছিলেন আরবী ভাষী এবং তিনি যে জনগোষ্ঠীর ভেতরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তারাও ছিলেন আরবী ভাষী। আরবী ভাষাতেই তাঁর কাছে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা সূরা মারিয়ামে তাঁর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলেন-

فَإِنَّمَا يَسْرْتُهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَبِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنْذِرَبِهِ قَوْ مَالدًا

        হে রাসূল! এ বাণীকে আমি সহজ করে তোমার ভাষায় এ জন্য অবতীর্ণ করেছি যেন তুমি মুত্তাকিদেরকে সুসংবাদ দিতে ও সীমালংঘনকারীদেরকে ভীতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হও।

        কোরআনের বক্তব্যে বিন্দুমাত্র দুর্বোধ্যতা নেই। এ কিতাব যা বলে তা অত্যন্ত সহজ সরল ও স্পষ্টভাবে বলে দেয়। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

تلك أيتُ الكِتَابِ الْمُبِيْنِ إِنَّا أَنْزَلْنَهُ قُرْ نَا عَرَبِنَا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

        এটা সেই কিতাবের আয়াত, যা নিজের বক্তব্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে। আমি একে কোরআন রূপে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি। (সূরা ইউসুফ-১-২)

        আরবী ভাষাভাষীদের কাছে অনারব কোন ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হলে তারা কোরআন বিরোধিতার আরেকটি অস্ত্র লাভ করতো এবং সত্য গ্রহণ না করার অজুহাত হিসাবে দাবী করতো, আমাদের বোধগম্য ভাষায় কিতাব নিয়ে এলে আমরা তা বুঝতাম এবং গ্রহণ করতে পারতাম। এ জন্য আরবী ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করে এ কথা তাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের মাতৃভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে-যেন তোমরা কোরআনের শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করে পৃথিবীর মানুষদেরকেও এ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য দাওয়াত পেশ করতে সক্ষম হও। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَكَذَالِكَ أَنْزَلْتُهُ قُرأَنَا عَرَبِيًّا وَصَرِّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ

        হে রাসুল! এভাবে আমি একে আরবী কোরআন বানিয়ে অবতীর্ণ করেছি এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সতর্কবাণী করেছি। (সূরা ত্বা-হা-১১৩)

        এ কিতাব আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হলেও এর নিজস্ব কতকগুলো পরিভাষা নির্দিষ্ট রয়েছে। অসংখ্য শব্দকে তার মূল আভিধানিক অর্থ থেকে স্থানান্তরিত করে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেকগুলো শব্দ তাতে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা এমন কোন জটিলতা ও বক্রতা দিয়ে এ কোরআন প্রেরণ করেনি যে, তা অনুধাবন করতে মানুষের অসুবিধা হবে। বরং এ কোরআনে পরিষ্কারভাবে সহজ-সরল কথা উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিটি মানুষ অবগত হতে পারে, এ কিতার কোন কোন মতাদর্শ, মতবাদ, নিয়ম-পদ্ধতিকে ভ্রান্ত বলে ঘোষণা দেয় এবং কেন দেয়। কোন কোন জিনিসকে সঠিক বলে এবং কিসের ভিত্তিতে বলে। মানুষকে এ কিতাব কিসের প্রতি স্বীকৃতি দিতে বলে এবং কিসের প্রতি অস্বীকৃতি দিতে বলে। এ কিতাব কোন কাজের আদেশ দেয় এবং কোন কাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَذَا الْقُرْآنِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ - قُرأَنَا عَرَبِيًّا غَيْرَذِي عِوَجٍ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

        এ কোরআনের ভেতরে আমি মানুষের জন্য নানা ধরনের উপমা পেশ করেছি যেন তারা সাবধান হয়ে যায়, আরবী ভাষার কোরআন-যাতে কোন বক্রতা নেই। যাতে তারা নিকৃষ্ট পরিণাম থেকে রক্ষা পায়। (সূরা যুমার-২৭-২৮)

        এ কিতাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট, এর ভেতরে না বুঝার মতো কোন জটিল বিষয়ের অবতারণা করা হয়নি। আল্লাহ বলেন-

تَنْزِيلٌ مِّنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ كِتَابٌ فُصِّلَتْ أَيْتُهُ قُرَأْنَا عَرَبِيًّا لقَوْمٍ يَعْلَمُونَ - بَشِيرًا وَنَذِيرًا - فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ

        এটা পরম দাতা ও মেহেরবান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা জিনিস। এটি এমন এক গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। আরবী ভাষার কোরআন। সেসব লোকদের জন্য যারা জ্ঞানের অধিকারী, সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী। (সূরা হা-মীম-সাজদাহ-২-৪)

        কোন আদর্শ গ্রহণ করার ইচ্ছা না থাকলে তা অস্বীকার করার জন্য অজুহাতের অভাব হয়না। নানা ধরনের দোষ-ত্রুটি, বক্রতা ও অজুহাত প্রদর্শন করতে থাকে এক শ্রেণীর মানুষ। রাসূলের ওপরে তারা ঈমান আনবে না বিধায় তারা বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দাঁড় করাতো। রাসূলকে তো নানা মিথ্যা বিশেষণে বিশেষিত করলো, সেই সাথে তারা এ দাবী করেছিল যে, 'কি অদ্ভুত ব্যাপার। তিনি নিজে আরবী ভাষী, আর কোরআনও নিয়ে এসেছেন আরবী ভাষায়। তিনি যদি অন্য কোন ভাষায় কোরআন নিয়ে আসতেন, তাহলে বুঝতে পারতাম, তিনি সত্যই আল্লাহর রাসূল। আরবী তাঁর মাতৃভাষা, তিনি সেই ভাষাতেই কোরআন পেশ করছেন, তাহলে এ কথা কি করে বিশ্বাস করা যায় যে, তিনি এ কোরআন নিজে রচনা করেননি? কোরআনকে তখনই আল্লাহর বাণী হিসাবে বিশ্বাস করা যেত, যদি তা আরবের বাইরের কোন ভাষায় নিয়ে আসা হতো এবং তিনি তা অনর্গল পাঠ করে আমাদেরকে শুনাতেন।

        আসলে এরা কখনো ঈমান আনতো না, এ জন্যই এরা অজুহাত সৃষ্টি করেছে। এদের সামনে যদি অন্য কোন ভাষাতেই কোরআন আসতো, তখন এরা বলতো, এমন কোরআন আমাদের কাছে পেশ করা হলো যে, আমরা তার ভাষাই বুঝি না। আমরা যা বুঝি না, তাই আমাদের সামনে পেশ করে বলা হচ্ছে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। আসলে এটা আল্লাহ অবতীর্ণ করেননি। এদের এসব কথার জবাবে আল্লাহ বলেন-

وَلَوْ جَعَلْنَهُ قُرَأْنَا أَعْجَمِيًّا لَقَالُوا لَوْلا فُصِّلَتْ أَيْتُهُ ، أَعْجَمِيٌّ وَعَرَبِي

        আমি যদি একে অনারব কোরআন বানিয়ে প্রেরণ করতাম তাহলে এসব লোক বলতো, এর আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি কেন? কি আশ্চর্য কথা, অনারব বাণীর শ্রোতা আরবী ভাষাভাষী। (সূরা হা-মীম-সাজদাহ-৪8)

        আরবী ভাষায় এ কোরআন এ জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে যে, কোরআন আরবী ভাষাভাষীদের মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর ভাষার ব্যাপারেও তখন সেই জনগোষ্ঠী উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছিল। এ জন্য তাদের বোধগম্য ভাষায় তা অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যেন তারা এ কিতাব সম্পর্কে গবেষণা করে দেখতে পারে, এ কিতাব কি কোন মানুষের রচনা করা না. আল্লাহর রাণী। কোরআনের এসব আয়াত পাঠ করে অনেকেই যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, কোরআন যেহেতু আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তা আরববাসীর জন্যই প্রযোজ্য। আমাদের জন্য তা অনুসরণের কোন প্রয়োজন নেই। এসব যুক্তি হলো খোঁড়া যুক্তি। কোন আঁদর্শ গ্রহণ করা ও বর্জন করার ক্ষেত্রে ভাষা তার মাধ্যম হতে পারে না। এটাই সর্বসম্মত প্রথাসিদ্ধ নিয়ম যে, একটি আদর্শ বিশেষ কোন একটি ভাষায় তা রচিত হবার পরে প্রথমে সে ভাষাভাষীদের মধ্যে তা প্রচারিত হবে। সেসব লোক তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করে সে আদর্শ পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মধ্যে অনুবাদকৃত ভাষায় প্রচার শুরু করবে।

        পৃথিবীর সমস্ত আদর্শের ক্ষেত্রে এই নিয়মই অনুসরণ করা হয়েছে। পুঁজিবাদ রচিত হয়েছে ইংরেজী ভাষায়, সমাজতন্ত্র রচিত হয়েছে জার্মান ভাষায়, বর্তমান কালের যাবতীয় নীতি পদ্ধতি  ও বৈজ্ঞানিক দর্শন রচিত হচ্ছে ইংরেজী ভাষায়। পরে তা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহর কোরআনও একই নিয়মে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং- এই ধারা চলতে থাকবে। অন্যান্য আদর্শ এই নিয়মে প্রচারিত হওয়ার ও অনুসরণ করার ব্যাপারে যদি কোন আপত্তি উত্থাপন করা না হয়, তাহলে কোরআনের ব্যাপারে কেন আপত্তি উত্থাপন করা হবে? আরবী কোরআন আরব জাতির জন্যই প্রযোজ্য-এ দাবী যারা করে, তারা বিশেষ এক দুরাভিসন্ধি গোপন করেই এ ধরনের অমূলক দাবী করে।

Post a Comment

0 Comments