খানায়ে কা'বা ও মক্কা মুয়াযযমার ফজীলতঃ
হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন যে, প্রতি বছর অন্ততঃ ছয় লক্ষ লোক খানায়ে কা'বার হজ্জ্ব করবে। যদি কোন বছর এ সংখ্যার চেয়ে লোক কম হয়ে যায় তাহলে তিনি তা' ফিরেশতাদের দ্বারা পূর্ণ করবেন। রোজ কিয়ামতে খানায়ে কা'বা এক নব বধূর মত হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে। দুনিয়ায় যারা হজ্জ আদায় করেছে বা হজ্জ আদায় করবে, তারা খানায়ে কা'বার গেলাফের সাথে ঝুলে থাকবে। আর কখনও কখনও বা তার চার পাশে ঘুরে বেড়াবে। এক সময় খানায়ে কা'বা যখন বেহেশতে প্রবেশ করবে, সাথে সাথে হাজীরাও বেহেশতে প্রবিষ্ট হবে। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, হাজরে আসওয়াদ অর্থাৎ কা'বাগৃহের কাল পাথর বেহেশতের ইয়াকুতসমূহের অন্যতম। রোজ কিয়ামতে আল্লাহ এ পাথরকে দুটো চক্ষু দান করবে, তাকে একটি জিহ্বাও দেয়া হবে' যার সাহায্যে হাজরে আসওয়াদ সেদিন সেই ব্যক্তির পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, তাকে দুনিয়ায় একান্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে চুম্বন করেছিল। হুযুরে পাক (দঃ) এজন্যই হাজরে আসওয়াদকে পুনঃ পুনঃ চুম্বন করতেন। এরূপ বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি এর উপর সিজদাহও করতেন। যখন হুযুর (দঃ) সওয়ারীতে আরোহণ করে খানায়ে কা'বা তাওয়াফ করতেন তখন তিনি নিজের ছড়ির অগ্রভাগ এ পাথরে স্পর্শ করিয়ে তাতে চুম্বন করতেন। হযরত ওমর (রাঃ) একবার এ পাথরটিকে চুম্বন করার পর বললেন, 'হে পাথর। আমি জানি তুমি একটি পাথর ব্যতীত অন্য কিছু নও। কারও কোনরূপ ক্ষতি করার সামর্থ্য তোমার নেই। তাই যদি আমি হুযুরে পাক (দঃ) কে তোমাকে সিজদাহ করতে না দেখতাম তাহলে তোমাকে আমি কখনই চুম্বন করতাম না। এ কথা বলে তিনি উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন শুরু করলেন। এরপর তিনি পিছনে ফিরে শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ)কে দেখতে পেয়ে বললেন, হে হাসানের পিতা: এটা কান্নার স্থান। এখানে মানুষের দোয়া কবুল হয়। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, হে আমীরুল মু'মিনীন। এই পাথর মানুষের ক্ষতি ও উপকার করে থাকে। হযরত ওমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তা কিভাবে? হযরত আলী (রাঃ) জবাবে বললেন, আল্লাহ তায়ালা যখন বনী আদমের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন তখন তিনি এক লিপি লিখে এই পাথরকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। সুতরাং এই পাথর ঈমানদারদের জন্য অঙ্গীকার পূর্ণ করার এবং বে-ঈমান তাদের জন্য অঙ্গীকার ভঙ্গ করার সাক্ষ্য দিবে। এই কাল পাথরকে চুম্বন করার সময় নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করা হয়:
আল্লাহুম্মা ঈমানাম বিকা ওয়া তাছদীক্বাম বিকিতাবিকা ওয়া অফাআম বি আহাদিকা।
অর্থাৎ হে মাবুদ! আমি একাজ করছি তোমার প্রতি ঈমানের কারণে এবং তোমার কিতাব সত্যায়ন করা ও তোমার অঙ্গীকার পূর্ণ করার জন্য। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, পবিত্র মক্কায় একদিন রোযা রাখা একলাখ রোযার তুল্য, এক দেরহাম দান করা এক লাখ দেরহাম দানের তুল্য। ঠিক এইভাবে প্রত্যেকটি নেক আমল এক লাখ নেক আমলের তুল্য। বর্ণিত আছে যে, তাওয়াফের সাত চক্করের একটি চক্কর এক ওমরার তুল্য এবং তিনিট ওমরাহ এক হজ্জ্বের তুল্য। কোন হাদীসে এরশাদ হয়েছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেন, মাহে রমযানে একটি ওমরাহ করা আমার সাথে একটি হজ্জ করার তুল্য। অন্য হাদীসে এরশাদ হয়েছে যে, রোজ কিয়ামতে সর্বপ্রথম আমার কবরের মাটি বিদীর্ণ হবে। তারপর উঠে আমি বাকী নামককবরস্থানে চলে যাব। তথাকার কবরবাসীদের হাশর আমার সাথেই হবে। এরপর আমি মক্কাবাসীদের কাছে যাব এবং আমার হাশর দুই হেরেমের মাঝখানে হবে। অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে যে, হযরত আদম (আঃ) যখন হজ্জ্বের কাজ-কর্মগুল্যে সম্পন্ন করলেন, তখন ফিরেশতারা এসে তাঁকে বললেন, হে আদম। আপনার হজ্জ্ব আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে। আমরা এ গৃহের হজ্জ দুহাজার বছর পূর্বে করেছি। অন্য বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রতি রাত্রে দুনিয়াবাসীদের প্রতি নজর করেন। সবার আগে হেরেমবাসীদেরকে এবং তাদের মধ্যে খানায়ে কা'বার মসজিদের মধ্যকার লোকদেরকে দেখেন। এই মুহূর্তে যাকে তিনি তাওয়াফ করতে দেখেন তাকে ক্ষমা করে দেন। যাকে নামায পড়তে দেখেন তাকেও ক্ষমা করে দেন। যাকে কিবলামুখী দণ্ডায়মান দেখেন তারও মার্জনা নছীব করেন। বর্ণিত আছে যে, প্রত্যহ সূর্যাস্তকালে অবশ্যই একজন আবদাল খানায়ে কা'বার তাওয়াফ করেন এবং প্রত্যহ প্রত্যুষে একজন আওতাদ তা' তাওয়াফ করেন। এভাবে তাওয়াফ জারী না থাকলে খানায়ে কা'বা দুনিয়ার পৃষ্ঠ থেকে উঠে যাওয়ার কারণ হবে। একদিন মানুষ প্রত্যুষে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখবে, খানায়ে কা'বার স্থানটি শূণ্য পড়ে আছে। সেখানে কা'বা গৃহের কোন নাম-নিশানাও নেই। এটা ঠিক তখন হবে যখন একাধারে সাত বছর পর্যন্ত এ ধরনের কেউ তাওয়াফ করার মত বাকী থাকবে না।
তারপর কুরআন পাকের অক্ষরসমূহ মাছহাফ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। একদা মানুষ ঘুম থেকে উঠে দেখবে যে, কুরআনে পাকের পাতাগুলো অক্ষরহীন হয়ে গেছে। এর কিছু পরেই মানুষের মন থেকেও কুরআনকে মিটিয়ে দেয়া হবে। যার ফলে কুরআনে পাকের একটি শব্দও কারও মনে থাকবে না। ঠিক এমনি অবস্থায় মানুষ কবিতা, কিচ্ছা-কাহিনী গান-গীতি ও রাগ-রাগিনীতে মত্ত হয়ে থাকবে। এক সময় দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটে যাবে। কিছু পরেই হযরত ঈসা (আঃ) দুনিয়ায় অবতীর্ণ হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলবেন। রোজ কিয়ামত তখন এত নিকটবর্তী হয়ে পড়বে যে, গর্ভধারিণীর গর্ভ দেখে মানুষ মনে করে যে, এখন কিছুদিনের মধ্যেইত সে সন্তান প্রসব করবে। কোন এক হাদীসে আছে যে, আল্লাহর এ গৃহকে তুলে নেয়ার পূর্বে যত বেশী পার, এর তাওয়াফ করে নাও। কারণ, জেনে রাখ, ইতঃপূর্বে এ গৃহ দু'দুবার বিধ্বস্ত হয়েছিল। তৃতীয়বার একে দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য তুলে নেয়া হবে। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন আমার এ দুনিয়াকে ধ্বংস করার ইচ্ছে হবে তখন প্রথম আমি আমার গৃহ থেকেই তা' শুরু করব। সর্বপ্রথম আমি আমার গৃহ বিলীন করে তারপর দুনিয়াকে ধ্বংস করে দেব।
পবিত্র মক্কায় অবস্থানঃ সতর্ক ও সাবধানী ওলামায়ে কিরাম তিনটি কারণে বেশী দিন মক্কায় অবস্থান করা ঠিক নয় বলেছেন। প্রথম কারণ হল, বেশী দিন মক্কায় অবস্থানের ফলে তার প্রতি মানুষের মনে বিতৃষ্ণ ভাব উদয় হতে পারে। যার ফলে মক্কার মর্যাদাও অন্যান্য শহরের মত হয়ে যেতে পারে, ওলামাগণ এ আশঙ্কা করেন। হযরত ওমর (রাঃ) একারণেই হজ্জ সমাধা হয়ে যাওয়ার পর হাজীগণকে বলতেন, হে হাজীগণ। তোমরা যারা ইয়ামেনের অধিবাসী রয়েছ তারা ইয়ামেন চলে যাও; ইরাকবাসীরা ইরাক গমন কর, যারা সিরিয়ার অধিবাসী আছ তারা সিরিয়ার পথ ধর। এজন্যেই তিনি অধিক তাওয়াফ করা বন্ধ করে দিয়ে মানুষ যথাশীঘ্র মক্কাথেকে বিদায় করার ইচ্ছে প্রকাশ করতেন। তিনি বলতেন, আমার আশঙ্কা হয়, ক্রমে ক্রমে মানুষ এ পবিত্র গৃহকে নিজেদের বাড়ী-ঘরের মত করে না নেয়। এরূপ হয়ে গেলে নিশ্চয়ই। মক্কা এবং পানায়ে কা'বার সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকবে না।
দ্বিতীয় কারণ হল, দূরে অবস্থান করলে অভীষ্টস্থলের প্রতি ক্রমান্বয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং তথায় পৌছার জন্য ব্যগ্রতার সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তায়ালা খানায়ে কা'বাকে সম্মেলন কেন্দ্র এবং শান্তির স্থল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর বিজ্ঞদের মতে, যেখানে বার বার আসা হয় তাকে শান্তি ও সম্মানিতস্থল বলে আখ্যা দেয়া হয়। একজন বুযর্গ বলেছেন যে, যদি তুমি দূরে অবস্থান কর আর তোমার মন মক্কার জন্য উৎসুক থাকে' তবে সেটা মক্কায় অবস্থান করে তার প্রতি বিতৃষ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থেকে অনেক উত্তম। অন্য একজন বুষর্গের মতে, যারা খোরাসানে বসবাস করে (যদি তারা মক্কার প্রতি উৎসুক এবং অ্যগ্রহান্বিত থাকে তবে) তারা খানায়ে কা'বা তাওয়াফকারীদের চেয়ে তার অনেক নিকটবর্তী। বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর কোন কোন নৈকট্যশীল এমন ব্যক্তি রয়েছেন যে, স্বয়ং কা'বা গৃহ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ঐ সকল ব্যক্তির তাওয়াফ করে।
তৃতীয় কারণ হল, মক্কা মুয়াযযমার বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্যের কারণে তথায় গুনাহ করলে আল্লাহর অধিক ক্রোধে পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন যে, একদা আমি হাতীমে নামায পড়তেছিলাম। সহসা কা'বার প্রাচীর ও পর্দার মধ্য থেকে আমি এক অদৃশ্য আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন খোদ কা'বা গৃহ স্পষ্ট ভাষায় বলছে, হে জিব্রাইল। আমার চার পাশে তাওয়াফকারীরা যে সব বাজে অজিফা কালাম পাঠ করে থাকে তাতে আমার ভারী দুঃখ হয়। আমি আমার এই অভিযোগ প্রথম আল্লাহর কাছে করলাম, তারপর একথা তোমার কাছেও বললাম। যদি তারা একাজ থেকে বিরত না হয় তবে আমি নিজে নিজেই এমন এক ঝাকুনী দেব যে, তাতে আমার প্রতিটি পাথর সেই সেই পাহাড়ে চলে যাবে যে যে পাহাড় থেকে সেগুলোকে আনা হয়েছিল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, দুনিয়ায় শুধু মক্কা ব্যতীত এমন কোন শহর নেই যেখানে কেবল পাপ ইচ্ছে করলেই আমলনামায় পাপ লিখা হয়ে যায়। এই কথা বলে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেন।
ওয়ামাই ইউরিদ ফীহি বিইলহাদিম বি জুলমিন নুষিকুহু মিন আযাবিন আলীম।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি এখানে অসৎ খেয়াল বশতঃ বাঁকা পথে চলার ইচ্ছে করে আমি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাব। আয়াতে বুঝা গেল যে, পাপ করার ইচ্ছের উপরেই শাস্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। বর্ণিত আছে যে, মক্কা মুয়াযযমায় যেমন সৎকাজ দ্বিগুণ হয় ঠিক তেমন অসৎ কাজও দ্বিগুণ হয়ে যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলতেন, মক্কায় খাদ্যশস্য ক্রয় করে অধিক মূল্যের আশায় গুদামজাত করে রাখা হরম শরীফ থেকে আল্লাহর। সঙ্গে বিদ্রোহ করার শামিল। তিনি আরও বলেছেন, যদি আমি অন্যত্র বসে সত্তরটি গুনাহ করি তবে তা' আমার পক্ষে মক্কায় বসে একট গুনাহ করার চেয়ে উত্তম। এ ভয়ের কারণেই কোন কোন মক্কায় অবস্থানকারী এই অভ্যাস করে নিয়েছিলেন যে, তারা মক্কায় প্রস্রাব-পায়খানা পর্যন্ত করতেন না। এর প্রয়োজন দেখা দিলে হরমের থেকে বাইরে চলে যেতেন। এমনও শুনা যায় এভাবে মক্কায় একাধারে বেশী দিন থাকা নিষিদ্ধ হওয়ার। মাকরুহ হওয়ার আলিম তথ্যায় গৃহ ভাড়া করা মাকরূহ মনে করতেন। মক্কায় অবস্থান কর। কারণ হল, মানুষ সেই পবিত্র স্থানের যথাযথ হক আদায় করায় অক্ষম হয়ে মক্কায় বেশী দিন অবস্থান না করা উত্তম বলার অর্থ এই যে, তথায় অবস্থান। হওয়া এবং মক্কার প্রতি বিতৃষ্ণ হওয়ার উপক্রম হওয়া থেকে সেখানে অধিক। করা ভাল। এর অর্থ এই নয় যে, কাজ সমাধা হওয়ার পরেও য, মক্কার পড়ে; সুতরাং করে গুনাহগার সময় অবস্থান না রও কিছুকাল তথায় অবস্থান করলেই তা' মাকরহ হয়ে যাবে। আর এটা হবেই বা কেমন করে? স্থান, যেখানে অবস্থান করার আকাঙ্খা খোদ হযরত রাসূলে করীম (দঃ) মক্কা তো এমন একটি (দঃ) ব্যক্ত করেছেন। তিনি যখন মদীনা থেকে মক্কায় ফিরে এলেন তখন খানায়ে কা'বার দিকে মুখ করে বললেন, হে কারা: তুমি সুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ। দুনিয়ার যে কোন স্থান প্রিয়। যাদি আমি তোমার নিকট থেকে বহিষ্কৃত না হতাম। ান থেকে তুমি আমার নিকট অধিক তাহলে কখনই আমি তোমাকে কটি ইবাদাত। পরিত্যাগ করে অন্যত্র যেতাম না। তারপর কা'বা গৃহের দিকে দৃষ্টিপাত করাও একটি ন করার চেয়ে এমতাবস্থায় এটা কিরূপে সম্ভব হতে পারে যে, এখানে অবস্থান না করা অবস্থান উত্তম বলব?
0 Comments